প্রাঙ্গনে মোর শিরীষ শাখায়
তিপান্নতম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
‘পিসিমা! ও পিসিমা! কোথায় গেলে গো? আমি এয়েচি’
একগাদা হাঁড়ি কলসী নিয়ে বাইর দাওয়ায় এসে বসলে হারান মাঝি।ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো খেজুর রসের সুঘ্রাণ।
নৌকা বাওয়া ছাড়াও বছরের এইসময়টায় ওরা খেজুর রস সংগ্রহ করে। শাঁখ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে খেজুর গাছের মাথায় নতুন পাতা গজানোর ঠিক তলায় কাস্তে দিয়ে চৌকো মতো পাটি কেটে নতুন মাটির হাঁড়ি বাঁধা হয়।যত হিম পড়ে, টুপটুপ রস জমে হাঁড়িতে;হালকা হলুদাভ,সুগন্ধী, মিষ্টি রস।ভোরের বেলা হাঁড়ি নামিয়ে কিছু টাটকা সেই রস বিক্রি হয় পথচলতি মানুষজনেদের মধ্যে,বাকি সব বিশেষ কৌশলে জ্বাল দিয়ে তৈরী হয় গুড়।
শহরে মানুষ,আগে কখনও খাওয়া হয়নি খেজুর রস। সেকথা শুনে আগের বছর বাবুর বাবা সবাইকে লুকিয়ে ওকে খাইয়েছিল,আহা!কি স্বাদ! এবছরও যদি…
ভাবতে ভাবতে অহনা চায়ের জল আরও খানিক বাড়িয়ে নিল।
এবাড়ির নিয়ম সকালের চা টা সবাই একসঙ্গে খায়,মজুর-মুনিস-স্বজন-বন্ধু যেই আসুন, সবাই এর ভাগ পান।এর টানেই অনেকে প্রয়োজনে বা বিনা প্রয়োজনেই সকালবেলা এবাড়িতে হাজির হয়,শত কাজের ঝামেলার মধ্যেও বড়ো জা স্বামীর এই ইচ্ছেটিকে সম্মান দেন।
ব্যপারটা বেশ ভালো লাগে অহনার। প্রথম প্রথম সাহায্য না করতে পারলেও এখন এসব গার্হস্থ্য কাজেকর্মে সে দিদিভাইয়ের সঙ্গে থাকে,সকালের চা তৈরি ও দেওয়ার দায়িত্ব হাসিমুখেই নিয়েছে।
রান্নাঘর থেকেই হাঁক দিল দিদিভাই,
-’চা হয়েই এলো,বোস হারান দাদা’
-’জানি মা লক্ষ্মী!হড়বাড়িতে এসে না কিছু মুখে দিয়ে যে যাওয়ার জো নেই,এ তল্লাটে সক্কলে জানে। ভালো হোক, আরও ভালো হোক তোমাদের।বলছো যখন বসেই যাই, এই ঠান্ডায় এককাপ গরম চা পেলে…
তা পিসিমা কোথায় গো বৌমা!এবছর দালান নিতে আমি একটু দেরি করেই এলুম।শুনছি পিসিমা এখন আবার হাঁটাচলা করতে পেরেছেন, দেখা করি,কথা কয়ে যাই দুদন্ড।উনি আমার যে উবগার করেছেন,জন্মেও ভুলবোনা।’
🍂
দুহাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করতে করতেই পিসিমা বেরিয়ে এলেন,
-’হারান যে রে!কেমন আছিস?’
-’ভালো আছি মা জননী! আপনি যে আবার নিজের মতো হয়ে গেছেন,তায় খুব ভাল্লাগছে গো। আগেরবার দেখে গেছিলুম…’
-’সবই অদেষ্ট বাবা! ওপরওয়ালা যা লিখেছেন কপালে…’
-’না মা। ভালো থাকো আরও অনেক দিন। তোমরা ভালো না থাকলে আমাদের মতো গরীবগুর্বোদের কে দেখবে গো’
বলতে বলতেই ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলে হারাণমাঝি, সেই যাকে পিসিমা নৌকা কিনে সব্জী বওয়ার পরামর্শ ও অর্থ দিয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে চা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।কেটলি থেকে কাপে ঢেলে সবাইকৈ দিতে দিতে অহনা দেখলে আরও কয়েকজন প্রতিবেশী এসেছেন চায়ের টানে।আসলে, গ্রামেগঞ্জে তখনও সবার ঘরে চা তৈরীর রেওয়াজ ছিল না।তাই সকালবেলা অনেকেই এ বাড়িতে চলে আসেন,’হড়বাড়ির চা আজ কপালে ছিল’...
