গল্প ধারাবাহিক
টানেল রহস্য পর্ব ১
বাসুদেব গুপ্ত
ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে সারাদিন। এক হাত দূরেও কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। সেই ঝাপসা হয়ে যাওয়া রাস্তার ধারে এক অস্পষ্ট পাঁচিল। ইঁদুরের মত কয়েকটি জীব কোথা থেকে এসে জড় হয়। একটা একটা করে পাঁচিলের ইঁটগুলো খুলতে থাকে। একটা গর্ত হয়। তার মধ্যে তিনটি ছায়া নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে। একটা সরু আলো জ্বলে নেভে। পায়ের শব্দ হয় না, আবছা ছায়া পড়ে। ইঁটগুলো গাঁথা হয় আবার। ঘুমে আচ্ছন্ন দারোয়ান কিছুই জানতে পারে না।
গেট খোলার মৃদু শব্দ, চারটে ছায়া ফিরে যায়। অন্ধকারের ভিতর অন্ধকার হয়ে মিশে যায়। যেতে যেতে একটা ছায়া চোখ থেকে জল সরাতে সরাতে বলে,
‘তোমরা কারা, আমাকে উদ্ধার করলে কেন?’
এই ঘটনার একমাস আগে। স্থান মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস। বাংলার এক প্রান্তিক শহর। পাহাড় জংগল ও খনি ও সেখানে বিচরণ করা মানুষের রঙ সবই যেখানে নিকষ কালো।
গমগমে কোর্ট রুম। সবে মাত্র মিলর্ড আসন গ্রহণ করেছেন। আলতো করে গম্ভীর চশমাটা মুছে চোখে দিয়ে তিনি কাঠগড়ার দিকে তাকালেন। মূল সাক্ষী বিমলচন্দ্র পাল, পোলিং অফিসার। ৩৮ বছর বয়স। নবান্নে এসিস্ট্যান্ট সেকশান অফিসার। ডিউটি করতে এসে এমন ফেঁসে যাবে ভাবতে পারেনি। ভাবলেও আর কি করা। আসতেই হতো। সরকার বাহাদুর বলে কথা। একপাশে বসে আছে খাঁকি ইউনিফর্ম পরা তার জিপ ড্রাইভার, শ্রীকুমার বিশ্বাস। তাকে দেখে মনে হয় না সে কোনদিন কথা বলতে পারবে, এমনি আতঙ্ক জমাট তার চোখে মুখে।
🍂
প্রসিকিউটর বিস্তার মিশ্রা। উঠে দাঁড়ান, আঙ্গুল তোলেন ও প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন ওর দিকে। তার সারমর্ম হোলো,
‘বিমলবাবু, সরকারী অফিসার হিসেবে আপনার বিরুদ্ধে ইভিএম পাচারের গুরুতর অভিযোগ। আপনার ওপর দায়িত্ব ছিল জনগণের পবিত্র মতামতকে যথাসম্ভব চেষ্টা করে আগলে রাখার। কিন্তু আপনি তা পারেন নি বা ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা করেছেন। আপনি জবানবন্দী দিয়েছেন যে অজানা কিছু লোক হঠাত আক্রমণ করে ই ভি এম কেড়ে নিয়ে চলে যায়। বিমলবাবু, আপনি কি মহামান্য আদালতকে বলবেন, সেদিন ঠিক কি হয়েছিল?’
বিমল একটু ঘাবড়ে যায়, বোঝা যায় ভয়ে ওর জিভ শুকিয়ে এসেছে। একটু খুক খুক করে গলা পরিষ্কার করে। তারপর বলে,
‘স্যার। আমরা তো বাক্সগুলো নিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ তো ঝড় বৃষ্টি এসে গেল, এত জোরে যে সামনে কিছু দেখাই যাচ্ছিল না। গাড়ীটাতো একটা গাছে ধাক্কা মারতে মারতে বেঁচে যায়। সামনে ঐ বাড়ীটা পেয়ে যেতে আমরা তো দৌড়ে গিয়ে শেল্টার নিয়েছিলাম । ‘
‘তো তো না করে বলুন, আপনার কোন ভয় নেই।’ আদালত মুচকি হেসে অভয় দিতে বিমল আবার শুরু করে।
‘আমরা কি করে জানব ওখানে কি গোলমাল আছে। গভীর রাত। ঘুম আসছিল না, আর ইভিএমগুলো নজরেও রাখতে হবে। হঠাৎ মেঝে থেকে গুমগুম করে একটা অদ্ভুত আওয়াজ উঠে এল।’
‘গুমগুম না দুমদুম? ঠিক করে বলুন’
বিমল একটু থামে এদিক ওদিক তাকায়, ঢোঁক গেলে তারপর বলে,
‘দুমদুমই হবে স্যার। তারপর নিজের চক্ষে দেখলাম মেঝেটা ফাঁক হয়ে গেল, আর সেখান থেকে ইঁদুরের মত পিলপিল করে উঠে এল চারজন লোক। ‘
‘তারা কি মানুষের সাইজের না ইঁদুরের সাইজের?’
বিচারক বিশদভাবে জানতে চাইলে, একটা চাপা হাসির হুল্লোড় পড়ে যায়। অর্ডার অর্ডার বলে ম্যাজিস্ট্রট সাহেবকে থামাতে হয়। বিমল আরো ঘাবড়ে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
‘ভূত দেখেননি সিওর তো?’ মিলরডের আবার প্রশ্ন।
পুলিশ অফিসার তার হয়ে উত্তর দিতে যান,
‘ভূত দেখার কোন খবর বা অভিযোগ আমরা পাই নি মিলর্ড।’
এই কেসটা মিডিয়ার নানা মহলে খুব চর্চায় রয়েছে কয়েকদিন। মোটামুটি সব নামকরা টিভি চ্যানেলেও এই গল্পটা খাচ্ছে লোকে।
তদন্তকারী পুলিশ অফিসার মহিলা, নাম সুরমা মিশ্র। মহিলা হলেও তাকে সবাই ভয় পায়, জটিল কেস সল্ভ করার তাঁর খুব সুনাম আছে।
তাকে ডাকা হয় ঘটনার বর্ণনা দিতে। তিনি তাঁর বয়ানে বলেন,
‘মিলরড, তদন্তে এখন পর্যন্ত যা উঠে এসেছে তা হল, বিমলবাবু ও তার একজন সঙ্গী ভোট নিতে গিয়েছিলেন গভীর জংগলে মাদারি নামে গ্রামে । ছোট্ট গাঁ, মাত্র দশ পনের ঘর আদিবাসীর বাস। কিন্তু নির্বাচনী আইন বলছে, যে কোন নাগরিকের ৫ কিমির ভিতর ভোট দেবার ব্যবস্থা থাকতেই হবে। ভোট কর্মী কেউ তো সাধ করে হয় না, বিমল ও তার চালক শ্রীকুমার বিশ্বাসও হয় নি। নির্বিঘ্নে ভোট হবার পরে ইভিএম সিল করে ফেরার পথে হঠাৎ পাহাড় থেকে মেঘ এসে লাফ দেয় জঙ্গলে, যাকে বলে ক্লাউড বারস্ট। প্রচন্ড শিলাবৃষ্টি ও বাজ পড়া শুরু হয়, ওদের ঝরঝরে জিপ গাড়ী একটা বিরাট শাল গাছের পড়ে থাকা ডালে গিয়ে ধাক্কা মারতে মারতে বেঁচে যায়, দুটো টায়ার ফ্ল্যাট। ফলে ওখান থেকে বার হবার চেষ্টা করতেই পারেন নি।
ভাগ্যক্রমে ঠিক পাশেই দেখা যায় একটা রেস্ট হাউস, সেখানে আলোও জ্বলছে টিমটিম করে। গাড়ীর জোর আওয়াজ শুনে সেই বাড়ী থেকে হঠাৎ এক বুড়ো দারোয়ান আবির্ভূত হয় ।
পরের দিন সকালেও যখন দুজনের কোন খবর নেই, তখন আমাদের কাছে মেসেজ আসে, তিনজন কন্সটেবলের সার্চ পারটি বেরোয়। তারা খুঁজতে খুঁজতে আবিষ্কার করে, দুজন লোক হাত পা মুখ বাঁধা এক কোণে পড়ে আছে। বস্তার মত কেউ তাদের ফেলে রেখে গেছে। ই ভি এমের কোন পাত্তা নেই ত্রিসীমানায়। ‘
‘তাহলে আপনার আসল অভিযোগটা কি?’
‘ আমাদের সন্দেহ এই দুজন কোনভাবে এই ই ভি এম চুরির ব্যাপারে যুক্ত। পুরো ব্যাপারটাই সাজানো। অনেক জেরা করে, ভয় দেখিয়েও ওরা ঠিকঠাক সহযোগিতা করছেন না। উল্টোপাল্টা ইঁদুর এখনো কিছু বার করা যায় নি।‘
লম্বা বক্তব্য শেষ করে বসে পড়েন পিপি বিস্তার মিশ্রা।
মিলর্ড কিছু একটা নোট করে হাতে কলম ধরেই প্রশ্ন করেন,
‘তো সেই ইঁদুরের মত মানুষগুলো মেঝে থেকে উঠে এসে কি করলো?’
একেবারে হাউহাউ করে ওঠে বিমল।
‘আমরা কিছুই জানি না স্যার। লোকগুলো মেঝে থেকে উঠেই, আমাদের সামনে ছুরি আর বন্দুক দেখালো, তারপর হাতপা মুখ ভালো করে বেঁধে ই ভি এম নিয়ে চলে গেল। আমাদের এতে কি দোষ?
মিশ্রাজি উঠে দাঁড়িয়ে প্রবল আপত্তি জানান,
‘মিলর্ড, এদের চালচলন আমাদের ভালো লাগছে না, আমার মনে হয় উগ্রপন্থীদের সঙ্গে এদের যোগাযোগ আছে আর নাটক করছে। ‘
‘কোন প্রমাণ পেয়েছেন? শুধু সন্দেহের বশে আপনারা তো সরকারী কর্মচারীদের আটকে রাখতে পারেন না।‘ প্রবীণ বিচারক সহজে বিচলিত হন না। তাঁর খ্যাতি তিনি সবসময় আইনী ভাষাই বলেন।
‘এখনো পাই নি। কিন্তু মেঝেয় কোন গর্ত খোঁড়ার কোন চিহ্নও পাওয়া যায় নি। সব কি উবে গেল মন্ত্রবলে ? আর যারা এসেছিল তারা কি ভূত না ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা? কোন পায়ের ছাপ নেই কোথাও? মিলর্ড, আরো কয়েকদিন জিজ্ঞাসাবাদ করতে আমাদের হেফাজতে চাই তিনদিন।‘ প্রসিকিউটার চালু কায়দাটাই অবলম্বন করেন। কোন প্রমাণ না থাকলে আবার হেফাজত। কিছু না কিছু তো পেট থেকে বেরোবেই।
-ক্রমশঃ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments