জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত /টানেল রহস্য -পর্ব ২

চিত্র- শুভম দাস 
গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
টানেল রহস্য  পর্ব ২


বিমল ও শ্রীকুমার আবার হাজতে গেল, তিনদিন ঠান্ডা গরমে জেরা চলল গরাদের আড়ালে। 
সেলে তেড়ে মার। বিমল হাতজোড় করে,
‘আপনাদের কথামতই তো বললাম সব কিছু, এবারে ছেড়ে দিন।’
জাঁদরেল অফিসার, হাস্যময়ী, অল্পভাষিণী।
এক লাঠির ঘা কব্জিতে দিয়ে মৃদু হেসে বলেন, ‘তুই বেশি জানিস বলেই মুশকিল।’

 বিমল শান্ত হয়ে মাটির দিকে তাকায়, বলে, ঠিক কথাই বলব। যেমন বলেছেন।

 আবার কোর্টে তারিখ পড়ল তিনদিন পরে। 
এইবারে বিমলের পেট থেকে বেরিয়ে এল নতুন গল্প । 
‘স্যার, আমি আরো কিছু বলতে চাই ঐ ইঁদুরদের ব্যাপারে। ভয়ে বলিনি আগে, যদি বিশ্বাস না করেন। অনুমতি পেলে বলি। ‘
মিশ্রাজি উৎসাহ পেয়ে বলেন ‘ এই তো কথা বেরোচ্ছে তাহলে, বলুন, বলুন। কিচ্ছু লুকোবেন না। বলুন ই ভি এম গুলো কোথায় পাচার হল?‘

‘মাটি থেকে উঠে আসা মানুষ গুলো আসলে হারিয়ে যাওয়া খনিশ্রমিক। ওরা বলল ওরা নাকি ইঁদুরমাইনার। খনির মধ্যে যেখানে কেউ যেতে পারে না সেখানে ওরা ইঁদুরের মত ঢুকে যেতে পারে। ঐ যে নর্থ ইন্ডিয়াতে টানেল ধ্বসে গেল, তারপর মাইনাররা এসে খুঁড়ে উদ্ধার করল একচল্লিশ জনকে, সেইরকম মাইনার। ওরা পাথর খুঁড়ে খুঁড়ে রাস্তা করতে পারে, মিনারাল তুলে আনতে পারে। মাদারির কাছে নাকি বেশ কটা বোজানো খনি আছে। আর সবাই জানে, মিনারাল ফুরিয়ে গেলে সেই খনি জল দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়। এমনিই একটা খনিতে ওরা কাজ করছিল, হঠাৎ পাথরের চাংগড় ভাঙ্গতে থাকে, ওরা চাপা পড়ে যায়। খনি বুজিয়ে দেওয়া হয়। খনিগুলো আর ব্যবহার হয় না। সরকারী তথ্য বলছে ওই খনিগুলো ব্যবহারের অযোগ্য।‘

‘আপনি তো অনেক কথা জানেন দেখছি। গাঁজাখুরি ছাড়ুন। আসল কথাটা বলুন দেখি।‘ সুরমা ঘোষ তেড়ে ওঠেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বাধা দেন, 
‘আপনি বলুন, আমি শুনছি। তো সে লোকগুলো আবার ওপরে এল কি করে? ভারী যন্ত্রপাতি ছাড়া এভাবে টানেল করা কি সম্ভব?’
‘স্যার আমি তো আসলে মাইনিং ইঞ্জিনীয়ার, চাকরি না পেয়ে পরীক্ষা দিয়ে ক্লার্ক হয়ে ঢুকি। এ ব্যাপারে আমার একটু বিদ্যে আছে। যাই হোক, ওদের নামটা শুনলেন তো, ওরা হল র‍্যাট মাইনার। খনির তলায় আটকিয়ে পড়লেও, ওরা কিন্তু হার মানে নি। দশ দিন ধরে খিদে, আতঙ্ক আর কালো নিষ্ঠুর খনির অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করে ওরা গর্ত খুঁড়তে থাকে। ঠিক দশ দিন পরে হঠাত একদিন টানেলের মুখে দেখা যায় একটা ছোট্ট আলোর বিন্দু। সেইখান দিয়ে ওরা হামাগুড়ি দিয়ে অবশেষে বেরিয়ে আসে আলোয়। ‘
‘একদম বাজে কথা। এরকম কোন রিপোর্ট আমাদের কাছে নেই, আবার আপনি বাজে গল্প বলছেন?’ মিশ্রাজি হাল্কা ধমক লাগায়। 
বিমল ওনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে, তার পর বলে,
‘ কি করে থাকবে? বাইরে বেরিয়ে ওদের একজনকে ওরা প্রতিনিধি করে পাঠায় কম্পানির কাছে। সেখানে সে নিজের পরিচয় দেয়, সব ঘটনা বলে। আবেদন করে ওদের কাজে নেওয়া হোক, আর দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। তারপর যে কি হয় আর জানা নেই, তাকে কম্পানীর অফিস থেকে আর বেরোতে কেউ দেখে নি। তাকে নাকি মুখ বেঁধে রেললাইনে ফেলে এসেছিল কিছু অজানা লোক।‘

