জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭৪ / সালেহা খাতুন

মঞ্চের সবথেকে ছোট্টটি আমার কন্যা

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭৪ / সালেহা খাতুন 

শাশুড়িমাকে নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যেই মেয়ের শৈশব অতিবাহিত হচ্ছিল। খুব ছোটো বয়সে স্কুলে ভর্তি না করলেও ওর একটা অ্যাসোসিয়েশন ছিল। সেটা মেদিনীপুরের বঙ্কিম স্মৃতি সব পেয়েছির আসর। ওখানে দেওয়ার কথা মণিবাবুই বলেন। অধ্যাপক মণিমোহন মণ্ডলের কাছে আমি বিভিন্নভাবে ঋণী। আমি বার বার দেখেছি সম্পর্ক শুধু রক্তের উপর নির্ভর করে না। এমন কিছু মানুষ আমি জীবনে পেয়েছি যাঁরা আমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। 

মাননীয় জীতেশ হোড় তখন মেদিনীপুর অঞ্চলের সব পেয়েছির আসরের সংগঠক। প্রখ্যাত শিশু দরদী অখিল নিয়োগী যাঁকে আমরা স্বপন বুড়ো বলে চিনি তিনিই সব পেয়েছির আসরের স্রষ্টা। তাঁরই সৃষ্ট সব পেয়েছির আসরের পতাকাতলে আসীন ছিল মেদিনীপুরের এই বঙ্কিম স্মৃতি সব পেয়েছির আসর। মেদিনীপুরের প্রখ্যাত সমাজসেবী, শিশুদরদী বঙ্কিম বিহারী পালের নামে এই আসরের নামকরণ করা হয়। তখন বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ বালক বিদ্যালয়ে প্রতিদিন বিকেলে শিশুদের নানান ক্রিয়াকলাপ হতো। মেদিনীপুর কলেজে ঢোকার মুখেই জীতেশদার ‘এডুকেশন’ যোগাযোগের এক ল্যান্ডমার্ক। বেশিরভাগ দিন জীতেশদাই নানান খেলাধূলার মাধ্যমে শিশুদের এক অনন্য শৈশবের আস্বাদ দিতেন।

২০০৫ এর ১৮ ডিসেম্বর বঙ্কিম স্মৃতি সব পেয়েছির আসরের রজতজয়ন্তী বর্ষ উদযাপিত হয়। সেদিন মেয়ের প্রথম স্টেজ পারফরমেন্স। মেদিনীপুরের প্রদ্যোত স্মৃতি সদনে। ও ছিল সবচেয়ে ক্ষুদে আর্টিস্ট। ‘লম্বা দাড়ি চৌকিদার’ ছড়ায় সমবেত নৃত্যে অংশ নিয়েছিল। রিহার্সাল সব পেয়েছির আসরেই হয়েছিল। গ্রিনরুমে যিনি মেকআপ আর্টিস্ট ছিলেন তিনি খুব মজা পাচ্ছিলেন ওকে নিয়ে। ওর মুখে খুব কম রঙ দেন। পরে পরে আরো অনুষ্ঠান করে। বিশেষ করে ২০০৬ থেকে মেদিনীপুর কলেজ স্টাফ কোঅপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটির প্রত্যেক তিরিশে জানুয়ারির অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতো। সব পেয়েছির আসরের পত্রিকায় গল্প কবিতা লিখতো।
ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সংযোগপত্র।

নিজেকে বুননের টানাপোড়েনে টানাটানি সারাজীবনই চলেছে। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করার ক্ষেত্রেও তাই। ইংলিশ মিডিয়াম না বাংলা মাধ্যম এই নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। অবশেষে ২০০৬ এর ষোলো জানুয়ারি মেদিনীপুরের ভগবতী শিশু শিক্ষায়তনে ভর্তি করার জন্য ফর্ম তুললাম। জমা দিলাম ১৬ ফেব্রুয়ারি। অ্যাডমিশন টেস্ট হলো ২৪ জানুয়ারি। বাবা মাকেও ইন্টারভিউ দিতে হলো। ১৬ মার্চ সপ্তম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হলো। ভর্তি হলো নার্সারিতে। একেবারে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত একই ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করে। শুধু ক্লাস ফাইভ থেকে স্কুলের নামটা একটু বদলে হয়েছিল বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ বালিকা বিদ্যালয়।

