জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /সাতচল্লিশতম পর্ব /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় 
সাতচল্লিশতম পর্ব 
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী 


আজকাল যে কি হয়েছে, নানা অবান্তর স্মৃতি মনের আয়নায় ভেসে ওঠে।আসলে,জীবনভ’র তো শুধু দৌড়েই গেছেন,এ ঘাট থেকে ওঘাটে; চাওয়া পাওয়ার হিসেব না করেই।তবু তারই মধ্যে কিছু কিছু স্মৃতির উদ্ভাসে বিরজার সদাসুখী মনের ময়ুর তাথৈ আনন্দে নেচে ওঠে,নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জাগে। আবার যখন মনেমনে মেঘ ঘনায়, বিচ্ছেদ ব্যথা কাঁটার মতো বুকে বাজে,সব ছেড়ে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে পরিযায়ী বালিহাঁসের দলে।
অনেক দিন পরে, বৃষ্টির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে ঝকঝকে সূর্য উঠেছিল। শরীরটা বেশ ভালো লাগছিল, দাওয়ার রোদে স্মৃতির ঝিলমিল।
নতুন বৌটি পাশে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল,এটা ওটা বলছিল,সব শুনতে বা বুঝতে পারছিল না তাঁর মস্তিষ্ক। কিন্তু তিনি লক্ষ করছিলেন মেয়েটা খানিক রোগা হয়ে গেছে,বেশবাসেও পারিপাট্যের অভাব।
ইদানিং চেতনা খানিক ফিরে এসেছে, অতীত স্মৃতি থেকে মন ফিরছে বর্তমানে। টের পান,বাড়িতে নতুন শিশুর কান্না, রান্নার ছ্যাঁকছোঁক,পুকুরপাড় থেকে উঠে আসা পাঁকের গন্ধ,ঘরময় ওষুধ আর অসুখের বিরক্তিকর দৌরাত্ম্য।উঠতে পারেন না, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন,বাইরে সদাচঞ্চল তাঁর এত্তোদিনের নখদর্পণে থাকা প্রিয় সংসার,তাঁকে ছাড়াই বেশ চলছে। কোথায় যেন পড়েছিলেন, প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করেনা।একের দায়িত্ব অন্যে বর্তায়, মহাকাল হাসেন,আলো আসে। 
সে আলোর ভেলায় ভেসে যায় স্মৃতির সাম্পান।
মনে পড়ে,সেবছরকার শীতকালের কথা।চাষবাড়ি থেকে ধান আসার দিনগুলিতে ভোর থেকেই উঠতে হতো।
অল্প অল্প হিমেল হাওয়ায় চামড়ায় টানটান ভাব,শরীর জুড়ে শিরশিরানি,ভোরবেলার ঘাসের মুখে টলটলে শিশিরকণা।জ্যাঠাইমার কাল পেরিয়ে সংসারের কতৃত্ব তখন বিরজার হাতে। বড়ো দাদা ক্রমশই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন,মেজদাদা-বৌদিদি চেষ্টা করেও সংসারের ছন্দ ফেরাতে পারছেন না, ছোট দাদার বড়ো ছেলেটি সরকারি চাকরি পেলেও মাইনেপত্র তখনও তেমন ভালো না।ছোট দাদা চাকুরিতে অবসর নিয়ে বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছে। এদিকে দু-দুটি বন্যার ভার বহন করে বাড়ির গোলদারী সওদা দোকানটিও প্রায় জরাজীর্ণ,এককালে এলাকার সবাইকার মোটামুটি সব চাহিদা মেটানো দোকানটির তখন প্রায় যায় যায় অবস্থা।বলতে গেলে,পরিস্থিতির চাপে পরিবারটি তখন আপন কৌলিন্য হারিয়ে মাত্রই কৃষিজীবি সাধারণ মধ্যবিত্ত হয়ে পড়েছে।
তো সেদিন সকাল থেকেই বাঁধের রাস্তা ধরে সারি সারি গরুর গাড়ি করে ধান এসে পৌঁছেছিল বাড়ির দাওয়ায়।গাদা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল, তদারকি করছিলেন মেজদাদা,বিরজা ব্যস্ত ছিলেন মুটে মজুরদের খাবার তৈরির ব্যবস্হাপনায়। হাঁড়িতে ভাত ফুটছে,জাল দেওয়া হয়েছে পুকুরে। ছোটবৌদিদি-মেজবৌদিদি মাছ কোটায় ব্যস্ত। হঠাৎ দাওয়ায় বসা বড়ো দাদার ভীষণ কাশি উঠলো…শুকনো ভয়ানক কাশি,কাশতে কাশতে প্রায় দম আটকে পড়ার জোগাড়।

🍂

সব কাজ ফেলে পিঠে বুকে গরম তেল ডলে,গরম জল খাইয়ে তাকে খানিক ধাতস্থ করে রান্নাশালায় ঢুকতে যাবেন, দেখেন কোথা থেকে এক কালো হুলো ঝুড়িতে রাখা মাছ মুখে নিয়ে পালাচ্ছে।হুটহাট করতে করতেই সে কোথায় পগার পার…
কালো বেড়ালের স্মৃতি কালান্তক,তাঁর জীবনের সবচাইতে বড়ো অঘটনটির সঙ্গে কাকতালীয় ভাবে তা জড়িয়ে; এতোদিন পরে আবার তাকে দেখে বুক কাঁপবে, এটাই স্বাভাবিক।
তবু মন মানিয়ে কাউকে কিচ্ছুটি না বলে রান্না শেষ করে খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে যখন ঘরে এলেন, সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। ঘরের পাশেই বুড়িমায়ের থান;সেখানে দীপ দেখিয়ে কায়মনোবাক্যে সংসারের মঙ্গল চেয়ে যখন ঘরে ঢুকতে যাবেন, আবার সেই হুলো!
তাঁকে দেখেই কোথায় যে বনবাদাড়ে লুকোল,খুঁজেও পেলেন না।তবে মনটা কুডাক ছাড়লো না,মনে মনে যেন  জানতেন কিছু অনিষ্ট হতে চলেছে।হলোও তাই।
মাত্র দুমাসের ভেতরেই বড়ো দাদার চলে যাওয়া…সৌম্য মানুষটি ঘুমের ভেতরেই পাড়ি জমান কাঙ্ক্ষিত ধামে।
তবে সে তো ছিল স্বাভাবিক মৃত্যু। জীবনের সব ভোগ তৃপ্ত করে তিনি গেলেন। কিন্তু ছোট দাদা?
 সদা উচ্ছল একটি প্রাণ, সেই সদ্য রিটায়ার্ড করে বাড়িতে সুখভোগের জন্য এসে, হঠাৎ করে করোনারী থ্রম্বোসিসের শিকার হয়ে পরপারে পাড়ি জমান। প্রায় সমবয়সী ছিলেন তাঁরা, একসঙ্গে খেলা,গল্প,বড়ো হওয়া…
জীবনভ’র আরও বাকি সব বিচ্ছেদ বেদনার চাইতে এ ব্যথা যে কি নিদারুন যন্ত্রনায় তাঁকে বিদ্ধ করেছিল,তা কহতব্য নয়। এমনকি,এ আঘাত মেজদাদাকেও এতোখানি আঘাত করেছিল যে,কয়েকমাসের মধ্যে তিনিও আর রইলেন না।
সময়টা নব্বইয়ের দশক।একটি মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবার তাদের তিনটি কর্তাকে হঠাৎ হারিয়ে প্রায় অভিভাবকহীন হয়ে পড়ায় যে বিষাদঘন মানসিক বৈকল্যের সম্মুখীন হয়েছিল, নতুন কোন মানুষের আগমন ছাড়া তা থেকে  মুক্তি নেই বুঝেই বিরজা ছোট দাদার মেজ ছেলেটির বিবাহের প্রস্তাব আনেন।
এবং তা যে কতোখানি সঠিক ছিল, নতুন বৌটি এবাড়িতে আসা ইস্তক তা সত্যি বলে মেনে নিয়েছিল সবাই।ওর চলন-বলন, উচ্ছল হাসি, পায়ের নূপুরের রিনিঝিনি হঠাৎ করে চেপে বসা বিষাদ ভার সরাবার জন্য ভীষণ জরুরী ছিল।
আদতে মেয়েটি তো উপলক্ষ্য মাত্র, মানুষ আত্মগত ভাবে তো আনন্দের পিয়াসী। বেদনার অভিঘাত তাকে যতখানিই বা ভঙ্গুর করুক,সে আবার ফিরে আসতে চায় জীবনের বর্ণিল স্রোতে। এবং সেই কারনেই শহুরে মেয়েটির প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে চক্রবর্তী পরিবার আবার আগের মতো স্বচ্ছতোয়া হয়, ঋত্বিক না হয়েও তার কৃতিত্বে যে তাঁরও কিছু ভূমিকা রইলো,এটি মনে রেখে বড়ো মধুর এক হাসি খেলে গেল রোগিনীর মুখে।

Post a Comment

0 Comments