জ্বলদর্চি

রজনীকান্ত মাইতি (শিক্ষক, সমাজ সংগঠক, রামনগর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৩১
রজনীকান্ত মাইতি (শিক্ষক, সমাজ সংগঠক, রামনগর) 

ভাস্করব্রত পতি

তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী এক মানুষ। এতদঞ্চলে শিক্ষার প্রসারে তাঁর ভূমিকা ছিল মাটির কাছাকাছি থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ানো মসীহা। অন্যতম একজন শিক্ষা সংগঠক বলা চলে। অত্যন্ত ছাত্রবৎসল এক প্রিয় শিক্ষকের তকমা অর্জন করেছেন নিজের কাজের গুণে। এলাকার বলীষ্ঠ শিক্ষা সম্প্রসারক হিসেবে আজও মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে। এহেন সমাজ সংগঠক তথা সংস্কৃতিমনষ্ক ব্যক্তিত্ব 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' রজনীকান্ত মাইতি জন্মগ্রহণ করেন ১৯১০ সালে কাঁথি মহকুমার রামনগর থানার ধাড়াশ গ্রামে। সেদিনটা ছিল মহাসপ্তমী তিথি। বাবা ছিলেন ভাগবতচন্দ্র মাইতি এবং মায়ের নাম পদ্মাবতী দেবী। আজ তাঁকে স্মরণ করেই ধাড়াশ গ্রামে গড়ে উঠেছে রজনীকান্ত জ্ঞানমন্দির সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্র। 

অসাধারণ মেধা ও প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। এই এলাকার প্রথম মেধাবী ছাত্র হিসেবে মানিকাবসান এম ই স্কুলে স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। এরপর কাঁথি মডেল স্কুলে যান। সেখানে স্কলারশিপ বাবদ পাঁচ টাকা বৃত্তি পেতেন। কিন্তু বাড়ির অবস্থা ছিল অত্যন্ত সঙ্গীন। দিন এনে দিন খাওয়া অবস্থা। বলতে গেলে, নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তাই বৃত্তি বাবদ পাওয়া টাকাটাও দিয়ে দিতে হত বাড়িতে। ম্যাট্রিকুলেশনে মোট আটটি সাবজেক্ট ছিল। এর মধ্যে সাতটিতেই লেটার পান। 
ধাড়াস গ্রামে রজনীকান্ত জ্ঞানমন্দির

এরপর চলে যান মেদিনীপুর কলেজে। সেখানে আই এস সি পড়ার জন্য ভর্তি হন। সেসময় পরপর তিন জেলাশাসক পেডী, ডগলাস এবং বার্জকে হত্যা করে মেদিনীপুরের বিপ্লবীরা। ১৯৩১ এর এর ৭ ই এপ্রিল পেডী হত্যার পর ১৯৩২ এর ২০ শে এপ্রিল আরেক জেলাশাসক ডগলাসকে হত্যা করেছিল প্রদ্যোত কুমার ভট্টাচার্য এবং প্রভাংশু শেখর পাল। ঠিক এক বছর বাদে ১৯৩৩ এর ২ রা সেপ্টেম্বর তেঁতুলতলা মাঠে পুলিশ প্যারেড গ্রাউন্ডে টাউন ক্লাবের সঙ্গে স্থানীয় মহম্মদীয়া ক্লাবের ফুটবল মাঠে টাউন ক্লাবের হয়ে খেলতে আসার পথে বার্জকে হত্যা করা হয়। ডগলাসের হত্যাকারী প্রদ্যোত কুমার ভট্টাচার্য ছিলেন রজনীকান্ত মাইতির রসায়ন বিভাগের সঙ্গী। ফলে ডগলাস হত্যার অব্যবহিত পরেই ব্রিটিশ পুলিশ অন্যান্য ছাত্রদের মতো তাঁকেও গ্রেপ্তার করে। তিনদিন আটক ছিলেন। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের সাথে তাঁর যোগাযোগের কোনও প্রমাণ ছিলনা। ফলে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এখান থেকে কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে গনিত অনার্স নিয়ে পড়তে শুরু করেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। 

বরং এরপরেই প্রবেশ করলেন কর্মজীবনে। প্রথমেই এগরার ঝাটুলাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহশিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন। এখানে থাকাকালীন বি. টি. কমপ্লিট করলেন। এখানে বেশ কয়েক বছর থাকার পর ১৯৫৬ সালে ফিরে আসেন জন্মভিটার টানে। ছোটবেলার বিদ্যালয় মানিকাবসান মাধ্যমিক বিদ্যালয়তে (প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২৪) প্রধান শিক্ষক হয়ে যোগ দিলেন। 

