জ্বলদর্চি

ষষ্ঠীপূজা / ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ৫


ষষ্ঠীপূজা 

ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবাংলার গ্রামে ঘরে ষষ্ঠীপুজোর চল এখনও প্রচলিত। বাংলার সংস্কৃতির সাথে এই ষষ্ঠীপুজোর ভুমিকা এবং অবস্থান আজও রীতিমতো গবেষণার বিষয়। দিন বদলের সাথে সাথে নিতান্ত গ্রাম্য এই লৌকিক উৎসবটি ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই ষষ্ঠীপুজো বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা এবং লোকজীবনের সাথে জড়িত অঙ্গাঙ্গীভাবে।

মূলতঃ হিন্দু সমাজের অন্যতম এক উৎসব হল এই ষষ্ঠীপূজা। নবজাতক জন্মগ্রহণের ছয় (৬) দিনের মাথায় ঐ বাড়িতেই পূজা হয় দেবী ষষ্ঠীর। তা হল 'ষেটেরা'। অর্থাৎ বংশবৃদ্ধি বা জনজীবনকে সচল রাখার যে প্রণালী তার সাথে সমানতালে জড়িত ষষ্ঠীপূজার চল। অর্থাৎ ষষ্ঠীদেবী হলেন প্রজননের দেবী। মানুষের বংশধর টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে শরণাপন্ন হতে হয় এই ষষ্ঠীদেবীর কাছে। লোকসমাজে প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে - ষষ্ঠীদেবীর কৃপায় নিঃসন্তান মহিলা সন্তানের উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। এই ষষ্ঠীদেবীই হয়ে ওঠেন মঙ্গল এবং রক্ষার দেবী। আবার শিশু জন্মের ২১ বা ৩১ তম দিনেও এই ষষ্ঠীপূজা হয় কোথাও কোথাও।

নবজাতকের জন্মের ছয় দিনের দিন মূলতঃ পুজো করা হয়। এদিন বাড়ির দেওয়ালে তৈরি করতে হয় ‘ষষ্ঠীর ঘর”। অনেক যায়গায় বলা হয় "কৌড়ির ঘর"। মাটি দিয়ে সেই ঘরটি বানানো হয়। তবে পাকাবাড়ির দেওয়ালে আজকাল আর ‘ষষ্ঠীর ঘর’ বানানো হয় না। মাটির দেওয়ালেই তা করা হয়। ইদানিং মাটির বাড়ির সংখ্যা কমছে। পাকাবাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে জন্মহার, কিন্তু ষষ্ঠীপুজো হলেও ‘ষষ্ঠীর ঘর' বানানোর রীতি কমে গেছে। মূলতঃ নবজাতকের আয়ু বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই ‘ষষ্ঠীর ঘর’ বানানো হয়। নবজাতকের কপালে বা ভাগ্যে কি আছে তা বিধাতার (ব্রক্ষ্মা) লিখনে লিখে দেয় এতে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, নবজাতক যদি ছেলে হয় তবে ষষ্ঠীপুজোর ধুম বাড়ে। মেয়ে হলে তেমন গুরুত্ব পায় না। এটা কি সামাজিক স্থূলতার নিদর্শন নয়? ছেলের চেয়ে মেয়েদের গুরুত্ব জনসমাজে বরাবরই কম, তা এ ঘটনাই প্রমাণ করে।

‘ষষ্ঠীর ঘর’টি কি রকম? দেওয়ালের গায়ে নক্সা করা হয় কাদামাটি দিয়ে উঁচু এবং মোটা করে। প্রথমে বর্গক্ষেত্র বা আয়তক্ষেত্র বানানো হয়। এরপর তার চারকোনে বাইরের দিক থেকে চারটি অর্ধচন্দ্র তৈরি করা হয়। বর্গক্ষেত্রের উপরের বাহুর উপরের দিকে তিনটি পদ্মফুলের পাঁপড়ি বানানো হয়। পাঁপড়ি তিনটি পরস্পরের সাথে জোড়া থাকে। একে বলে ‘পদ্মচূড়া”। বর্গক্ষেত্রের দুধারের দুই বাহুর দুপাশে দুটি অর্ধ গোলাকার তৈরি করা হয়। একে বলে ‘চক্ষুদান’। বর্গক্ষেত্রের মধ্যে বানানো হয় অতি পরিচিত ‘স্বস্তিকা চিহ্ন'। স্বস্তিকার ওপর দুটি গোলাকার কাদার মন্ড বানানো হয়। এতে আটকানো থাকে ‘কড়ি’। অর্ধচন্দ্রগুলির মাঝেও কড়ি আটকানো থাকে চারটি।

'লোকসংস্কৃতি' পত্রিকার যুগ্মসচিব অমিতা চৌধুরীর কথায়, বাংলায় ষষ্ঠী নামের দেবীর সংখ্যা অসংখ্য। প্রতিমাসের শুক্লাষষ্ঠী তিথিতে বিভিন্ন ষষ্ঠীদেবীর পূজা করা হয়। তবে শিশু জন্মের পর যে ষষ্ঠীদেবীর আরাধনা হয়ে থাকে তাকে বলে ‘সূতিকাষষ্ঠী’ বা ‘জন্মষষ্ঠী’। যাইহোক, এবার বরং ষষ্ঠীদেবীর পূজা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় আসি। 

নির্দিষ্ট কোনও মূৰ্ত্তি নেই ষষ্ঠীদেবীর। আগেই বলা হয়েছে দেওয়ালে দেবীর মূর্ত্তি হিসাবে কল্পিত ‘ষষ্ঠীর ঘর' তৈরির কথা। অনেক ক্ষেত্রে ঘটে পোঁতা বটের ডাল, আমের পাতা (পাঁচটি পাতা যুক্ত আমসার), ঘটে আঁকা মূর্ত্তি, শিল দিয়ে তৈরি মূর্তিতেও পূজা করা হয়। দক্ষিণ বা পূর্বমুখী করে বসানো হয় ঘট।

ষষ্ঠীপূজার জন্য নৈবেদ্য হিসাবে ফলমূল এবং মিষ্টান্ন আবশ্যক। ‘পরব’ করতে হয়। এতে লাগে ২১ খানা গুড়পিঠা এবং এস্কাপিঠা। এক ডালা খই ভাজতে হয়। এক ছড়া (১২টি) কাঁঠালী কলা (রম্ভা), আখগাছ, কেয়াগাছ, তালপাতা, ‘লেখন' (লোহার তৈরি) ইত্যাদি সামগ্রী দিয়ে ষষ্ঠীপূজা করা হয়। ষষ্ঠীর প্রধান নৈবেদ্য হল ২১ টি পিঠা। ষষ্ঠীপূজা উপলক্ষে দেওয়ালে ষষ্ঠীর চিত্র আঁকা ছাড়াও ‘ঘটস্থাপন’ করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়ে বটের পাতা, আমের পাতা, তেল হলুদ, দই, ধান, দুর্বা, তুলসী পাতা, ফুল ইত্যাদি। ষষ্ঠীপুজোর জন্য পুরোহিত থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবশ্য বাড়ির মহিলারাই এই পুজো করে থাকেন। এজন্য তাঁরা মেনে চলেন বেশ কিছু আচার এবং উপচার।

পুজার শেষে মহিলারা ‘ব্রতকথা’ শোনান। এরপর পুকুরে ডুবে স্নান করে খাওয়া দাওয়া করেন তাঁরা। এখানে উল্লেখ্য যে, পুজোর দিন দেবী ষষ্ঠীর জন্য যে ভোগ দেওয়া হয়, সেই ভোগ খায় ঐ নবজাতকের মা। এদিন দেবী ষষ্ঠীর জন্য ছয় রকমের তরকারি বানানো হয়। প্রতিটি তরকারির কিয়দংশ ভোগ হিসাবে গ্রহণ করেন প্রসূতি মা। পুজোর সময় নবজাতককে শোয়ানো হয় নতুন বস্ত্রের ওপর। ধান দুর্বা দিয়ে বাড়ির বড়রা আশির্বাদ করে নবজাতককে। এরপর তাঁর নামকরণ করা হয়।

