জ্বলদর্চি

দাড়িম্ব (বেদানা)/ ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৪৬
দাড়িম্ব (বেদানা) 

ভাস্করব্রত পতি

ভারতে যেসব মানুষ একসময় আফগানিস্তান, ইরাক, তুরস্ক, মিশর, ইরান থেকে এসেছিলেন তাঁরা এই ডালিম্বকে ‘করক’ বলতেন। “ইচ্ছন্তি ত্বা সোম্যাসঃ সখায়ঃ সুধন্তি সোমং দধতি পয়াংসি / তিতিক্ষন্তে অভিশস্তিং জনানাং করকস্তদা কশ্চন, হি প্রকেতঃ”। অথর্ব বেদের এই শ্লোকটিতে মেলে ‘করক’ নামটি। ‘কর' শব্দের অর্থ উপল বা পাথরের টুকরা। আর দাড়িম্ব শব্দের অর্থ যা বিদীর্ণ হলে মেধা সঞ্চিত করা যায়। অর্থাৎ, এটি মেধাকারক। 

“অভ্যাবৰ্ত্তস্ব দালিমঃ যজ্ঞেন পয়সা সহ যত্তে শুক্রং যৎপূতং বিশত্বা হৃদয়ং ভরামাসি”— অথর্ববেদে দাড়িম্ব বা ডালিম-এর সম্পর্কে লেখা আছে এটি। একে ভেদন করে রস নির্গত করা হয় বলে এর নাম 'দালিম'। ড় - ল অভেদে দাড়িম ও দল থেকে ই ম প্রত্যয়ের যোগে দালিম। 'দল' শব্দের অর্থ ভেদ করা। এই ডালিমকে বলে ‘বেদানা’। যাঁরা বলেন ‘নেই দানা' অর্থে ‘বেদানা’– তা নয়। আসলে 'বহু দানা' থেকেই 'বেদানা’। এটি ফারসি শব্দ। 
গোটা বেদানা

সাধারণত তিন ধরনের দাড়িম বা দাড়িম্ব গাছ দেখা যায়। (১) কেবলমধুর (২) অম্লমধুর (পাটনাই দাড়িম) এবং (৩) অম্ল (বাংলাদেশে পাওয়া যায়)। অনেক নামে পরিচিত এই গাছটি। একে বলা হয় দম্ভীবীজ, করক, দাড়িম্ব, পর্বরুহ, পিত্তপুষ্প, দাড়িমীসার, সুনীল, বৃত্তফল, বন্ধফল, সুফল, রক্তবীজ, কুট্টিম, ওকবল্লভ, ফলশাড়ব, স্বাদ্বপ্ন, পিন্ডীর, সংকল, নীরস, নীলপদ্র, দর্শনবীজ, বল্লভ শুকাদন, রক্তপুষ্প ইত্যাদি। 

এছাড়া ফার্সীতে অনারতুলস্, অনারসীরী, আরবীতে রুমালহলু, রুহানহামীজ, ওড়িয়াতে দালিম্ব, তামিলে মাদলই চেহেড্ডি, গুজরাটীতে দাড়ায়ন, সংস্কৃতে নীলপত্র, দারিম, কুচফল, বৃত্তফল, শুকবল্লভ, বন্ধফল, সুফল, মনিবীজ, মধুবীজ, দত্তজীব, লোহিত পুষ্প, রক্তবীজ, হিন্দীতে অনা, তেলুগুতে ডলিম্ব টেটু ও দালিম্বকায়া বলা হয়। এছাড়া ডালিম, দদিমা নামেও পরিচিত।

টকটকে লাল বেদানার দানা

ইংরাজীতে দাড়িম্ব বা দাড়িমকে বলে POMEGRANATE TREE। হিন্দুস্তানি ও পশতু ভাষায় একে 'আনার' বলা হয়। দেশি আনারকে 'ডালিম' বলে। খোসার ভিতরে স্ফটিকের মত লাল রঙের সুস্বাদু দানা দানা বীজ থাকে। বেদানার এই রক্তবর্ণ দানাগুলিই হল 'আনারদানা'। এছাড়াও কুর্দ ভাষায় বলে 'হিনার' এবং আজারবাইজানের লোকেরা বলে 'নার'। নেপালিতে বলা হয় 'দারিম'। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম PUMICA GRANATUM। এটি Lythraceae পরিবারের অন্তর্গত একটি রসালো ফল। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চ থেকে মে মাসে বেদানার ফলন হয়। 
বেদানার খোসা ছাড়িয়ে রসের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ লাল বীজ

বেদানার আদি নিবাস ইরান এবং ইরাককে চিহ্নিত করা হয়েছে। ককেশাস অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই বেদানার চাষ করা হচ্ছে। পরবর্তীতে এসব এলাকা থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে বংশবিস্তার করেছে। এখন এ দেশের বুকে উৎপাদিত হওয়া এক অন্যতম ফল। ইতিহাস বলে, ১৭৬৯ সালে ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যালিফোর্নিয়াতে বেদানা নিয়ে গিয়ে চাষ শুরু করে স্পেনীয়রা। আজ আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ও এরিজোনায় বেদানার চাষ হচ্ছে। আপাতত পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই ফলন হয় বেদানা বা ডালিমের। বাজারে চাহিদাও বেশি। বলতে গেলে, রোগীর পথ্য হিসেবে পরিগণিত হয় এটি। 

ডালিমের বহু উপকারী গুণ রয়েছে। রাতবিরেতে হঠাৎ নাক দিয়ে রক্ত পড়তে থাকলে এক্ষেত্রে ডালিম ফুলের রসের ব্যবহার খুব কার্যকরী। আমাশয় নিরাময়ে ডালিমের খোসা কাজে লাগানো হয়। নিয়মিত ডালিমের রস খেলে শরীরে রক্ত বৃদ্ধি পায়। সেইসাথে রক্তপাত বন্ধ করতেও ডালিমের ফুল অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। গর্ভপাত রোধে ডালিমের গাছের পাতা বেশ উপকারী। ডালিম গাছের ছাল শরীরের উপদংশ নিরাময়ে সহায়তা করে। ডালিমের রস নিয়ম মেনে সেবন করলে যাঁদের ডায়বেটিস রয়েছে, তাঁদের তা নিয়ন্ত্রণে থাকে। ডালিমের মধ্যে থাকে বিউটেলিক অ্যাসিড, আরসোলিক অ্যাসিড এবং কয়েক ধরনের আ্যলকালীয় দ্রব্য সিডোপেরেটাইরিন, পেপরেটাইরিন, মিথাইলপেরেটাইরিন, আইসোপেরেটাইরিন ইত্যাদি। এটিকে হৃৎপিন্ড সুস্থ রাখার অন্যতম মহৌষধ বলে মনে করেন কবিরাজরা।

🍂

Post a Comment

0 Comments