সেসময় এলাকায় ছিল অশিক্ষার অন্ধকার। তিনি ভাবলেন, এই অশিক্ষা থেকে মুক্তি না দিলে মানুষের উন্নয়ন সম্ভব নয়। মানুষের চেতনা জাগরণের জন্য দরকার পাঠ্যাভ্যাস। সামান্য একটা চিঠি পড়ার জন্যেও সেসময় লোকজন হাপিত্যেশ করে বসে থাকতো তাঁর বাড়ির সামনে। ইংরেজিতে চিঠিপত্র লেখা এবং পড়ার জন্য লোকজন তাঁর শরণাপন্ন হয়ে থাকতো তখন। তিনি চাইলেন এই অচলাবস্থা দূর করতে। সেই মোতাবেক এলাকায় চষে চষে শুরু করলেন শিক্ষার বিস্তার। তাঁর সহায়তায় এবং সাহচর্যে এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে ছেলে মেয়েরা ম্যাট্রিকুলেশন পাস করতে লাগলো। তৈরি হতে লাগলো একটা সত্যিকারের শিক্ষিত পরিমণ্ডল। পরিবর্তন ঘটতে লাগলো এলাকার মানুষের মানসিকতায় এবং ভাবনায়। সকলের মধ্যে শিক্ষাকে আত্মীকরণ করার চেতনা ও ইচ্ছাশক্তি জাগরিত হল। একটা নতুন দিশা দেখালেন মানুষজনের মধ্যে। 
রজনীকান্ত জ্ঞানমন্দিরে সংরক্ষিত ষষ্ঠীর পালাগানের প্রাচীন মুখোশ

বিদ্যালয়কেন্দ্রিক একদল জ্ঞান পিপাসু ছাত্রছাত্রী গড়ে তুললেন এলাকায়। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক। এভাবে চলতে চলতে চাকরিরত অবস্থাতেই ১৯৭৫ সালে হঠাৎ এই মহান শিক্ষাব্রতীর মহাপ্রয়াণ ঘটে। এলাকাবাসীকে শিক্ষার আলো দেখানো এই মানুষটির বিহনে নেমে আসে অন্ধকার। তৈরি হয় গভীর শূন্যতা। রামনগরবাসী হারায় তাঁদের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে। 

১৯৭৫ এর ৫ ই অক্টোবর শুরু হয় রজনীকান্ত জ্ঞানমন্দিরের পথচলা। কলাপুঞ্জার সুধীরকুমার মণ্ডল, মালঞ্চার কূলরঞ্জন দাস, গোষ্ঠ বিহারী জানা, কাদুয়ার কানাই আদক, ধাড়াশের অনিল দাশ সহ রজনীকান্ত মাইতির ছেলে অরবিন্দ মাইতি জনমানসে তাঁর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী হলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মহাসপ্তমী তিথিতে রজনীকান্ত মাইতির জন্মদিন পালিত হবে। সেইসাথে শিক্ষক রজনীকান্তকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে তাঁর নামে ভূগোল, ইতিহাস ও আঞ্চলিক শিল্পকলার সমন্বয়ে একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। যা সাধারণভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার পঠন পাঠনকে সাহায্য করবে, সেই সঙ্গে এতদঞ্চলের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের জন্য গবেষণার কাজে সহায়তা করবে। অর্থাৎ শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চা ও গবেষণার মধ্য দিয়ে রামনগরের শিক্ষার প্রাণপুরুষ রজনীকান্ত মাইতিকে স্মরণে, মননে, চিন্তনে রাখা সম্ভবপর হবে। সেই ভাবনা থেকেই গড়ে ওঠে 'রজনীকান্ত জ্ঞানমন্দির'। আজ এই সংগ্রহশালায় প্রত্নবস্তুর সংখ্যা বেড়ে প্রায় তিন হাজার। এই সংগ্রহশালার দৌলতে বীরকুলের (রামনগর ভোগরাই) ইতিহাস খুঁজে পেয়েছে তার প্রাচীনত্ব।

🍂

Post a Comment

1 Comments

  1. রজনী বাবু তার আমলে অনেক বিখ্যাত ছাত্র গড়ে তুলেছেন।যাঁরা তাঁর শিক্ষক সত্বার প্রমাণ স্বরূপ।লেখায় তাঁদের নাম উল্লেখ থাকলে লেখাটা আরো প্রাঞ্জল হতো উঠত মনে হয়।মতামত একান্ত ব্যক্তিগত।

    ReplyDelete