🍂

বিমল একটু চুপ করে, তারপর এক গ্লাস জল চায়। জল খেয়ে আবার বলতে শুরু করে, 
‘ বাকী লোকগুলো খবর পায় তাদেরও একই ব্যবস্থা করার জন্য লোক ঠিক করেছে কমপানি, যাতে সত্যিই তারা আর কোনদিন মাটির নীচ থেকে উঠে না আসতে পারে। আতঙ্কে, অবসাদে, খিদেয় অবসন্ন লোকগুলো অনেক আশা করেছিল, ওরা আবার নতুন এক জীবনে ফিরবে, কালো রাতের অন্ধকার এবার শেষ হবে। কিন্তু তা হয় না। জীবনের ভয়ে ওরা আবার পালিয়ে আসে সেই গর্তে অন্ধকারের জীবের মত। ওরা ওদের খুঁড়ে রাখা টানেলে আবার ঢুকে যায়। তারপর থেকে ওরা হয়ে যায় টানেলের মানুষ। রাত্তিরে তারা উঠে আসে, ওদের খাবার জোগাড় করে, কারা তা দেয় আমি বলতে পারব না। আবার ফিরে যায় টানেলে। ব্যস এই পর্যন্তই আমি জানি। ওরা আমাকে যা বলেছিল তাই বললাম, সত্যি মিথ্যে জানি না।‘ 

‘গাঁজা খান নাকি?’   অফিসার আবেদন করে, 
‘মিলরড, এনার কথাবার্তা স্বাভাবিক নয়, খুব অসংলগ্ন কথা বলছেন। আমাদের সন্দেহ হচ্ছে সাক্ষীকে অল্পসময় অজ্ঞান করার জন্য কিছু ড্রাগ দিয়েছিল ই ভি এম চোরেরা, তা থেকেই এলোমেলো বকছে। আমরা আবেদন করছি বিমলবাবুকে মানসিক হাসপাতালে কিছুদিন রাখার জন্য।‘
 
মিলর্ড হাতুড়ি ঠোকেন, বলেন, এই আবেদন না মঞ্জুর। ভারতবর্ষের মহান আইনী ঐতিহ্যের এক ধ্বজাবাহী তিনি, তাঁর পরিবারও বিখ্যাত তাঁদের পরম্পরার জন্য। একজন সত্যিকারের বিচারকের মতই তিনি জানতে চান সত্যি কথাটা। বলেন,
‘সাক্ষীর আরো কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। ‘

‘স্যার, সেদিন যখন মানুষগুলো উঠে এলো আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ওরা আমাদের দেখে বলল,
‘একদম চুপ করে থাকুন, আমরা আপনাদের কিছু করবো না। কিন্তু টুঁ শব্দটিও করবেন না। আমরা আছি জানতে পারলে আমাদের জানে মেরে দেবে।‘
আমরা ভয়ে তটস্থ হয়ে গিয়েছিলাম, মুখ দিয়ে এমনিই কোন কথা বেরোচ্ছিল না। ওদের মধ্যে একজন যে কথা বলছিল তার হাতে ছোট দিশি একটা রিভলভারও ছিল, আমরা চুপচাপ চোখ বড় করে দেখতে থাকলাম এর পর কি হয়। 
এমন সময় বাইরের দরজায় ঠকঠকঠক তিনবার আওয়াজ হোল। অন্ধকার থেকে দুজন লোক ঢুকে পড়ল, মুখে গামছা ঢাকা, হাতে তাদের বেশ কিছু প্যাকেট। মনে হল খাবার দাবার আছে, রুটি, বিস্কুট, ছাতুর প্যাকেট। কিছু জলের বোতল, আর ওষুধ। 
আমাদেরও খাওয়া হয় নি সেই বিকেল থেকে। জল ফুরিয়ে এসেছিল। আমাদের দেখে ওরা আমাদের জন্যও সেই ঝর্ণার জল, রুটি আর ওলের তরকারি দিল, আদেশ দিল, চটপট খেয়ে নিন, বিপদ যে কোন সময় আসতে পারে। আমরা কোন আপত্তি না করেই সেই খাবার নিয়ে সবে খেতে বসেছি, তখন হঠাৎ একটা গাড়ীর আওয়াজ।
এই পর্যন্ত বলে বিমল চুপ। এতটা সাহস করে বলার উত্তেজনা তার চোখে মুখে, হাতটাও অল্প কাঁপছে। 
বিচারক- ‘থামবেন না, বলুন, ভয়ের কিছু নেই, এটা আদালত। আপনার কোন বহ নেই। তারপর?’

পুলিশ অফিসার সুরমা ঘোষ চীৎকার করে ওঠে,
‘মিলরড, উনি আদালতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন, মিথ্যে কথা বলছেন। এটা বলতে দেওয়া যায় না।  অব্জেকশান। 
বিচারক- ‘ওভাররুল্ড, বলতে দিন ওনাকে। বলুন আপনি।’

‘বাইরে একটা জীপের আওয়াজ, আর তার পরে চারজন আরমড পুলিশ আর এই ম্যাডাম ঘরে এসে ঢুকে পড়েন। 
ম্যাডাম আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘আমরা আপনাদের রেস্কিউ পার্টি, চলুন, কোন চিন্তা নেই। খুব শীগগিরই আপনাদের সবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে, কোন চিন্তা করবেন না। 

কিন্তু এতগুলো লোক দেখে পুলিশের লোকজন   খুব অবাক হয়ে যায়। ম্যাডাম দু একটা প্রশ্ন করেন ওদের, আর তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা বুঝে ফেলেন। 
এরপর চটপট উনি ফোন লাগান কাউকে। মনে হয় কিছু নির্দেশ আসে। তারপরই ওনাদের ব্যবহার বদলে যায় একেবারে। 
 চারজন পুলিশি বন্দুক তাক করে ঐ ইঁদুর মানুষগুলোর দিকে। ম্যাডাম ওনার পিস্তল উঁচিয়ে অরডার দেন, 
‘হাতে যা আছে সব ফেলে দিয়ে সারেন্ডার কর। এক্ষুনি।‘
লোকগুলো রিভলবার লুকিয়ে ফেলেছিল, পুলিশ দেখে। এখন আসতে আসতে সেটা বার করে সামনে ফেলে দেয়। তারপর হাত তুলে দেয় ওপরে। 
ম্যাডাম বলেন এবারে যেখান থেকে এসেছ সেইখানে চুপচাপ ফিরে যাও, আর যেন তোমাদের দেখা না যায় মাটির ওপরে। ভাগো ভাগো। 
 অগত্যা লোকগুলো খাবার দাবার ফেলেই গর্তের দিকে হাঁটা শুরু করে। আর  ওরা যেই পিছনে ফেরে, ম্যাডাম হাত নাড়িয়ে ইঙ্গিত দেন, পিছন থেকে চারটে বন্দুক থেকেই একসঙ্গে ফায়ার হয়।। আমরা শুধু দেখি। রক্তের ধারাগুলো গর্তের দিকে বয়ে যাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে কালো টানেলের অন্ধকারে। 

নিস্তব্ধ আদালত। বিমল বলে, ‘ওদের ঐ টানেলেই পুঁতে দেয় স্যার। আমাকে ম্যাডাম বলেছেন যদি ই ভি এম পাচারের কনফেস না করিতো আমাকেও পুঁতে দেওয়া হবে’।

বিমলের কথা শেষ হলে প্রবল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে অফিসার।
বিচারক অরডার অরডার বলে তাকে থামাতে মিস ঘোষ বলেন,
‘মিলরড, বিমল বাবুর মানসিক ভারসাম্য একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। কি সব আবোল তাবোল বকছেন ঠিক নেই। আমরা আবেদন করছি, ওনার মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা হোক।‘

 বিমল প্রায় চীৎকার করে আবেদন করে,
‘ স্যার আপনি ওই জায়গাটা আবার খুঁড়তে আদেশ দিন, সব কিছু জানা যাবে। ‘

আইন আইনের পথে চলে। বিচারক মামলা মুলতুবী করে দেন। পুলিশের ডাক্তার সই করেন কাগজে, মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে বলে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিমল্বাবুকে। ওনার সঙ্গী ড্রাইভার শ্রীকুমারকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অবশ্য আগে তাকে ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, কেমন করে ভাল ছেলের মত থাকতে হবে এর পর। 

সে একমাস আগের কথা। এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি মানসিক রোগীর মফস্বলের ভাঙা পাঁচিলের বাইরে। বিমল প্রশ্ন করে,
‘তোমরা কারা, আমাকে উদ্ধার করলে কেন?’

‘আমরা ইঁদুর। র‍্যাটমাইনার।’
‘তোমরা তো গুলি খেয়ে শেষ হয়ে গেলে দেখলাম।’
‘না আমরা শেষ হইনি। আমরা আরো অনেকে ছিলাম টানেলের ভিতর। একটা পুরো দল ছিল আমাদের। ওরা তিনজনকে গুলি করে পুঁতে দিল, আমরা ওদের নিয়ে গেলাম। পুলিশের টিপ খারাপ। কোনটাই ঠিক লাগে নি, একজনের কান কাটা গেছে, বাকী সবাই গুলি বার করে ঠিক আছে। সব খবর আমরা পেয়েছি। জজসাহেব বদলী হলেন। আপনাকে পাগলাগারদে দেওয়া হল।

ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে কালো মাটির ওপরে, কালো একটা ধারা বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ী রাস্তায়। ওরা বিমলকে বলতে থাকে,
‘ আমাদের কিন্তু এখন অনেক অনেক টানেল। শুধু এখানে নয়, অনেক শহরে, গঞ্জে আমরা গড়ছি একটা অন্য দেশ।  মাটির তলায় বসে আমরা অনেক নতুন কিছু ভাবছি, আলোয় যেতে হবেতো একদিন। আপনিও চলুন, আপনার মত আরো অনেক সাহসী লোক আমাদের চাই।
র‍্যাটমাইনারের সংখ্যা বেড়ে যায় আরো একজন। 

-শেষ-

Post a Comment

0 Comments