এক সেকেন্ড!এক সেকেন্ড!
বিয়ে হওয়া ইস্তক বহুবার শোনা এই ‘হড়বাড়ি’কথাটা হঠাৎ ভীষণ ভাবে কানে বাজলো অহনার!
ওনাদের টাইটেল তো চক্রবর্তী,পাড়ার আরও জ্ঞাতিবাড়ির টাইটেলে তাই,শুধু এনাদের বাড়িতেই কেন সবাই হড়বাড়ি বলে?এর পেছনেও কি কোন গল্প আছে!
গতকালের শোনা কথাগুলি তখনও অনুরণন তুলছিল মননে,চা দিতে এসে নীচু গলায় বললেন পিসিমাকে,
-’এ বাড়িকে সবাই হড়বাড়ি বলে কেন? এনাদের পদবী তো..’
-’ঐ যে তোকে কাল বললুম, চক্রবর্তী বাড়ির পাঁচ ভাইয়ের কথা। তাদের বংশই তো ডালায় পালায় বেড়ে জ্ঞাতি গুষ্টি তৈরি করেছে রে।’
-’তা নাহয় হোল, কিন্তু হড়!’
-’আমাদের পূর্ব পুরুষটিই ছিলেন সেই দত্তকপুত্র,যিনি জন্মসূত্রে আসলেই ‘হড়’।’
-’তাই!’
সকালবেলার উজ্জ্বল রোদচ্ছটাতেও সন্ধ্যার বিষাদ মাখা গলায় বললেন অগ্রজা,
-’থাক না। আইনিভাবে না হলেও লোকমুখে অন্তত বেঁচে থাক পদবীটুকু। আমরা কাউকে তাই বারণ করিনা।’
অতঃপর সকালের ব্যস্ততা শেষ হলে দুপুরের রোদে পিঠ দেওয়া আলসবেলায় অহনা শুনেছিল আরও বংশলতিকা:
পঞ্চপুত্রের গর্বিত জননী ছেলেদের কল্যাণ ও সুরক্ষা প্রার্থনায় কালীপূজা ও কূলদেবী জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন মহাসমারোহে। আশেপাশের লোকজনের স্বজন-বান্ধবসহ হাঁড়িবন্ধের নিমন্ত্রণ থাকতো পুজো বাড়িতে,সকাল-বিকেল পাত পড়তো অজস্র।সংসারের শ্রীবৃদ্ধিও হয়েছিল ঢের। প্রজন্ম এগোয় ঝাড়ে-বংশে,প্রথমে সম্পত্তি এজমালি থাকলেও পরে তা ভাগাভাগি হয়ে যায়। এরমধ্যেই কোন এক জ্ঞাতিপুত্র নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দেবোত্তর করে বাসন্তীদেবীকে কন্যারূপে গ্রহণ করে চৈত্র মাসে পূজার আয়োজন করেন,অছি হিসেবে থেকে যান অপরাপর জ্ঞাতিরা। সেই থেকে চক্রবর্তী পরিবারের অংশ হয়ে যান দেবী;শুনতে শুনতে মনে পড়ে যাচ্ছিল কবিগুরুর লেখা,
“দেবতারে যাহা দিতে পারি,তাই দিই প্রিয়জনে
আর পাবো কোথা?দেবতারে প্রিয় করি,প্রিয়েরে দেবতা”
সত্যিই,কি বিপুল এই দেশ,এর অন্দরে কন্দরে কতো কতো ছোট বড়ো গ্রাম-গঞ্জ-শহর। তাদের নিজস্ব কতো রূপকথা,কতো দুঃখসুখের গল্প প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে লেখা হয় অজানা কলমে, ইতিহাস মনে রাখে না।তারা ভরা মায়াময় আকাশ,কলস্বরা নদী,পুকুরপাড়ের তাল-নারকেল-সুপুরীর সারি,অস্তরাগে রক্তিম দিগন্তরেখা,ধানক্ষেতে সবুজের ঢেউ, ধ্যানমগ্ন বক,পুকুর জলে ঝাঁকে ঝাঁকে দেশী মাছ মৌরলা,বাঁশপাতি,পুঁটি বা চাঁদার দল দেখা মুগ্ধ চোখ নৈমিত্তিক কর্তব্যকর্মের বাইরেও যুগ যুগ ধরে সেসব দেখে যায়,অনন্তকে করতলে কেই বা ধরে হায়!... ক্রমশঃ
0 Comments