চুয়াল্লিশতম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
সালের হিসাবে সময়টা বোধহয় উনিশশো
আটষট্টি,বাংলায় তেরোশো পঁচাত্তর।তখন তো প্রযুক্তির এতোখানি উন্নতি হয়নি, উন্নত সেচ ব্যবস্থা,নিকাশী নালা,নদী বাঁধ এসবের সুব্যবস্হা গ্রামবাংলার দূরান্তে এসে পৌঁছায় নি। তবে,স্বাধীনতার আগে স্হানীয়ভাবে কিছু জমিদার এবং ইংরেজ সরকারের দেওয়া বাঁধ এবং ফিরতি বাঁধের দৌলতে বন্যারোধ ও চাষবাসের ব্যবস্থা করা হোত। বিরজার বাবার বাড়ির দেশ দাসপুরের সেকেন্দারীর কাছে কিশোরপুরে তেমনই একটি বাঁধ ছিল। পঁচাত্তরের বন্যায় সে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।জলমগ্ন হয়ে পড়ে অনেকখানি এলাকা। চাষের জমি,গবাদিপশু সহ জনজীবন ভীষণ ভাবে বিপর্যস্ত হয়।তবে সে ক্ষয় তাঁদের গ্রামীন এলাকায় ভয়াবহ হয়নি। জৈবনিক কিছু সমস্যা,যেমন পাট পচে যাওয়া,ফসলক্ষেতে জল জমে আনাজপাতির দাম বেড়ে যাওয়া,প্রায় চারদিন ভয়ে ভয়ে বাঁধে রাত কাটানোর পরে জল নামলে বাড়িতে ফিরে এসে ক্ষত নিরাময়…ইত্যাদি ক্ষতি সামলাতে না সামলাতেই এসেছিল সাতাত্তর সালের বন্যা,যার কথা মনে পড়লে এখনও অনেকের বুক কেঁপে ওঠে আতঙ্কে। গ্রামের পরে গ্রামে প্লাবন, মাসাধিককাল ধরে সে জল জমে থাকা,জলবাহিত অসুখ,খেতে না পেয়ে মৃত্যু,মহামারীর রূপ নিয়েছিল যেন।
🍂
আসলে,সেবারে ঘোগ পড়েছিল মহেশপুরে;ঘোগ মানে বাঁধের দূর্বল অংশ দিয়ে জলের প্রবেশ ও প্লাবণ। মহেশপুর বাড়ির খুব কাছেই, সকাল থেকেই নদীজল বাড়ার গতিপ্রকৃতি দেখে ছোটবৌদিদি তার ছোট ছেলেদুটিকে নিয়ে খানিক দূরে কেশাপাটের তালঠ্যা গ্রামের বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছিল।মেজবৌদিদিকে হাওড়ায় তার মেয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। বড়োদাদা-মেজদাদা বিরজাকেও মেদিনীপুরে চলে যেতে বলেছিলেন, তিনিই দাদাদের ছেড়ে যেতে রাজি হননি।ছোটদাদার বড়ো ছেলেটিও থেকে গিয়েছিল তাঁদের সঙ্গে ভাগ্যিস।তা না হ’লে, সেই সেবার গভীর রাতের দুর্যোগের মধ্যে যখন প্রবল জলস্রোতে ভেসে যাচ্ছিল সারা পাড়া, নিবিড় অন্ধকারে একের পর এক বাড়ি ভেঙে পড়ার শব্দ,প্রতিবেশীর আর্তনাদের অসহায়তার মধ্যে কে তাঁদের ভরসা দিত!
এখনও মনে পড়ে,ভয়াবহ সে রাতের কথা।সন্ধ্যে থেকেই এদিকে ওদিকে খবর আসছিল,নদী ষোলোপণ ছাপিয়েছে। মেদিনীপুর পেরিয়ে কাঁসাই নদী,অপরাপর অন্যান্য নদীর মতোই তার অন্তিম যাত্রাপথে ভেঙে ভেঙে এগোয়,এলাকায় কাঁকি তে-মোহানীর বাঁকে সেভাবেই সে দুভাগ হয়ে একভাগ শিলাই সঙ্গমে,অন্যটি খুখুড়দহ ছুঁয়ে জশাঢ় পেরিয়ে রূপনারায়ণের দিকে গিয়েছে।বছর কয়েক আগে ভেঙেছিল কিশোরপুরে বাঁধ,সেবারে নাকি ক্ষত তৈরি হয়েছে ঘর-দুয়ার মহেশপুরে,বিপদ একেবারে হাতের নাগালে। অগত্যা বড়োদের শেখানো পথেই গরু বাছুরগুলিকে সময়মতো বাঁধের নিরাপদ জমির আগলে রাখা জায়গার খুঁটিতে বেঁধে, ত্রিপল টাঙিয়ে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে,খামারের দরজায় ভালো করে প্লাষ্টিকের চট মুড়িয়ে,ঘর দুয়ারে চাবিচাবলা দিয়ে, চাল-ডাল-সওদাপত্র যথাসম্ভব ওপরের দিকে তুলে,তুলসী তলায় সন্ধ্যা প্রদীপ দেখিয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে বেরিয়ে এসেছিলেন। জল ততক্ষণে গ্রামে ঢুকতে শুরু করেছে,হাল্কা হাল্কা ঢেউ, সঙ্গে বেনো বাতাস। সেই হাঁটু ডোবা কাদাজল পেরিয়ে বাঁধে উঠে দেখেছিলেন, আশেপাশে আরও প্রতিবেশী মানুষজনের জটলা। সবাই নিজের মতো আশ্রয় গড়েছে, টিমটিমে লন্ঠনের আলোয় কুটিকাটি জ্বেলে রান্নার আয়োজন করছে; কিছুতেই হার না মানা সেই চিরায়ত জীবনসংগ্রাম!
বৃষ্টি ধোওয়া শরতের আকাশে তখন অনেকগুলি তারা ফুটেছে, আশপাশের ঝোপে অসংখ্য ঝিঁ ঝিঁর ডাক।দূর থেকে আরও দূরে সেই অনির্দেশ্য অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বিরজার মনে মানুষের জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির ক্রমবিবর্তনের এক অদ্ভুত সাম্যের কথা ভেসে উঠেছিল।খানিক নিরাসক্ত,খানিক উদাসী মনে অস্থায়ী ত্রিপল ঘেরা ছাউনীতে ঢুকে অবশ্য সে নিরাচারী মনখারাপের লালন সম্ভব হয়নি।
কারণ?ঐ যে! জীবন সংগ্রাম! সাধারণ মানুষের সময় কোথায় এসব ভাবতরঙ্গে অবগাহনের!দিন আনি দিন খাই যাপনের সংশয় দ্বিধায় যে তার জীবন জন্মাবধি দীর্ণ।তাই,ছাউনির আড়ালে ঢুকেই যখন দেখেছিলেন, অসুস্থ বড়ো দাদা তাঁর অপেক্ষায়, তিনি অন্য কিছু না ভেবেই টিন থেকে খানিক মুড়ি আর খোলায় ভাজা বাদাম বাটিতে ভরে সামনে ধরলেন।বোধহয় খুব ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছিল, সেই কখন দুটি ডালভাত খেয়েছিলেন,তারপর থেকে তো বাঁধ পাহারায় ছিলেন, কিচ্ছু খাওয়াও হয়নি ঘন ঘন চা খেতে চাওয়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বৃদ্ধ মানুষটির। বড়ো মায়া হলো বিরজার।বৌদিদি তো অকালেই খেলা ফেলে ফেলে গিয়েছেন, বড়ো দাদা তারপর থেকেই খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন। নিজের সামান্য প্রয়োজনটুকুও বলেননা কাউকে।
কি আর করা যাবে! ভবিতব্য! খানিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিরজা জনতা জ্বেলে চা বসিয়েছিলেন। কেরোসিনের গন্ধ পেয়ে পাশের ছাউনি থেকে মেজ খুড়ি হেঁকেছিলেন,
-’বিরজা এলি নাকি লো!তোর সব গুছানো হয়ে গেল?’
-’ঐ মোটামুটি। তোমাদের?’
-’কি জানি!দেখছিনা তো কাউকে!আবাগীর বেটি কোন জমালয়ে গেছে কে জানে!’
পাশের বাড়ির দুস্হ পরিবারটির একমাত্র ছেলে গত বর্ষায় সাপকাটি হয়ে মারা গেছে। বুড়ো শাশুড়িকে নিয়ে বড়ো আতান্তরে পড়া কমবয়সী বিধবার সংসার প্রায় চলেনা। আসার সময় দেখেছিলেন নিরুপায় মেয়েটি একে ওকে ধরে সামান্য ঘর গেরস্থালি গুছিয়ে টেনে আনছে। পয়সা দিয়ে লোক লাগাবার সামর্থ্য নেই, অন্যের দয়ায় ভরসা,তাই দেরি। এদিকে বুড়ো শাশুড়ির পেট তো তা মানছেনা,হয়তো সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি,তাই গালাগালি।
বড়ো মায়া হলো,কাছে ডেকে দুটি মুড়ি দিয়ে অল্প চা দিলেন। খুব সামান্য উপকরণ,তবু গোগ্রাসে গেলা দেখে মনে হলো, মানুষ এখনো ক্ষিদের কাছে কতো অসহায়…
যাহোক, পরের প্রায় দুই মাস সেভাবেই চলেছিল সংসার।দিনের বেলায় রান্না বান্না সেরে জল ঠেঙিয়ে ঘরে যেতে হতো।সব দেখে শুনে আসা,বিশ্রী গরম, চারিদিকে জমা জল পচে ওঠা দুর্গন্ধ,পানীয় জলের অভাব,খাদ্যের অভাব। তারই মধ্যে ডিঙি ঠেলে পার্টির লোকেদের মুড়ি-চিঁড়ে-হাতে গড়া রুটী বিতরণ,সরকার থেকে হেলিকপ্টারে করে শুকনো খাবার ও জলের প্যাকেট ফেলার কথাও মনে আছে। অনেক নেইয়ের মাঝেও যা মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল বেশ।
0 Comments