বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৪৭
অশোক
ভাস্করব্রত পতি
'ওরে গৃহবাসী খোল্ দ্বার খোল্, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥
রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে,
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত আকাশে,
নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্'॥ --- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কথিত রয়েছে, অশোক গাছের তলায় দেবী গৌরী তপস্যা করে সিদ্ধমনোরথ এবং বিগতশোক হয়েছিলেন। তাই 'অশোক' নামকরণ হয়েছিল। লঙ্কাধিপতি রাবণ সীতাকে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রেখেছিলেন অশোকবনে। এখানেই হনুমান প্রথম সীতাদেবীর সাথে দেখা করেছিলেন।
'তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্যে রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে,
তোমার ঝাউয়ের দোলে
মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান'।
অশোক গাছের পাতা
হিন্দুদের প্রেমের দেবতা কামদেবের সাথেও যুক্ত অশোকের নাম। তিনি তাঁর তরকারিতে পাঁচটি ফুলের মধ্যে একটি ফুল হিসেবে অশোক গাছের ফুলকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। যা প্রলোভনসঙ্কুল সম্মোহনের প্রতিনিধিত্ব করে। অশোক গাছের নিচের যক্ষীর অবস্থান হিন্দু ভারতীয় ভাস্কর্যের একটি অন্যতম উপাদান। কারও কারও মতে, এই গাছের পাদদেশে থাকা যুবতীটি আসলে উর্বরতার সাথে সম্পর্কিত। সিদ্ধার্থ নেপালের লুম্বিনীর এক অশোক গাছের নিচে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই ভারত নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় এই অশোক গাছকে পবিত্র বৃক্ষ হিসেবে বিবেচিত করা হয়।
ভারতীয় এয়োস্ত্রীরা আজও চৈত্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে অশোক ষষ্ঠী এবং শুক্লা অষ্টমীতে অর্থাৎ বাসন্তী অষ্টমীতে অশোক অষ্টমী পালন করে। এইসব ব্রতের নিয়ম অনুসারে ব্রতকারিণীরা কাঁচা দুধের সাথে অশোক ফুলের কুঁড়ি খেয়ে থাকেন। কথিত আছে বন্ধ্যা অশোক গাছে যুবতী নারী লাথি মারলে গাছে ফুল ফোটে। তেমনি রাঙা যুবতী সুন্দরী সৌরভযুক্ত মদের কুলকুচি করে বকুল গাছে ফেললে ফুল ফুটবে। “পদাঘাতাদশোকং বিকশতি বকুলং যৌষিতামাস্য মদ্যৈঃ”।
গাছ জুড়ে ফুটে আছে অশোক ফুল
মূলতঃ দক্ষিণ ভারতের গাছ এটি। যদিও এই পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন এলাকায় মোটামুটি দেখা যায়। বেশিরভাগ মন্দির এলাকায় এই গাছের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। আসলে এটি বিবেচিত পবিত্র বৃক্ষ হিসেবেই। চৈত্র মাসে অশোক গাছের পূজা করা হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রথা। মোটামুটি ২৫ - ৩০ হাত উঁচু বৃক্ষ জাতীয় গাছ এটি। ছোট ছোট পাতা। পাতার অর্থভাগ সরু ঘন হয়। ৩ - ৯ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য। গাছটি ভীষণভাবে ভেষজ জাতীয়। অশোক গাছের ফুল ওড়িশার রাজ্য ফুল হিসেবে পরিগণিত। বসন্তকালে তথা ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত অশোক ফুল ফোটে। কাজী নজরুল ইসলাম বসন্তের বর্ণনায় এনেছেন অশোককে --
'বসন্ত মুখর আজি।
দক্ষিণ সমীরণে মর্মর গুঞ্জনে
বনে বনে বিহ্বল বাণী ওঠে বাজি।।
অকারণ ভাষা তার ঝর ঝর ঝরে
মুহু মুহু কুহু কুহু পিয়া পিয়া স্বরে,
পলাশ বকুলে অশোক শিমুলে
সাজানো তাহার কল কথার সাজি'।।
সংস্কৃতে অশোককে বলে অশোক, কাঙ্কেলি, গুজরাটীতে অশোপলভ এবং কোঙ্কনীতে আসুনকার। ইংরেজিতে বলে Yellow Ashok এবং Yellow Saraca। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Jonesia asoca Roxb এবং Saraca indica sensu Richard Henry Beddome। এটি Fabaceae পরিবারের অন্তর্গত। অশোকের অন্যান্য যেসব প্রজাতির সন্ধান মেলে, সেগুলি হল --
Jonesia confusa Hassk.
Jonesia pinnata Willd.
