জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোক গল্প— ২১৯(দক্ষিণ আফ্রিকা)হিপোরা কেন মাছ খায় না /চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 
দূর দেশের লোক গল্প— ২১৯
(দক্ষিণ আফ্রিকা)
হিপোরা কেন মাছ খায় না
চিন্ময় দাশ

[ জলে বাস করে, কিন্তু মাছ খায় না। এমনই অদ্ভুত জীবন হিপো বা জলহস্তিদের। জলে থেকেও হিপোরা কেন মাছ খায় না—তাই নিয়েই আজকের গল্প। ] 
আফ্রিকা-- চার দিকে সাগরে ঘেরা একটা দেশ। সে দেশের একেবারে দক্ষিণে ‘সান’ জাতির শিকারজীবি মানুষদের বসবাস। জানা যায়, ২০ হাজারেরও বেশি বছর আগে থেকে তাঁরা সেখানে বাস করে আছেন। 
আমাদের আজকের গল্প, এই সান মানুষেরা আসবার আরও অনেক অনেক কাল আগের কথা। তখন কেবল নানা জাতির পশু আর পাখিরা এসেছে পৃথিবীতে। মানুষ বলে কোনও জীব ছিল না তখন। 
সেসময় বিধাতা পুরুষ নিজেও বাস করতেন পশু-পাখিদের সাথে। নিজের সৃষ্টি তো। সকলের সুখ সুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখতেন তিনি। 
সেই সময়কালে আফ্রিকার দক্ষিণের এলাকায় বাতাস ছিল ভারি গরম। বেলা যত বাড়তে থাকে, বাতাস যেন আগুনের হলকার মতো বইতে থাকে। মাটি এতো তেতে ওঠে যে, পা ফেলাই দায় হয়ে ওঠে।
অথচ বেশির ভাগ প্রাণীর বাস ছিল স্থল্ভূমি এলাকায়। জলে বাস ছিল সামান্য কয়েজনের। বনের জীবদের চামড়া কিছু মোটা। রোদের তাত মোটামুটি সহ্য করে নেয় তারা।
কিন্তু সমস্যা হয়েছে একটা যুবক হিপো (জলহস্তি)র। হিপোদের চেহারা দেখতেই যা বড়। গায়ের চামড়া কিন্তু তাদের বেশ পাতলা। গরম বাতাসে চামড়া পুড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে হিপোটার। আরও সমস্যা হোল, এখন তার বাড়ার বয়স। যত দিন যাচ্ছে, শরীর বড় হচ্ছে তার। তাতে চামড়া যত টানটান হচ্ছে, পাতলাও হচ্ছে তার সাথে তাল মিলিয়ে। 
একসময় অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, বাইরে বেরোন দায় হয়ে উঠল হিপোর। এদিকে পেটে টান পড়লে, না বেরিয়েও উপায় থাকে না। রোদের তাতে গায়ের চামড়া শুকিয়ে কুঁকড়ে যেতে লাগল।
সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল যখন, সোজা বিধাতার কাছে গিয়ে হাজির হোল হিপো। বিধাতা জানতে চাইলেন— কী বাপু? কিছু অসুবিধা হয়েছে?
হিপো তার যন্ত্রণার কথা সব খুলে বলল বিধাতাকে। তিনি বললেন—সব তো বুঝলাম, বাপু। কিন্তু রোদের তাত কমিয়ে দিই, সে ক্ষমতা তো আমার নাই। 
হিপো বলল—আমি অন্য একটা আবেদন নিয়ে এসেছি, ঠাকুর। সেটা কিন্তু তুমি সহজেই করে দিতে পারো।
--তাহলে, বল শুনি। কী আবেদন তোমার।
হিপো কাতর গলায় বলল—ডাঙায় আর টিকতে পারছি না। তুমি কেবল আমাকে জলে থাকবার অনুমতিটা দাও। 
--সে না হয় দিলাম। আপত্তি করবার কী আছে এতে? কিন্তু…
--অসুবিধা যখন নাই, তা হলে আবার কিন্তু-টিন্তু কেন?
--জলে বাস করতে চাইছো, যাও। তবে, জলে নামবার আগে, সেখানে যারা বাস করে, তাদের অনুমতিটা নিয়ে নিতে হবে তোমাকে। তাদের যদি আপত্তি থাকে, জোর করে তোমাকে সেখানে পাঠানো ঠিক হবে না। 
শুনে হিপো ভারি খুশি—ওহ, এই কথা। সে আমি ঠিক পেয়ে যাবো। কেউ আপত্তি করবে না। 
বনের পাশেই একটা বড় নদী। খানিক দূর গিয়ে সাগরে পড়েছে নদীটা। হিপো গিয়ে নদীর পাড়ে হাজির হয়েছে। জলে কুমীর, ভোঁদড়, মেছো ঈগলদের বাস। হিপো বলল—বন্ধুরা, তোমাদের সাথে জলে থাকব বলে এলাম। তোমাদের নিশ্চয়ই কোন আপত্তি হবে না, একজন নতুন পড়শিকে পেয়ে।
কুমীর, ঈগল পিছন পড়ে রইল। ভোঁদড় এগিয়ে এসেছে—কেন, কেন? হঠাৎ ডাঙা ছেড়ে, জলে বাস করবার সাধ হোল কেন? সেটা আগে শুনি।
এদিক ঘুরিয়ে ওদিক ঘুরিয়ে, নিজের শরীর দেখাল হিপো। বলল—গরমে মারা পড়ে যাচ্ছি গো। দয়া করে তোমরা মাথা নেড়ে দাও। আমিও জলে নেমে পড়ি।
--রোসো, রোসো। এত ব্যস্ত হলে কী আর চলে? কুমীর আর ঈগল কী বলবে, আমি জানি না। আমার কিন্তু এক্টুও মত নেই, তুমি এসে জলে বাস করো?
অবস্থা সুবিধার নয় দেখে, হিপো ঘাবড়ে গেছে। এত বড় নদী। সামনে বিশাল সমুদ্র। ক’টা আর প্রাণীর বাস এখানে। নিশ্চয় তারও জায়গা হয়ে যাবে—এই আশা নিয়ে সে এসেছে এখানে। সে কাতর হয়ে বলল—কেন, বন্ধু? তোমার আপত্তি কীসের? 
--শোন, বাপু। আমি পষ্ট কথার লোক। এরা সামনে আছে। তবুও খোলাখুলিই বলি কথাটা। ভোঁদড় বলল—এই যে দুজন থাকে এখানে, কুমির আর ঈগল, এরা মস্ত বড় শিকারি। এদের কাছে আমি একেবারে একটা পুঁচকে জীব। পেট ভরাতে বেশ মেহনত করতে হয় আমাকে। ছোট-বড় সব মাছই তো এই রাক্ষস দুটোর পেটে যায়। তার উপর আজ আবার তুমি এসেছ, এদের সাথে জুটবার ধান্দা নিয়ে। কী করে হ্যাঁ বলি আমি? 
হিপোর মনে এবার একটু আশার সঞ্চার হোল—এই কথা? আমি তো মাছই খাবো না। তোমার তাহলে কীসের ভয়?
কুমীর বা ঈগল চুপ করে আছে। কিছুই বলছে না। আসলে, ভোঁদড় তাদের শক্তিমান মেনেছে, এটা শুনেই বেশ গুমোর তাদের মনে। চুপ করে দুজনের আলোচনা শুনে যাচ্ছে মন দিয়ে।
হিপোর কথা শুনে, ভোঁদড় বলল—মাছ খাবো না, বললেই হোল? তবে কি বাতাস খেয়ে পেট ভরাবে তুমি?
--বাতাস খেতে যাবো কেন গো? হিপো হেসে বলল— আমি তো মাছ খাইই না। ভোঁদড় ভায়া, তোমার তো যাতায়াত আছে ডাঙাতেও। কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখো, আমি কী খাই?
--কী খাও তুমি তাহলে?
--আরে, বন্ধু। আমি তো ঘাস খাই।
--বললেই হোল? ভোঁদড় বলল—অতো বড় চেহারা তোমার। সেটা বুঝি ঘাস খেয়ে হয়েছে? এ কথা বিশ্বাস করতে হবে আমাকে? বোকা পেয়েছ না কি?
হিপো বলল—দুনিয়ায় সব চেয়ে বড় চেহারা কার? হাতির। খোঁজ রাখো না, হাতি কখনও কারও মাংস খেয়েছে কোনদিন? হাতি ঘাস খায়, পাতা খায়। আমিও তাই। ঘাস পাতা ছাড়া কিছুই মুখে তুলি না। 
ভোঁদড় বলে উঠল—তাহলে তুমি জলে থাকবে কী করে? ঘাস বলো, বা পাতা-- এখানে তো কিছুই পাবে না তুমি।
--তা কেন? নদীর জলেও তো কত রকমের ঘাস থাকে। তাই খেয়েই থেকে যেতে পারব।
--দ্যাখো বাপু, বোকা বানাবার চেষ্টা কোর না আমাকে। অতটা বোকা আমি নয়। জালার মত পেট তোমার। হাঁ করলে তো মনে হয়, গোটা আকাশটাই গিলে ফেলবে এক্ষুনি। 

🍂

ভোঁদড়কে থামিয়ে দিয়ে, হিপো বলল-- হাঁ বড় হলেই কি আর মাছ খায় কেউ?
ভোঁদড় সে কথার দিকে গেল না। বলল—আর, তোমার ঐ দাঁত ক’খানা? দেখেই ভয়ে পেট গুড়গুড় করছে। দাঁত তো নয়, মূলো এক একখানা। ওগুলো তোমাকে ঘাস খাওয়ার জন্য দিয়েছে বিধাতা? 
কথায় কথা বেড়ে যাচ্ছে। জলে থাকবার সম্মতিটা পাওয়া হচ্ছে না। হিপো বলল—তাহলে একটা উপায় বলি, যাতে আমার কথা বিশ্বাস হয় তোমাদের।
--বলো, কী কথা।
প্রতিদিন সকালে আমি হাঁ করে দেখাবো তোমাদের। তোমরা খুঁজে দেখবে, মাছের একটা আঁশ, কিংবা মাছের কাঁটার একটা টুকরোও, আমার দাঁতের ফাঁকে খুঁজে পাও কি না। 
কথাটা মন্দ বলেনি। কুমিরের বেশ মনে ধরেছে কথাটা। সে বলল—এটা অবশ্য ভালো কথা বলেছ। কিন্তু ভায়া, যদি দেখা যায়? তখন কী হবে? 
--কী আবার হবে? দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে আমাকে। ডাঙার জীব, ডাঙায় ফিরে যেতে হবে আমাকে। কুমির বেশ সন্তুষ্ট। সে ঈগলকে বলল—তা ঈগল ভায়া, তোমার কী মত, সেটা শুনি আমরা। 
ঈগল বলল—আমার প্রথম থেকেই কোন আপত্তি নাই। থাকুক না, এসেছে যখন। 
কিন্তু ভোঁদড়ের ভয় যাচ্ছে না। বলেই ফেলল-- খাওয়া দাওয়া শেষ করে, ভালো করে মুখ ধুয়ে ফেললে তুমি। তখন আর আঁশ বা মাছের কাঁটার টুকরো কী করে পাওয়া যাবে? 
হিপো বলল—ঠিক আছে। এবার একটা উপায় বলছি। সকালে নিজের গোবর আমি নিজের লেজ দিয়ে ছিটিয়ে, চারদিকে ছড়িয়ে দেব। যদি মাছ খাই, আঁশ বা কাঁটার টুকরো যা অজীর্ণ থেকে যাবে, পরিষ্কার দেখা যাবে সেগুলো। যেদিনই দেখতে পাবে, সেদিনই জল ছেড়ে উঠে যাব আমি। এবার তো হোল।
হ্যাঁ, ফয়শলা হয়ে গেল। এর চেয়ে বড় পরীক্ষা বা অকাট্য প্রমাণ কিচ্ছু হতে পারে না। সবাই রাজি হয়ে গেল। হিপোও জলে নেমে পড়ল টুক করে। 
সেই থেকেই হিপোরা জলের অধিবাসী হয়ে গেছে। হিপোরা মাছ খায় না। জলজ ঘাস-পাতাই কেবল খায় হিপোরা।
আর হ্যাঁ। হিপো তার পরীক্ষা দেওয়ার কথা ভুলে যায়নি। তোমরা যারা এ গল্প পড়বে, খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো। হিপোরা যেখানে বাস করে, নিয়মিত আকাশে মুখ তুলে, বিশাল হাঁ খানা মেলে ধরে। যেন বলে—দেখে যাও, আমি কিন্তু মাছ খাইনি। এমনকি, দ্বিতীয় কথাটাও সে রেখেছে। হিপো একমাত্র জীব, যারা নিজের গোবর নিজের লেজ দিয়ে চারদিকে ছিটিয়ে দেয়। 
আসলে, নিজের কথা রক্ষার জন্য নিয়মিত পরীক্ষা দিয়ে যায় হিপোরা। আর সেজন্যই, বিধাতা পুরুষ নিজেও তাঁর এই সন্তানটির ওপর কোন দিন বিরূপ হন না। তোমরাও কেউ যেন গোবর ছিটানোর জন্য, হিপোর অপরাধ নিও না কখনও।

Post a Comment

0 Comments