জ্বলদর্চি

শঙ্খ ঘোষ-এর অপ্রকাশিত গদ্য /প্রথম জীবনানন্দ-পড়া


শঙ্খ ঘোষ-এর অপ্রকাশিত গদ্য 

প্রথম জীবনানন্দ-পড়া
শঙ্খ ঘোষ

আমার স্কুলজীবনে আধুনিক কবিতার সঙ্গে কোনো পরিচয়ই হয়নি, তখন কেবল জানতাম রবীন্দ্রনাথ। কলেজজীবনে শহরে এসে পৌঁছবার পর নতুন এক খ্যাপাটে বন্ধুকে পাই, যে একলাইনও কবিতা লেখেনি কোনোদিন, কিন্তু কবিতার সে নেশাগ্রস্ত পাঠক। তারই আওড়ানো শুনে শুনে নতুনরকমের সব রহস্যময় কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় হতে থাকে, আর সেই সূত্রেই পেয়ে যাই একদিন জীবনানন্দকে।

প্রতিমাসের দু-তারিখে তখন নিশ্চিতভাবেই বেরোত 'পূর্বাশা' নামের অত্যুজ্জ্বল পত্রিকাটি। বেরোলেই, পাতিরামের স্টল থেকে হাতে নিয়েই, প্রথমেই উলটে দেখতাম কবিতার পাতাকটা। মুদ্রিত আকারে জীবনানন্দের কবিতা সেখানেই পড়ি প্রথম, কবিতাটি ছিল ১৯৪৬-৪৭।

এখন যেমন লাগে কবিতাটি, তখনও যে ঠিক তেমনই লেগেছিল তা বলতে পারি না। আমাদের তখনকার দিনের যে অভিজ্ঞতা, তার ফলে এসব লাইন মনকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল ঠিকই: 'মাানুষ মেরেছি আমি-তার রক্তে আমার শরীর / ভরে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত  ভ্রাতার / ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু/ হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে গেল...'! কিন্তু তবুও বলা যায় না যে সঙ্গে সঙ্গেই এ-কবির একান্ত অনুরাগী হয়ে উঠলাম। সে-অনুরাগটা এল আর কিছুদিন পর, যখন হলুদ মলাটের 'কবিতা' পত্রিকায় ওই পাতিরাম থেকেই পাওয়া গেল একদিন তাঁর 'অন্ধকার' নামের কবিতাটি। বলা ছিল যে এ তাঁর সতেরো বছর আগেকার কোনো পুনর্লিখন, কিন্তু সে-খবর তখন আমার কাছে ছিল অবান্তর। নেশাধৱা নিশ্চলতায় সে-কবিতা এতদূর আবেশ এনে দিল যে তখনই খুঁজে বেড়াতে হলো তাঁর কোনো পূর্ণাঙ্গ বই। বৈতরণী, কীর্তিনাশা, পাণ্ডুর চাঁদের ছায়া আর নীল কস্তুরী আভার চাঁদ থেকে কবিতাটি এগিয়ে চলছিল কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদের দিকে, ঘৃণা বেদনা আক্রোশকে একত্র মিলিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল অন্ধকার ঘুমের আস্বাদে!  এ-রকম কোনো অভিজ্ঞতা এর আগে আর পাইনি কোনো কবিতায়, তাই এঁকে ভালো করে পড়াই চাই, এখনই। 

শুনেছি তাঁর এক বইয়ের নাম 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'। দুবন্ধু মিলে খুঁজে বেড়াই সে-বই, দোকানে দোকানে। কেউ কিছু বলতে পারে না খবর। শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছি চক্রবর্তী অ্যাণ্ড চ্যাটার্জির কাছে, কিন্তু পরম উদাসীন প্রত্যাখ্যানে ফিরিয়ে দেন তাঁরাও। ফিরিয়ে দেন, তবু যাই না আমরা। নাছোড় ভাবে কাতর মিনতি করছি দেখে করুণাপরবশ একজন চলে গেলেন লম্বা এক শেল্ফের পেছনে, বহুক্ষণের চেষ্টায় সেখান থেকে বার করে আনলেন ধূলিধূসর একখানা লম্বাচওড়া বই, কাউন্টারের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বললেন: 'এইটেই কি?' 'হ্যাঁ, এই তো, আছে তো তবে।' দোকান থেকে বেরিয়ে এসে ফুটপাথেই খুলে ধরি সে-বইয়ের পাতা। বিকেলের রোদ এসে পড়ছে পাতাগুলির ওপর। মেদুরতায় ভরে যাচ্ছি আমরা।

ম্লান আলোপড়া সেই মুহূর্তটাকেই আমার মনে হয় জীবনানন্দকে সর্বতোভাবে স্পর্শ করবার সত্যিকারের প্রথম মুহূর্ত।

[ শঙ্খ ঘোষের এই অসামান্য লেখাটি কীভাবে আমার অগোছাল বইপত্রের মাঝখানে এসে পড়েছিল, জানা নেই। শঙ্খ-সাক্ষাতের কোনও সৌভাগ্য আমার হয়নি, এ রকম লেখার কোনও অনুরোধও তাঁকে জানাবার কোনও অবকাশ আমার ছিল না কখনও। মউলি (মিশ্র) এক সময় শঙ্খের বাড়িতে যাতায়াত করেছে, সেই কি বয়ে এনেছিল এই অমূল্য লেখাটি? কোনও ফোটো কপি নয়, মূল লেখাটিই আত্মগোপন করেছিল এতকাল। শঙ্খ ঘোষের কোনও গ্রন্থে এটি সন্নিবিষ্ট হবার সুযোগ তাই সম্ভবত নেই। জীবনানন্দের একশ পঁচিশতম জন্মবার্ষিকীতে এই লেখাটির উজ্জ্বল উদ্ধার সম্ভব হল—এটি একটি সমাপতন বলে মনে হয়। জ্বলদর্চি এটি সাগ্রহে প্রকাশ করছেন—এ জন্য ঋত্বিককে ধন্যবাদ, যেহেতু আমার দায়মুক্তি ঘটানোর দায় তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। —অজিত মিশ্র।]

🍂

Post a Comment

0 Comments