কানাকোভা আঞ্চলিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭৭
বিজন সাহা
কানাকোভা
কানাকোভা দুবনা থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট এক শহর যদিও নদী পথে এর দূরত্ব অনেক অনেক বেশি। আমাদের ভোলগা ভ্রমণের শুরুতেই গেছিলাম তভের। তভের ভোলগার তীরে প্রথম বড় শহর, প্রাদেশিক কেন্দ্র যেমন ইয়ারোস্লাভল, কাস্ত্রোমা, নিঝনি নভগোরাদ, চেবকসারি, কাজান, উলিয়ানভস্ক, সামারা, সারাতভ, ভোলগাগ্রাদ আর আস্ত্রাখান। এই তভের আর দুবনার মাঝে ভোলগার তীরে কানাকোভার অবস্থান। মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে হলেও মনে হয় ফেরি পার হতে হয় বলে কানাকোভার সাথে দুবনার যোগাযোগ তেমন বেশি নয় যতটা আছে প্রায় একই দূরত্বে অবস্থানকারী কিমরির সাথে। তাই দীর্ঘ দিন দুবনায় থাকলেও ওদিকে কখনই যাওয়া হয়নি। মনে আছে ২০১০ সালে একবার ওদিকে গিয়েছিলাম সাইকেলে করে দমকিনো উপসাগর পর্যন্ত কলিসেভের সাথে। খুব ভালো ফটোগ্রাফার ছিলেন এই পাশা বা পাভেল কলিসভ। অনেক কিছু শিখেছিলাম তাঁর কাছ থেকে। গেছিলাম এক অক্টোবর দিনে সোনালী শরতের ছবি তুলতে। তবে এছাড়াও বেশ কয়েক বার মস্কো কানাল পাড়ি দিয়ে ওদিকটায় গেছি ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতে, গ্রীষ্মে মাশরুম সংগ্রহে। একবার তো বনের ভেতর রাস্তা হারিয়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা। ওদিকে যাবার আরও সুযোগ ছিল গুলিয়ার এক বান্ধবী ইরিনার ওখানে। কানাকোভার পাশেই ওর গ্রামের বাড়ি। সামারে ও সেখানে থাকে। অনেক বার বলেছে যেতে। যাই হোক ফিরে আসি কানাকোভার কথায়।
ইভানকভস্কি রিজারভয়ার যা মস্কো সাগর নামে পরিচিত তার তীরে যেখানে দনখভকা নদী ভোলগায় পড়ছে সেখানে কানাকোভা অবস্থিত। এ ছাড়াও এখানে আছে আরেকটি নদী যার নাম সূচক। কানাকোভাকে শহর না বলে বর্ধিত জনপদ বলাই শ্রেয়। নির্মাণের সময় অনুযায়ী একে দুই ভাগে ভাগ করা যায় – নতুন শহর ও পুরানো শহর। ১৮০৯ সালে ফার্মাসিস্ট ফ্রিড্রিখ-ক্রিস্টিয়ান ব্রিন্নার দমকিনো গ্রামে মৃৎশিল্পের কারখানা স্থাপন করেন। কিন্তু অচিরের তিনি বুঝতে পারেন যে তাঁর পক্ষে এই ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়। তাই তিনি লিফল্যান্ডের ফার্মাসিস্ট আন্দ্রেই আয়েরবাখ ও মৃৎশিল্পী রেইনারের কাছে কারখানা বিক্রি করে দেন। পরবর্তীতে এই কারখানার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পণ্য বিক্রয়ের বিশেষত্বের কারণে উৎপাদন কেন্দ্র কুজনেৎসভা গ্রামে স্থানান্তরিত করা হয়। উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে দৈনন্দিন ব্যবহার্য ও শৈল্পিক মৃৎপাত্রের ব্যাপক উৎপাদনের জন্য কুজনেৎসভা বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। বিশেষজ্ঞ মহলে এই কারখানার মৃৎপাত্র ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে। ১৮৭০ সালে বনিক মাতভেই কুজনেৎসভ কারখানা কিনে নেন। অচিরেই এই কারখানা সমস্ত রাশিয়ায় পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু বিপ্লবের পরে একে জাতীয়করণ করা হয়। ১৯২৯ সালে কারখানার এক কর্মচারী ও প্রথম রুশ বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী প্রফিরেই পেত্রোভিচ কোনাকভের নামানুসারে কুজনেৎসভ গ্রামের নাম বদলিয়ে রাখা হয় কোনাকভা যার উচ্চারণ কানাকোভা। ১৯৩৭ সালে এই জনপদ শহরের মর্যাদা পায় এবং আট বছর আগে গঠিত কানাকোভা এলাকার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ইভানকভস্কি রিজারভয়ার বা মস্কো সাগর তৈরির ফলে আগের কেন্দ্র করচেভা আংশিক ভাবে জলমগ্ন হয় আর সেখানকার অধিবাসীদের স্থানান্তরিত করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২০০৭ সালের আগে পর্যন্ত শহরের নিজস্ব কোন পতাকা ও প্রতীক ছিল না। তখন এরা কানাকোভা অঞ্চলের প্রতীক ও পতাকা ব্যবহার করত। রাশিয়ার প্রায় প্রতিটি শহরেরই নিজস্ব প্রতীক ও পাতাকা আছে।
কানাকোভা মৎস্য খামারএদেশের প্রতিটি জনপদের মত এখানেও রয়েছে লাইব্রেরি, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, স্টেডিয়াম ইত্যাদি। এরমধ্যে সভ্রেমেন্নিক অপেক্ষাকৃত নতুন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আর ভোরভস্কি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ১৯৩০ এর দশকে তৈরি। কানাকোভার কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে প্রায়ই বিভিন্ন ধরণের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এছাড়াও শহরে রয়েছে আঞ্চলিক মিউজিয়াম যেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ ও নব্য লৌহ যুগের বিভিন্ন নমুনা প্রদর্শিত হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে আর্ট গ্যালারী যা এই অঞ্চলের সাথে ডেকাব্রিস্টদের সংযোগের কথা জানায়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ডেকাব্রিস্টরা ছিল উচ্চ বংশীয় লোক, যাদের অনেকেই তৎকালীন সম্রাট প্রথম আলেক্সান্দরের সহপাঠী। এক সময় রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে রুশ সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে এদের অনেককেই সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেই সময় বিপ্লব ব্যর্থ হলেও এরা রুশ দেশের পরবর্তী ঘটনাবলী ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করে। ডেকাব্রিস্ট ইয়াকুশিন ও তলস্তই ছিলেন এই এলাকার অধিবাসী। এছাড়াও এই মিউজিয়ামে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ের বিশেষ করে মস্কোর উপকণ্ঠে যুদ্ধের অনেক নিদর্শন। রয়েছে মস্কো-ভোলগা কানাল তৈরির অনেক ঐতিহাসিক দলিল, রয়েছে কুজনেৎসভ জনপদের কানাকোভা শহর হয়ে ওঠার ইতিহাস।
শত খানেক লোক নিয়ে জাহাজের যাত্রা শুরু হল বলশই ভোলগার ফেরিঘাট থেকে। আগে সেখানে স্তালিনের বিশাল স্ট্যাচু ছিল, এখন নেই। সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা এগিয়ে চললাম কানাকোভার দিকে। পথে পড়ল বিভিন্ন দ্বীপ আর জনপদ। যখন মস্কো সাগর নিয়ে লিখব সে কথা বলব। পরিষ্কার রৌদ্রাজ্বল আকাশ। সেখানে সাদা মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে। এটা ছিল ১৩ জুন ২০২১। মাঝে মাঝে কেউ বোটে করে মাছ মারছে। আমরা অপেক্ষা করছি যদি কোথাও গির্জার গম্বুজের দেখা মেলে। গুলিয়া আর আমি ছাড়াও সাথে ছিল তথাগত আর নীতা। মস্কো সাগরের বুক কেটে এগিয়ে যাচ্ছে জাহাজ। আমরা ছবি তুলছি। এক সময় আমরা এসে পৌঁছুলাম কানাকোভায়। সেখানে হয় দুবনার মত বাঁধানো ফেরিঘাট নেই, অথবা আমরা ইচ্ছে করেই এমন একটা জায়গায় নামলাম। জায়গাটা সরকারি আঞ্চলিক বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে খুব বেশি দূরে নয়। বিভিন্ন সময় আমার বিভিন্ন ছবিতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র ধরা পড়েছে, বিশেষ করে আমাদের আবাসিক বিল্ডিঙের ১৯ তলা থেকে নেয়া ছবিতে। কিন্তু আগে জানতাম না যে এটা কানাকোভার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেখানে আমাদের জন্য বাস অপেক্ষা করছিল। আমাদের নিয়ে যে জাহাজ এসেছিল সেটা এখানকার যাত্রীদের নিয়ে দুবনার দিকে চলে গেল। আমরা দুবনা ফিরব বাসে করে খেয়াপার পর্যন্ত। সেখান থেকে অবশ্য নিজেদের মত করেই বাসায় ফিরতে হবে।
বাসে করেই আমরা ঘুরে দেখলাম শহরের বিভিন্ন এলাকা। এর লাইব্রেরী, স্টেডিয়াম, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, সিনেমা হল ইত্যাদি। দেখলাম নতুন ও পুরানো শহর। ৪২ হাজার মানুষের বাসস্থান এই কানাকোভা দুবনার চেয়ে বেশ ছোট। তবে সব নতুন জায়গার নিজস্ব কিছু বিশেষত্ব থাকে। কানাকোভা ব্যতিক্রম নয়। শহর ঘুরিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল স্থানীয় মৎস্য খামারে। জানা ছিল না যে এখানে মাছের চাষ করা হয়। বিশেষ করে স্টার্জন। এখানে পোনা মাছ একটু বড় করে ভোলগায় ছেড়ে দেয়া হয়। কিছু কিছু মাছ এদের জীবনচক্র এখানেই শেষ করে মানে ওদের বড় করে এলাকায় বিক্রি করা হয়। তবে এটা আস্ত্রাখানে দেখা খামারের মত খোলা জলে নয়, ইনডোর খামারে। আমরা ঘুরে ঘুরে এসব দেখলাম। ছোট বড় বিভিন্ন রকমের মাছ। কেউ কেউ সেখানে মাছ, বিশেষ করে প্রসেস করা মাছ ইত্যাদি কিনল। স্টার্জন ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন ধরণের মাছ এখানে চাষ করা হয়। এখানে আমরা গেছিলাম ভোলগা ভ্রমণের আগে, তাই আস্ত্রাখান সম্পর্কে ধারণা ছিল না। এর আগে অবশ্য ক্রিমিয়ায় ট্রাউট মাছের খামার দেখেছি। এরপর আমরা গেলাম আঞ্চলিক জাদুঘরে। বেশ সমৃদ্ধ এই জাদুঘর। এ বিষয়ে অবশ্য ইতিমধ্যে লিখেছি। বিভিন্ন প্রাণীর কাকতাড়ুয়া দেখে বেশ লাগছিল। এছাড়া সেখানে ছিল স্থানীয় মৃৎপাত্রের শো রুম আর কয়েক প্রজন্ম আগে এখানকার লোকজনের জীবিকা অর্জনের বিভিন্ন হাতিয়ার। আমি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখছিলাম তাঁত। আমাদের গ্রাম এক সময় তাঁত শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। তাই এর প্রতি এক সহজাত আকর্ষণ আমার। গুলিয়া কী কী যেন কিনল। কয়েক ঘন্টা কানাকোভা ভ্রমণ শেষ সবাই ফিরে এলো বাসে। বাস এগিয়ে চলল দুবনার দিকে। পথে অনেক পরিচিত নাম। এক সময় যে বনে আমরা মাশরুম সংগ্রহ করি সেটাও দৃষ্টিগোচর হল। মিনিট চল্লিশের মধ্যে আমরা চলে এলাম খেয়াপারে। এটা মস্কো কানালে। সামারে কাজ করে। শীতে, যখন জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তখন এখানে থাকে পন্টুন সেতু। ফেরি পার হয়ে চলে এলাম দুবনায় ল্যাগুসাতি লেকে। সেখানে পুরানো বাতিঘর আজও দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা ট্যাক্সির। এখানে বাস খুব একটা আসে না।
ছবিতে কানাকোভা
0 Comments