Saraca confusa (Hassk.) Backer
Saraca asoca
Saraca thaipingensis (এই ফুলের রঙ হলুদ)
এছাড়া এই গাছ অন্য যেসব নামে পরিচিত তা হল – পল্লবদ্রুম, কেলিক, রক্তপল্লব, অঞ্জনাপ্রিয়া, শোকনাশ, বিশোক, অপশোক, কঙ্গেলি, কর্ণপূরক, দোষহারী, নট, পল্লবদ্রুপ, প্রপল্লব, সিটা, রক্তপল্লবক, রাগীতরু, সুভগ, স্মরাধিবাস, বঞ্জুলদ্রুম, চিত্র, বিচিত্র, পিণ্ডিপুষ্পা, মধুপুষ্প, হেমাপুষ্প, হিমাপুষ্পা, হেমপুষ্প, ব্যাণ্ডুলা ইত্যাদি। রাজ অশোক এবং স্বর্ণ অশোক নামে দুই ধরনের অশোক গাছ দেখা যায় বিভিন্ন এলাকায়।
'কিশোর হৃদয় পুটে
অশোক রঙিন ফোটে
কপোল রাঙিয়া ওঠে
অতনুর অনুরাগে'।।
----- কাজী নজরুল ইসলাম
অশোক ফুল গাছের কাণ্ড থেকে ফুটতে দেখা যায়। কবিগুরু লিখেছেন --
'ফিরিব বাতাস বেয়ে রামধনু খুঁজি,
আলোর অশোক ফুল চুলে দেবো গুঁজি।
সাত সাগরের পারে পারিজাত বনে
জল দিতে চ’লে যাবো আপনার মনে'।
অশোকের ফুলগুলি আকারে বেশ ছোট, তবে বহুপৌষ্পিক। ছাতার মতো। এর মঞ্জরি বড় আকারের হয়।
'আনে হাসি, আনে গান,
আনে রে নূতন প্রাণ,
সঙ্গে করে আনে রবিকর--
অশোক শিশুর প্রায়
এত হাসে এত গায়
কাঁদিতে দেয় না অবসর'। -- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অজস্র অশোক ফুলের সমাহারে এই অশোকমঞ্জরি কিন্তু মৃদু গন্ধযুক্ত। বেশ লম্বা পরাগকেশর দেখা যায়। কমলা রঙের ফুলগুলি দেখতেও বেশ আকর্ষণীয়। তবে ফুল বাসি হয়ে গেলে রক্তবর্ণ ধারণ করে। কাজী নজরুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন --
'আগুন রাঙা ফুলে ফাগুন লাগে লাল,
কৃষ্ণচূড়ার পাশে অশোক গালে গাল।
আকুল করে ডাকি বকুল বনের পাখি,
যমুনার জল লাল হ’ল আজ আবির,
ফাগের রঙে ভরি'।।
অথর্ববেদে পাই— 'রুচং জনয়ন্তঃ দেবা অগ্রে তদব্রুবন / শোনং অশোকঃ যত্ত্বেবং তৃষ্ণাং অরুণদ দিব্যা বসন্ ম ইষাণ'। সুশ্রুতের প্রসিদ্ধ টীকাকার ডম্বন লিখেছেন— 'অশোকঃ শীতলশ্চাশঃ ক্রিমীন হস্তি প্রয়োজিতঃ' অর্থাৎ এই অশোক শীতবীর্য। কিন্তু এর বীর্য ও প্রভাব দূর করে অর্শ ও ক্রিমি রোগ। অশোক গাছের ফুল, পাতা, বীজ, ছাল এবং শিকড় ভেষজ ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি মহিলাদের পিরিয়ড চলাকালীন ব্যথা নিরাময় করে। এছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটের কৃমি এবং রক্ত আমাশয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উপযোগী। মুখের ব্রণ সারাতে সহায়তা করে। শ্বাসকষ্ট থেকেও মুক্তি দেয়। শরীরের মধ্যেকার রক্তপাত, ক্ষত এবং ডায়াবেটিসের সমস্যায় ১-৩ গ্রাম অশোক ফুল দিয়ে বানানো চা বেশ কার্যকরী। বর্তমানে গাছটি একটি সংকটাপন্ন উদ্ভিদ (আই ইউ সি এন ২.৩) হিসেবে বিবেচিত।
অশোক ফুল
বাংলা সাহিত্যেও অশোক গাছের দেখা মেলে বিভিন্ন গানে এবং কবিতায়। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন --
'হোরির রঙ লাগে আজি গোপিনীর তনু মনে।
অনুরাগে রাঙা গোরীর বিধু বদনে॥
ফাগের লালী আনিল কে,
কাজল কালো চোখে
কামনা আবির ঝরে রাঙা নয়নে॥
অশোক রঙন ফুলের আভা জাগে ডালিম ফুলী গালে,
নাচিছে হৃদয় আজি রসিয়ার নাচের তালে।।
তাম্বুলীরাঙা ঠোঁটে ফাগুনের ভাষা ফোটে,
তার প্রাণের খুশির রং লেগেছে রাঙা বসনে'॥
নজরুল ইসলামের আরও অন্যান্য লেখাতেও মেলে অশোকের বর্ণনা। তিনি লিখেছেন --
'অঙ্গের ছন্দে পলাশ – মাধবী অশোক ফোটে,
নূপুর শুনি’ বনতুলসীর মঞ্জরী উলসিয়া ওঠে।মেঘ–বিজড়িত রাঙা গোধূলি
নামিয়া এলো বুঝি পথ ভুলি,
তাহার অঙ্গ তরঙ্গে, বিভঙ্গে কুলে কুলে নদী জল উথলায়'।।
আরেকটি লেখায় তিনি এনেছেন অশোককে --
'শ্যামল তনুতে হরিত কুঞ্জে
অশোক ফুটেছে যেন পুঞ্জে পুঞ্জে
রঙ-পিয়াসি মন ভ্রমর গুঞ্জে
ঢালো আরো ঢালো রঙ প্রেম যমুনাতে'।।
আবার, নজরুলের আরেকটি লেখায় পাই --
'রাঙা জবার বায়না ধরে আমার কালো মেয়ে কাঁদে
সে তারার মালা সরিয়ে ফেলে এলোকেশ নাহি বাঁধে॥পলাশ অশোক কৃষ্ণচূড়ায়, রাগ করে সে পায়ে গুঁড়ায়
সে কাঁদে দুহাত দিয়ে ঢেকে যুগল আঁখি সূর্য চাঁদে'॥
কবিগুরুর গানেও অশোকের দ্যুতিময় উপস্থিতি নজরকাড়া --
'দখিন হাওয়া হেঁকে বেড়ায় "জাগো জাগো',
দোয়েল কোয়েল গানের বিরাম জানো না গো,
রক্তরঙের জাগল প্রলাপ অশোক গাছে'।।
🍂
0 Comments