মেয়ের শৈশব আর আমার পিএইচ.ডি.-র পড়াশোনা একই সঙ্গে চলতে লাগল। কর্মক্ষেত্র ও সংসার কেউ ছেড়ে কথা বলবে না। সারাদিন সব কাজ সমাধা করে বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে রাত একটায় পাশের ঘরে গিয়ে পড়াশোনায় এমনই মগ্ন থাকতাম যে চমকে উঠে আবিষ্কার করতাম মেয়ে কখন উঠে এসে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। এজন্য আমি সব সময় বলি আমার পিএইচ.ডি.-র গাইড দুজন। গবেষণা নির্দেশকের পরেই আমার কাজে সব থেকে বেশি সাহায্য করেছে আমার শিশুকন্যা। মাত্র একদিন-একদিনই রেগে গিয়ে একমুঠো বইয়ের পাতা ছিঁড়ে নেয়। তারপর নিজের ভুল বুঝে নিজেই সারাদিন কাঁদতে থাকে। আমার কোয়ার্টারের উপরেই থাকতেন দর্শনের অধ্যাপক শম্পাদি। তিনি জিজ্ঞেস করেন,’সালেহা কী হলো? তোমার মেয়ে তো এমনভাবে কাঁদে না’। ও ছোটো থেকেই খুব ম্যাচিওর। কোয়ার্টারে থাকতাম বটে কিন্তু কোনোদিন কলেজ থেকে কাজের মাঝখানে কোয়ার্টারে আসতাম না। আমাকে বলে রেখেছিল, “মামমাম তুমি আমাকে দুবার কাঁদাবে না। আমি দুবার টা টা করতে পারবো না”। নীলাঞ্জনাকে বলেছিল, “মাসি তোমাকে পেঙ্গুইনের একটি  মিথ্যেকার স্বপ্ন বলছি, শোনো। সেটি হলো  ওড়া”। আমরা দুই বন্ধু তো লার্ন-আনলার্ন এবং রিলার্নের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় তখন উড়েই বেড়াচ্ছি।

🍂

২০০৭ - এর মার্চে আমি নীলাঞ্জনা জুটি আবার ছুটলাম ভট্টর কলেজ, দাঁতন ও বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটিতে, যথাক্রমে  “ফোক কালচার অফ বেঙ্গলি পিপল রিসাইডিং অন বোথ সাইডস অফ রিভার সুবর্ণরেখা” এবং “অনুবাদ ও সাহিত্য” বিষয়ক আলোচনা চক্রে। দাঁতন কলেজে সেবার মনে আছে এঁচোড়ের তরকারি সেদ্ধ হওয়ার আগেই আমাদের খেতে হয় কেননা তাহলে রিসোর্স পার্সনদের সঙ্গে খুব সহজেই মেদিনীপুর ফিরতে পারবো। আগস্ট মাসে গেলাম রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়ে “উইমেন এণ্ড অ্যাপ্লায়েড এথিকস” শীর্ষক জাতীয় আলোচনা চক্রে। রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়ে তখন প্রায় প্রতি রবিবার ক্লাস নিতে গেছি। নেতাজী ওপেন ইউনিভার্সিটির বাংলা এম.এ.-র ক্লাস। অনেক সময়ই আমার থেকে বয়সে বড়োদের ক্লাসে পেয়েছি। এমনকি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দপ্তরে কাজ করেন এমন অফিসারও ক্লাস করেছেন। ২০০৭ এর জুলাই থেকে ২০১৬ পর্যন্ত রেগুলার ওখানে প্রায় দশ বছরের অধিককাল ক্লাস নিয়েছি। পরেও কয়েকবার গেছি। ওখানে অবশ্য টিচার নয় কাউন্সেলার নামেই সবাই পরিচিত।

মেদিনীপুর শহরে তার উপর কলেজ ক্যাম্পাসে থাকতাম বলে প্রায়ই অনেক বেশি কাজ করতে হয়েছে আমাকে। ইউনিভার্সিটি থেকে রাতের বেলাও পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। কলেজ ক্যাম্পাসের ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটির বিডিপি প্রোগ্রামেরও ক্লাস নিতাম। ২০০৬ এর জুলাই থেকে আমি ওখানকার কাউন্সেলার। ওখানে একবার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। আমি দরজা বন্ধ করে ক্লাস নিচ্ছি। আর বাইরে প্রহরায় পুলিশ। এমন সাধারণত হয় না। জানলাম আমার ক্লাসে আছেন এক জেলবন্দী আসামী। ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি পড়াশোনা করছেন। অন্যান্য কাউন্সেলাররা সংশোধনাগারে গিয়েই ক্লাস নিয়েছেন। কিন্তু আমার ক্লাসের জন্য স্টাডি সেন্টার এবং জেল কর্তৃপক্ষ এই ব্যবস্থা করেছেন। নানান অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হতে থাকে আমার এই ক্ষুদ্র জীবন।

