মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৩২
সঞ্জয় কুমার পয়ড়া (লিফ আর্ট শিল্পী, দাঁতন)
ভাস্করব্রত পতি
কত লোকে কত কিছুই কাটে। কেউ কাটে পথ, কেউ কাটে গাছ, কেউ কাটে মাংস, কেউ কাটে গাঁট। আবার কেউ কাটে সম্পর্ক। আর তিনি কাটেন গাছের পাতা। কাগজ দিয়ে নয়, ঐ গাছের কাটা পাতায় তিনি ফুটিয়ে তোলেন দিল্লির কুতুব মিনার কিংবা কলকাতার হাওড়া ব্রিজ।
আসলে তাঁর হাতের যাদুর ছোঁয়ায় গাছের নিরীহ সবুজ পাতা হয়ে ওঠে অপূর্ব শিল্পসুষমাময় উপাদান। যে ছবি কাগজের ওপর রঙ তুলি দিয়ে ফুটে ওঠে, সেই ছবি তিনি আঁকেন পাতা কেটে কেটে। তাঁর পত্রশিল্পে ধ্বনিত হয় ইজরায়েল থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলাদেশ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সঞ্জয় কুমার পড়ার লিফ আর্ট
১৯৯১ সালের ১৭ ই এপ্রিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন থানার প্রত্যন্ত গ্রাম বামনদায় জন্ম সঞ্জয় কুমার পয়ড়ার। বাবার নাম রবীন্দ্র পয়ড়া এবং মায়ের নাম কল্যাণী পয়ড়া। ছোটবেলা থেকেই চরম দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়ে উঠেছেন। ঘরে দুই ভাই, বাবা মা ,স্ত্রী ও পুত্র নিয়ে সংসার। দারিদ্রতার কারণে নিজেই টিউশন করে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন।
সঞ্জয়ের চকের কাজ
করোনার সময় লকডাউন পিরিয়ড চলাকালীন ছিল অখণ্ড অবসর। তখন তাঁর প্রিয় লিফ আর্ট তথা পত্রশিল্পের প্রতি ঝোঁক বেড়ে যায়। যদিও এই শিল্পকর্ম একেবারেই নতুন। বেশিরভাগ মানুষ জানেই না। মেদিনীপুরের বুকে হাতে গোনা যে কয়েকজন করেন তাঁদের মধ্যে তিনি হলেন অন্যতম। তাঁর হাতের কাজ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সামান্য পাতা দিয়ে কি অসাধারণ শৈল্পিক সুষমা গড়ে তোলা যায়।
এই শিল্পের প্রথাগত কোনোও কৌশল বা পদ্ধতি নেই। তাছাড়া এই শিল্পকর্মের উপর বিশেষ কোন লেখা বইও নেই। ফলে রেফারেন্স পাওয়ার কোনও উপায়ই নেই। তবুও তিনি নিজের ধৈর্য্য এবং আত্মপ্রত্যয়কে পাথেয় করে মেদিনীপুরের বুক থেকে একটা নতুন ধারার সূচনা করেছেন।
পবিত্র সরকারের সঙ্গে সঞ্জয়
এই লিফ আর্টের ক্ষেত্রে যেটুকু তিনি করতে পেরেছেন, তার সবটুকুই বারবার ভুল করার মাধ্যমে শিখে করেছেন। নিজেই শিক্ষক, নিজেই ছাত্র। দিনের পর দিন বিভিন্ন পাতা নিয়ে অজস্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়েছে। অবশেষে মিলেছে সাফল্য। একটা নতুন শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচিতি ঘটিয়েছেন জেলাবাসী তথা রাজ্যের শিল্পরসিক মানুষজনকে।
গতানুগতিক ধারার বাইরের এই পত্রশিল্পের জন্য তিনি বেছেছেন কনকচাঁপা গাছের পাতা এবং অশ্বত্থ গাছের পাতাকে। বর্তমানে তিনি এই পত্রশিল্পকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বলা চলে। যদিও একসময় এটিকে নিজের শখ হিসেবে শুরু করতে হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে অর্থাগমের সুযোগও এনে দিয়েছে এই আপাত নিরীহ কিন্তু ভীষণ শ্রমসাধ্য পত্রশিল্প। মূলতঃ প্রকৃতি মায়ের প্রতি এই পৃথিবীর একজন সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদনের জন্য এটি অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে তাঁর কাছে।
এটুকু বলা যায়, এই শিল্পকলা কিন্তু বেশ সময়সাপেক্ষ এবং অর্থবহুল শিল্প। সাধারণ ছুরি দিয়ে নয়, এজন্য দরকার দামি সার্জিক্যাল নাইফ। এক একজন মানুষের প্রতিকৃতি তুলতে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়। সঞ্জয় কুমার পয়ড়া নিজে আর একটি শিল্পকর্মের জন্ম দিয়েছেন -- 'কৃত্তিরেখা স্ফুটন'। মূলতঃ এই শিল্পকর্ম কালো আটপেপারের উপরের ছালটিকে ছাড়িয়ে করা হয়ে থাকে। এই শিল্পকর্মের নামকরণ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অরূপ কুমার দাস। ধ্যানরত গৌতম বুদ্ধের একটি অসাধারণ প্রতিকৃতি বানিয়ে তিনি নিজের শিল্পদক্ষতা বুঝিয়েছেন এই শিল্পকর্মের মাধ্যমে।
শুধুমাত্র পত্রশিল্প তথা লিফ আর্টই নয়, এর সাথেই চলে চক ও পেন্সিল দিয়েও শৈল্পিক শৈলী প্রকাশের অনন্য উদাহরণ। অবসর সময়ে সামান্য চক ও পেন্সিলের শিস কেটে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ও দেবদেবীর মূর্তি গড়ে থাকেন। যেকোনো উপাদান দিয়ে মানুষের প্রতিকৃতি অনায়াসে তিনি গড়ে তুলতে পারেন। যদিও এসব কারোরই কাছে প্রথাগতভাবে শেখা হয়ে ওঠেনি। নিজের অদম্য আগ্রহ ,অধ্যাবসায় ও প্রচেষ্টার জোরে এগুলি শেখা।
অশ্বত্থ ও চাঁপা গাছের পাতা দিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ টিরও বেশি দেশবিদেশের বহু বিখ্যাত মানুষের পত্র প্রতিকৃতি গড়ে তুলেছেন। তাঁর এই চিত্তাকর্ষক শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছেন ভারতের বিজ্ঞানী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, সাংবাদিক, অভিনেতা, গায়ক, ডাক্তার, কলেজের অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, স্কুলের শিক্ষক, গবেষক, ভাষাবিদ, লেখক, কবি ও প্রমুখরা। দেশ বিদেশের বিভিন্ন আইকনিক স্থান, সৌধ, মনুমেন্ট, ব্রিজ, দুর্গ ও স্থান পেয়েছে তাঁর হাতের ছোঁয়ায়। দাঁতনের প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামে বসেই তিনি গান্ধীজি, বিদ্যাসাগর, মাদার টেরিজা, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, এ পি জে আব্দুল কালাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকান্ত ভট্টাচার্য, দ্রৌপদী মুর্মূ, শচীন তেন্ডুলকর সহ অসংখ্য বিখ্যাত মানুষের প্রতিকৃতি গড়েছেন।
তাঁর এই পত্রশিল্পকর্মের জন্য নাম উঠেছে ইন্ডিয়া বুক অব রেকর্ডস, ইন্টারন্যাশনাল বুক অব রেকর্ডস, ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ইন্ডিয়াতে। এছাড়াও বহু বিখ্যাত মানুষের শংসাপত্রও রয়েছে এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে। মূলতঃ এসব কিছু শিখেছেন বহু গুণী মানুষের সান্নিধ্যে থেকেই।
বর্তমানে তিনি একটি বিদ্যালয়ে আংশিক সময়ের শিক্ষক। আর সংসার চালানোর জন্য ইংরেজি বিষয়ে টিউশান করেন। আপাদমস্তক শিক্ষিত সঞ্জয় কুমার পয়ড়া এর সাথে স্পোকেন ইংলিশ শেখানো, আর্ট শেখানোকেও পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এর আগে বহু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে, বাংলা মাধ্যম স্কুল ও নার্সারি স্কুলে আংশিক সময়ের শিক্ষকতা করেছেন। ইংরেজিতে মাস্টার ডিগ্রী ও ডি এল এড ডিগ্রী লাভ করেও সরকারি চাকরি জোটেনি।
ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি বিষয়টা বরাবরই তাঁর প্রিয় ছিল। তাছাড়াও বিভিন্ন জিনিস দিয়ে ভাস্কর্য ও শিল্পকর্ম তৈরি করা ছিল এক ধরনের অন্যরকম শখ। যদিও বরাবরই তুলি ,পেন্সিল, রং দিয়ে তৈরি ধারাবাহিক শিল্পরীতির মধ্যে মনকে কখনোই আটকে রাখতে পারেননি। নতুনত্ব ও সৃজনশীলতার দিকে মন বরাবরই আকর্ষিত হতো। নতুন ধরনের কিছু শিল্পকর্ম বরাবরই তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করতো। অপলক কৌতুহলী চোখে দেখতেন এবং পদ্ধতি অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা করতেন।
তিনি শুধু শিল্পী নয়, কবিও। বাংলা ও ইংরেজিতে নিয়মিত কবিতা, প্রবন্ধ, অনুকবিতা, অনুগল্প, গল্প লিখে থাকেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। বহু বিখ্যাত পত্রপত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। নিজেই সম্পাদনা করেন 'নবোদ্যম' পত্রিকা। এখানে কলম ধরেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের অধ্যাপক, শিক্ষক, গবেষক, চিত্রশিল্পী, কবি সাহিত্যিকরা। বিভিন্ন বই এবং পত্র পত্রিকার প্রচ্ছদেও দেখা যায় তাঁর হাতের ছোঁয়া। ।
সম্প্রতি নিজের লেখা একগুচ্ছ ইংরেজি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে 'প্রতিবিম্বম' নামে একটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ। ইংরেজি সাহিত্যের কৃতি ছাত্র হিসেবে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন এই কাব্যে। মূলতঃ বহু বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্যে এসে এসব কিছু শিখতে পেরেছেন। মঞ্চ সঞ্চালনাতেও তিনি সাবলীল। ইংরেজি এবং বাংলায় কথা বলায় তিনি সড়গড়। স্পোকেন ইংলিশ শেখানোর সুবাদে তিনি বিভিন্ন ন্যাশনাল উইন্টার ক্যাম্প বা ন্যাশনাল সামার ক্যাম্পে রিসোর্স হিসেবে গিয়ে থাকেন। বেশিরভাগই পূর্ব মেদিনীপুর ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যে হয়ে থাকে। এই ক্যাম্পে বিভিন্ন ফরেনারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ হয়ে থাকে।
তিনি একজন সংগ্রাহকও। দেশ বিদেশের বহু দুষ্প্রাপ্য মুদ্রা সংগ্রহ করেছেন নিজের তাগিদে। সংগ্রহে রয়েছে প্রায় কুড়িটিরও বেশি দেশের মুদ্রা এবং ভারতের বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য মুদ্রাও রয়েছে। এছাড়াও বই পড়া, নতুন ভাষা শেখা, বিভিন্ন উপাদান দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরি করা, ক্যালিগ্রাফি শেখানো, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখা, মিমিক্রি করা ইত্যাদি শখগুলো বজায় রেখেছেন নিজের মননের উন্নয়নে। ছোটবেলা থেকেই মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও অন্যান্য বহুভাষার প্রতি শিশুসুলভ বিশেষ কৌতুহল ছিল। তার ফলস্বরূপ তিনি নিজের চেষ্টায় ওড়িয়া, উর্দু, গুজরাটি, সংস্কৃত, হিন্দি ও ব্রাহ্মী লিপি পড়তে ও লিখতে জানেন। যথার্থই তিনি মেদিনীপুরের অন্যতম মানুষ। মেদিনীপুরের মানুষ রতন।
🍂
1 Comments
অসাধারণ শিল্প কাজ। হ্যাটস অফ্ টু সঞ্জয় কুমার পয়ড়া।
ReplyDeleteএই অনবদ্য শিল্পী ও তাঁর শিল্পকে আমাদের কাছে তুলে ধরার জন্য ভাস্করব্রত পতি কে ধন্যবাদ।