বানপ্রস্থের বাঁশি : প্রকৃতির কথা
গৌরহরি বেরা
কবি সালেহা খাতুনের ‘বানপ্রস্থের বাঁশি’(২০২৫) কাব্যগ্রন্থটি খুবই উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থটি ‘জ্বলদর্চি’ থেকে প্রকাশিত। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে সালাউদ্দিনকে। এই গ্রন্থটিতে মোট ৬০টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘ভাতের স্বপ্ন’ এবং শেষ কবিতা ‘ব্যঞ্জনা’।
আধুনিক বাংলা কবিতায় এক উল্লেখযোগ্য কবি সালেহা খাতুন। এক সংবেদনশীল, অনুভূতি পরায়ণ মন নিয়ে তিনি তাঁর কবিতাগুলো লিখেছেন। তাঁর কবিতায় যেমন প্রকৃতির কথা রয়েছে তেমনি সমসাময়িক মানুষের জীবনে বহুমুখী বৈচিত্র্য ও সুখ-দুঃখের কথাও রয়েছে। সমাজের নানা সমস্যার কথা ব্যক্ত করলেও কবি সালেহা খাতুনের কবিতায় অসাধারণ পরিবেশ ভাবনা রয়েছে। তাঁর কবিতায় যেন প্রকৃতির সুরের আভাস আপন মগ্নতা নিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ‘বানপ্রস্থের বাঁশি’ কবিতায় কবি বলেছেন- “দারুচিনি দ্বীপ দূর বহুদূর / বানপ্রস্থের বাঁশির সুর / ঘর কেড়েছে তার / গহনদ্বারে হৃদয় দিয়েছে পেতে।” এখানে সেই প্রকৃতির আভাস লক্ষ করা যায়। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় দারুচিনি দ্বীপের প্রসঙ্গ রয়েছে – “হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা / সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর।” ‘বানপ্রস্থের বাঁশি’ কবিতায় ডিমনা লেকের কথা, হেনরি আইল্যাণ্ডের জঙ্গলের কথা, পথের বাঁকের কথা, জঙ্গল ঘেরা দ্বীপের কথা, দারুচিনি দ্বীপের কথা প্রভৃতি প্রকৃতির কথা এই কবিতায় স্থান পেয়েছে।
‘ডিসেম্বরের দিনগুলি’ কবিতায় কবি ডিসেম্বর মাসের শীতের বাজার, পিকনিক, গ্রাম ও নগরের কথা ব্যক্ত করেছেন। এই কবিতায় কবি সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কথাও তুলে ধরেছেন – “মঞ্চে নয় মাটিতে থাকেন যাঁরা / দিনরাত এক করে মঞ্চ বাঁধেন তাঁরা।” ‘করুণা’ কবিতায় ভোরের শীতের কথা ব্যক্ত হয়েছে। কবিতায় কবি বলেছেন – “ভোরে দেখি চেয়ার আঁকড়ে গলির মুখে / শীতের কামড়ে জড়োসড়ো বসে থাকেন।” এই কবিতায় কবি বলেছেন প্রকৃতির কোলে বড় হয়ে ওঠা সাধারণ মানুষই আমাদেরকে সাহস দেন। এই ‘করুণা’ কবিতায় রয়েছে রাতের লোকাল ট্রেনে মহিলা কামরায় প্রহরারত পুলিশের কথা। যাঁদের দেখে আমরা শান্ত থাকি আর তাঁদের করুণায় নিশ্চিন্ত থাকি।
‘হেমন্তের কিসস্যা' কবিতায় কবি প্রকৃতির যেন অন্য সুর দিয়েছেন। কবিতায় বলেছেন – “সাঁই সাঁই শব্দে রুদ্ধ করে শ্বাস / হেমন্ত বাতাসে মিশিয়ে আতসবাজি।” শরৎ ও শীতের মাঝখানে যে হেমন্ত ঋতু আসে সেই হেমন্ত ঋতুর বাতাসে উৎসবের আতসবাজি মিশে ভারী হয়ে গেছে আবহাওয়া। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে যাঁদের তাঁরা ব্যবহার করছেন ট্রান্সহেলার্স।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান' কবিতায় “হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক।” এই ভাবনা একটু অন্যভাবে কবি সালেহা খাতুনের কবিতায় ধরা পড়েছে। তিনি এখানে পোস্টম্যানের দিনে দিনে শক্তি হ্রাস পাওয়ার কথা বলছেন, যার ফলে সে অরণ্যে যেতে পারছে না।
‘গল্প হলেও সত্যি’ কবিতায় কবি মুগের শুঁটি, খেসারির শুঁটি, শীতের রোদ, কুহেলিকা আচ্ছন্ন, কলাপাতায় মোড়া এক গ্রাম্য মাণিক্য প্রভৃতির কথা ব্যক্ত করেছেন। ‘ইছামতী তোমাকে’ কবিতাটি আরম্ভ হয়েছে –
“বসন্তকে ডেকেছি বারে বারে / ফিরল না, হাত ছাড়িয়ে নিল সে।” অর্থাৎ সুসময়কে কবি এখানে বসন্তের প্রতীকে বারবার ডাকছেন, অথচ বসন্ত আর ধরা দিচ্ছে না। হেমন্তের বাতাসে বিষ মিশে রয়েছে। এই কবিতায় তির তির করে ইছামতী বইছে। গোধূলি লগনে ইছামতীর রূপ শান্ত নিরিবিলি, একেবারে নিশ্চুপ। অবশ্য কবি ইছামতীকে দ্ব্যর্থ অর্থে এখানে ব্যবহার করেছেন। নদী এবং একটি পত্রিকা এখানে একাকার হয়ে গেছে।
আসলে কবির প্রকৃতির প্রতি নিবিড় অনুভব রয়েছে। প্রকৃতির রূপ বর্ণনা, প্রকৃতির প্রেম তার কাছে অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে কবির নিবিড় একাত্মতা গড়ে উঠেছে।
কাব্যগ্রন্থ – বানপ্রস্থের বাঁশি
কবি – সালেহা খাতুন।
প্রকাশক – জ্বলদর্চি।
প্রচ্ছদ – শুভ্রাংশু শেখর আচার্য্য।
প্রথম প্রকাশ – ১৫.৪.২০২৫।
উৎসর্গ – সালাউদ্দিনকে।
মূল্য – ২৫০ টাকা।
🍂
0 Comments