আর এ জীবন কতজনের কাছে কতভাবে ঋণী সে আর কতটা বলতে পারছি? পিএইচ.ডি.- র পড়াশোনার জন্য অনেকটাই সময় বাঁচিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল ইতিহাসের অধ্যাপক দেবযানী ব্যানার্জি। যদু বংশীয় দেবযানী আগরপাড়া থেকে এসেছিল। কলকাতা মেদিনীপুর সপ্তাহান্তে যাতায়াত করতো। মেদিনীপুরের ছবিদির কাছে হোমসার্ভিসে লাঞ্চ ও ডিনার নিত। ওর সুপারিশে ছবিদি প্রায় কুড়িমাস হোমসার্ভিসে আমার পুরো পরিবারকে খাবার সরবরাহ করে। ২০০৭-২০০৮ পুরো দুবছর ছবিদির রান্নাই খেয়েছি। ২০০৮-এর ডিসেম্বরে থিসিস সাবমীট করে পুনরায় রান্নাবান্না চালু করি। সে সময় ছমাস ছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার বুক করতাম দেখে গ্যাস কোম্পানি থেকেও ফোন করে জানতে চাইতো ব্যাপারটা আসলে কী?
 নেতাজী ওপেন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সংযোগপত্র

ছোটো শিশুকে নিয়ে দেবযানীর বিয়েতে মেদিনীপুর থেকে আগরপাড়াতে গেছি ট্রেন বাস অতিক্রম করে। সাহাপুরের বাড়িতে ফিরেছি অনেক রাতে। বাউড়িয়া স্টেশন থেকে যে রিকশা ধরি সেই রিকশার চালক আকণ্ঠ মদ্যপান করেছিলেন। সালাউদ্দিন এবং কন্যা সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও এমন অবস্থা দেখে বাবা আমাকে প্রচুর বকাবকি করেন। কিন্তু দেবযানীর সাথে আমার বন্ধন এমনই ছিল যে ওর আহ্বান উপেক্ষা করার সাধ্য আমার ছিল না। আর রিকশাচালকদের অনেককে গভীরভাবে চিনতাম। ওঁরা বলতেন, ‘দিদি শরীরে খাদ্যাভাব; অতো বল নেই যে রিকশা টানব কিন্তু পেট চালাতে টানতেই হবে। তাই মদ খেয়ে ফুরফুরে মেজাজে রিকশা টানি। ভুলে যাই যে আমি শক্তিহীন।’ আমার এক বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্রের বাবা রিকশা চালাতেন। ছেলেটি তখনও আমার কলেজে পড়তে আসেনি। ওর বাবা আমাকে বলেন ছেলের উচ্চমাধ্যমিকের বইগুলি কিনে দিতে। এসব ক্ষেত্রে আমি সাধারণত মেয়ের বিয়ে বা বাড়ি বানাব এমন আবদারে কাউকে কাউকে প্রার্থী হতে দেখেছি। তাঁকে বই কেনার টাকা দিতে গেলাম। তিনি বললেন, ‘ না দিদি, উচ্চমাধ্যমিকে ওর এই এই বিষয় আছে আপনি নিজে হাতে বইগুলি কিনে দিন। আমি টাকা নেবো না’।

পড়াশোনা পরীক্ষা এই নিয়েই তো জীবন চলছে। শুধু সময়ের সাথে সাথে অবস্থান বদলে যায়। এতোদিন ইনভিজিলেশন ডিউটি দিয়ে এসেছি এবার ২০০৭ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ., বি.এসসি.ও বি.কম. পার্ট ওয়ানের পরীক্ষার সুপারভাইজার হলাম কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ড. সুধীর পাল মহাশয়ের সঙ্গে। গুরু যদি যথার্থ হন তাহলে শিষ্যের শেখার ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি থাকে না। পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া এই কাজে একশো শতাংশ সফল হই সুধীরবাবুর জন্য। তিনি আমাকে হাতে ধরে সব কাজ শিখিয়ে দেন। এমনকি স্টেপলারে পিন পরানো পর্যন্ত। তখন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থানায় থাকতো। মিলিয়ে চেক করে রেখে আসতে হতো আর প্রতিদিন সকালে দুবেলার পরীক্ষার প্রশ্ন আনতে যেতে হতো। জীবনে ঐ প্রথম থানায় যাই আর চারপাশের পরিবেশ দেখে সুধীরবাবুকে অনুরোধ করি স্যার আমি দুবেলার পরীক্ষা চালিয়ে দেবো,আপনি শুধু সকালে প্রশ্নের প্যাকেটটা থানা থেকে এনে দেবেন। ২০১০ এবং ২০১৪ তে পর্যায়ক্রমে দক্ষ হাতে একাজ সম্পন্ন করেছি পুনরায়।

পড়া পড়া আর পড়া, এখনও ঐ কাজটি ছাড়া অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে ভাবি পড়ার সময় নষ্ট হচ্ছে। ২০০৭ – এরই অক্টোবরে কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রে এক বছরের জন্য মেম্বার হলাম। গবেষণার কাজের একরাশ নথি নিয়ে এলাম। মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই যেতাম। কর্ণধার সন্দীপ দত্ত তখন মেয়েকে সামলাতেন আর আমি পড়াশোনা করতে থাকতাম। পরে মেয়ে বড়ো হতে রবীন্দ্রসদন চত্ত্বরে আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলায় তাঁর সঙ্গে পুনরায় দেখা করাই।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments