বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৫৬
হিজল
ভাস্করব্রত পতি
‘লিখিয়া রাখিল পত্র ইজল গাছের মূলে।
এইখানে পড়িব কন্যা নয়ন ফিরাইলে
সাক্ষী হইও ইজল গাছ নদীর কূলে বাসা।
তোমার কাছে কইয়া গেলাম মনের যত আশা।’
নয়ানচাঁদ ঘোষের লেখা 'চন্দ্রাবতী' পালার নায়ক জয়চন্দ্র প্রেমিকাকে মনের কথা জানাতে হিজলগাছের ছালে চিঠি লিখেছিলেন এভাবেই। তেমনি দীনেশচন্দ্র সেন সংকলিত 'মৈমনসিংহ গীতিকা' গ্রন্থে দ্বিজ কানাই প্রণীত মহুয়া পালায় হিজলগাছের এই বর্ণনা পাই -
‘পাষাণে বান্ধিয়া হিয়া বসিল শিওরে।
খেজুরীতে বহু প্রাচীন হিজল গাছ
হিজলকে বলা হয় ভারতীয় ওক গাছ। উদ্ভিদবিদ্যার পরিভাষায় এর নাম Baringtonia actungula (L) Gaertn। প্রায় ৩০-৪০ ফুট উঁচু Lecythidaceae পরিবারের এই গাছটি মূলত নদী এবং সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় জন্মায়। এগুলিই এদের বেড়ে ওঠার আদর্শ জায়গা। দক্ষিন এশিয়া, ফিলিপিন্স, আফ্রিকা, উত্তর অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, কুইন্সল্যান্ড, আফগানিস্তান ইত্যাদি উষ্ণপ্রধান দেশে হিজলের ২০ ধরনের প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়। হিজল গাছের আরও কিছু প্রজাতির নাম হল --
Barringtonia rubra Baill. ex Laness.
Butonica acutangula (L.) Lam.
Caryophyllus acutangulus (L.) Stokes
Eugenia acutangula L.
Huttum acutangulum (L.) Britten
Michelia acutangula (L.) Kuntze
Stravadium acutangulum (L.) Sweet
Stravadium acutangulum (L.) Miers
হিজলকে ওড়িয়াতে কঞ্জোলী, হিন্দিতে সমুন্দর ফল, তেলুগুতে বনপকনসী, কাদাপ্লা, তামিলে কদুপম, কাদাপ্লাই, সংস্কৃতে হিজ্জল নামে পরিচিত হিজল গাছ। এই হিজল গাছকে নিচুল নামেও ডাকা হয়। বিভিন্ন কাব্যে এই নামের ব্যবহার লক্ষ্য করা গিয়েছে। মহাকবি কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্যের পূর্বমেঘের চতুর্দশ শ্লোকে বর্ণনা করেছেন --
'অভ্রেঃ শৃঙ্গং হরতি পবনঃ কিংবিদিত্যুমুখীতিঃ
দৃষ্টোৎসাহশ্চকিত চকিতং মুগ্ধ সিদ্ধাঙ্গনাভিঃ।
স্থানাদস্মাৎ সরস নিচুলাদুৎপতোদণ্ড মুখঃ ধ্বং
দিওনাগানাং পথি পরিহরন্ স্থূলহস্তাবলেপান্'॥
এই শ্লোকটির বাংলা অর্থ করেছেন আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য। তিনি লিখেছেন, 'সেই যে অভিশপ্ত কান্তাবিরহী যক্ষ, তিনি যখন নির্জন কাতারে আবদ্ধ থেকে আষাঢ়ের মেঘকে দেখে প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠাতে অনুনয়-বিনয় করে বললেন, ওহে তুমি তো উত্তরে যাচ্ছ, তাহ'লে আমার বাড়িতে গিয়ে আমার বিরহিণী প্রিয়াকে ব'লো যে, আর এই ক'টা মাস কোন রকমে কাটাও, তারপর শ্রীহরির উত্থানের পর নিশ্চয় আমার সঙ্গে দেখা হবে; তবে আমার বাড়িটা চিনতে তোমায় পথের নিশানা ব'লে দিই, যেতে যেতে প্রথমে যা পাবে তাও বলছি ওই পাহাড় চূড়া পেরিয়ে যখন যাবে দেখবে সিদ্ধ বংশের (তিব্বতের) মেয়েরা তোমার দিকে উন্মুখ হ'য়ে তাকিয়ে থাকবে, আর তুমিও এই চিত্রকুটের (বিচিত্র সুন্দর) পার্বত্য অনিলের স্পর্শে বেশ তৃপ্তি পাবে; তারপর উত্তর দিক দিয়ে যখন যাবে, দেখবে জলাসন্নভূমির নিচুলরাজি, তারপর আরও উত্তরে যাবে, দিও নাগের আড়াল করা পথও পরিহার ক'রে অলকাপুরীর দিকে এগিয়ে যেও'। আবারও একটি শ্লোকে পাই --
'সংসর্গতো দোষগুণা ভবন্তী
ত্যেতা যেন জলাশয়েহপি।
স্থিত্বানুকুলং নিচুলচলন্তং
হিজল ফুল
তেমনি অথর্ববেদের বৈদ্যককল্পে ১৭।৬৩।৭৩ সূক্তে বলা হয়েছে-
'শিরোমে মুখং ত্বিষি নিচুলং আপোমূলং।
অশ্বিনো বর্চ'সাভিষিওয়ামি যশসে'॥
দ্বাদশ শতাব্দীর কবি জয়দেব তাঁর গীতগোবিন্দের পঞ্চম সর্গের ১১ শ্লোকে একে 'নিচোল' অর্থাৎ যেন 'ওড়না' দেওয়া ফল বলে উল্লেখ করেছেন --
'চল সখি কুঞ্জং সতিমির পুঞ্জং শীলয় নীলনিচোলম্'।
হিজল গাছ জন্মানাের জন্য বালুকনা সমৃদ্ধ লােনামাটি, উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু এবং ১৫০-২০০ সেমি বৃষ্টিপাত (বাৎসরিক) প্রয়ােজন। পূর্ব মেদিনীপুরের ১৬ টি ব্লক এলাকাই তাই হিজল গাছের পক্ষে বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছে। হিজল সাধারণত কাদাজল যুক্ত জমিতে জন্মায়। যেসব এলাকা জলমগ্ন থাকে বা যেসব এলাকার অবস্থান জল সংলগ্ন, সেখানে এই গাছ জন্মায়।
কবি জীবনানন্দ দাশের লেখায় বারবার উঠে এসেছে হিজল গাছের কথা। এক কবিতায় তিনি লিখেছেন, -- ‘চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ্বলে’। অন্যত্র পাই ‘পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে’। আবার অন্য আরেকটি জায়গায় লিখেছেন - প্রাণে তার ম্লান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো / একবার স্বপ্নে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো'। তাঁর আরেকটি কবিতায় পাই --
'আজ তারা কই সব? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক- পুকুরের জলে
বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার; তারপর কি যে তার মনে হল কবে,
কখন সে ঝরে গেল, কখন ফুরাল,
আহা,- চলে গেল কবে যে নীরবে'।
মোটামুটি ১০ থেকে ১৫ মিটার উঁচু হয় হিজল গাছ। হিজল গাছ সহজে মরেনা। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে জানে। আসলে এর মূল খুব দৃঢ় এবং এটি মাটির অনেক গভীরে প্রবেশ করে। তাই ঝড়ঝঞ্ঝা বান বন্যা ঠেকাতে সক্ষম। এদের গাছের ছাল ঘন ছাই রঙের ও বেশ পুরু। তবে হিজলের ফল বেশ বিষাক্ত। ভুল করে খেয়ে নিলে বমির উদ্রেক ঘটে। এই। এই গাছের ফুলের ঝুলন্ত মঞ্জরি ৬ - ১৫ ইঞ্চি লম্বা হয়। হিজল ফুল গভীর রাতে ফোটে। আবার সকাল হতে না হতেই ঝরতে শুরু করে। শাখার অগ্রভাগ থেকে পুষ্পদণ্ড বের হয়, যা নাকছাবির মত ঘিয়ে রংয়ের। ঠিক যেন সুতোয় গাঁথা মনে হয়। এদের পত্রাগ্রটি চওড়া এবং কাঁঠাল পাতার মত গোলাকার। ফল শুকিয়ে গেলে দেখতে এলাচের মত হয়। সারা বছরই ফল হতে দেখা গেলেও মূলতঃ মার্চ এপ্রিলেই ফল হয়।
যদিও এখন হিজল গাছ তেমন একটা দেখা যায়না। কিন্তু হিজল গাছের নামে সৃষ্ট গ্রামনামগুলো রয়ে গেছে এখনও।
হিজল + বেড়িয়া > হিজলবেড়িয়া > হিজলবেড়্যা
হিজল + না > হিজল না
হিজল + দহ > হিজল দহ > হিজলদা
হিজল + ঈ > হিজলী + শরিফ > হিজলী শরিফ
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরীর সমুদ্র উপকূলবর্তী হিজলী শরিফ এখন মুসলিমদের অন্যতম ধর্মস্থান হলেও হিন্দুরাও এখানে মানত করেন। বলা যায়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক নিদর্শন। এই 'হিজলী' নামটি বেশ প্রাচীনকাল থেকেই পাওয়া যায়। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে (আনুমানিক ১৫৭৯ সাল) ধনপতি সওদাগর এবং তাঁর ছেলে শ্রীমন্ত সম্পর্কে পাই 'কলিকাতা এড়াইল বেনিয়ার বালা
বেতড়েতে উত্তরিল অবসান বেলা
ডাইনে উড়িয়া যায় হিজলের পথ'।
আবার এই 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যের অন্যত্র আমরা পাই- 'তরায়ে চালান তীরের সমান
বেতড় বাহিয়া সাধু পাইল বাজান।
হিমাই বামেতে থাকে হিজলীর পথে।
হিজল ফল
একসময় হিজলীর খালে জলদস্যুদের ব্যাপক উৎপাত ছিল। তারও আগে অবশ্য এই হিজলী রাজ্য সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত ছিল। যদিও ১৫৫৩ সালে ডি ব্যারোর মানচিত্র দেখানাে হয়ছে বর্তমান কসবা হিজলী পরগনায় একটি দ্বীপ উৎপন্ন হচ্ছে। অর্থাৎ আলােচিত হিজলী এলাকাটির জন্ম ওই সময়। নদীর পলি জমে গঠিত দ্বীপ এলাকায় ব্যাপক হিজল গাছের প্রাধান্য থাকায় তা হয়ে দাঁড়িয়েছে 'হিজলী'। গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানে পাই সেই হিজলের কথা—
‘হাওরের পানি নাই রে হেথায়,
নাই রে তাজা মাছ
বিলের বুকে ডালা মেলা,
নাই রে হিজল গাছ’।
হিজলবীজ চন্দনের মতো ঘসে বুকে লাগালে বুকের ব্যথা কমে। পেটে মাখালে পেটের ব্যথা এবং পেটফাঁপা কমে যায়। শিশুদের শ্বাসকষ্ট থাকলে হিজলের বীজ ঘষে (চন্দনের মত) ১৫-২০ ফোঁটা, একটু, বুকের দুধের সঙ্গে অথবা যেকোন দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে ভালো ফল মেলে। এছাড়াও পেটের বায়ুতে, নাক বন্ধে, যকৃৎ বৃদ্ধি হলে, চোখ ওঠার উপশমে হিজলের ব্যবহার বৈদ্যকরা করে থাকেন।
🍂
2 Comments
লেখক কে ধন্যবাদ। হিজল গাছের গভীর বাস্তুতান্ত্রিক ভূমিকা রয়েছে। যা জলজ অন্যান্য অনেক গাছের তুলনায় অনেক বেশি ও গুরুত্বপূর্ণ।
ReplyDeleteThanks a lot
ReplyDelete