অনেক বাড়িতে ষষ্ঠীপূজার দিন রাতে ষষ্ঠীর গান ‘ষষ্ঠীমঙ্গল’ করা হয়ে থাকে। এজন্য ভরসা গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা কীর্তন দল বা পালাগানের দল। ড. অদিতি বেরা সংগৃহীত ষষ্ঠীমঙ্গলের কয়েকটি পালার নাম হল জয়সিংহ রাজার পুত্রলাভ, শিলাবতীর বনবাস, সতী সুলোচনা, অভিশপ্ত চন্দন, বিজয় বাসন্তী, রঘু চূড়ামনি, পদ্মকুমার, জ্যোৎস্না মিলন, পুষ্পবৃষ্টি, কামিনী কাঞ্চন ইত্যাদি। বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য পালাকার ষষ্ঠীমঙ্গল লিখেছেন ষষ্ঠীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করে। তাঁদের মধ্যে কৃষ্ণরাম দাস, রামধন চক্রবর্তী, শিবানন্দ কর, শঙ্কর উল্লেখযোগ্য।

কোথাও ষষ্ঠীদেবীর মন্দির বা থান চোখে পড়ে না। তবে বাড়ির উঠোনে, বটগাছের তলায়, নদী বা পুকুরের ধারে তিনি পূজিত হন। মেদিনীপুর জেলার দুই অংশেই ষষ্ঠীদেবীর পুজোর প্রচলন ব্যাপক। একে গাঁয়ের লোকেরা বলে ‘ষষ্ঠী বুড়ি’। আর ষষ্ঠীদেবীর বাহন হ’ল বিড়াল। বিশেষ করে কালো বিড়াল। ফলে হিন্দু বাঙালীরা বিড়ালকে একটু বেশি ভালোবাসে। বিড়ালকে আঘাত করা হয় না। পাছে ষষ্ঠীদেবী রাগ করেন। তাই বিড়াল হয়ে উঠেছে অত্যন্ত আদরনীয় গৃহপালিত প্রাণী। পাতের এঁটো খাবার অথবা দুধভাত খাওয়াতেও কুণ্ঠিত হয় না ষষ্ঠীদেবীর ভক্তরা।

ষষ্ঠী পূজার সন্ধান ষোড়শ শতাব্দীর সময়েও পাওয়া গিয়েছে। শ্মশানকালীর মতোই একসময় ষষ্ঠীদেবী ছিলেন ভাগাড়ের দেবী ( মৃত পশু ফেলার স্থান)। সন্তান প্রসবের পর আঁতুড় ঘরের চালে গোমুন্ড গুঁজে রাখার প্রচলন আজও আছে। ফাল্গুন মাসে যে ষষ্ঠী পুজো হয় তা "গো রুপিনী ষষ্ঠী" নামে পরিচিত। শস্য সুরক্ষার জন্য গো মুন্ড শস্যক্ষেত্রে রাখা হয় যাতে কোন প্রকার নজর না পড়ে এবং অধিক ফসল লাভ হয়। ব্রম্ভবৈবর্ত্য পুরাণ অনুসারে ষষ্ঠী হলেন ব্রম্ভার মানস কন্যা এবং কার্তিকের স্ত্রী। দেবীর আসল নাম দেবসেনা এবং প্রকৃতির ষষ্ঠ অংশ থেকে উদ্ভুত বলে ষষ্ঠী নামকরণ হয়েছে।

সন্তানের অমঙ্গল রোধে অথবা সন্তানের কুশল কামনায় গ্রামের মহিলারা প্রায়ই একটা কথা বলেন- ‘বালাই ষাট’। অনেকে বলেন ‘ষাট যাট’। আমাদের আলোচিত ষষ্ঠীদেবীই উচ্চারণের সুবিধার্থে হয়েছেন 'যাট যাট'। লোকসমাজে জনশ্রুতি যে, সন্তানাদির সকল আপদ বিপদে ভরসা হলেন ষষ্ঠীদেবী। তিনিই রক্ষা করেন সন্তান সন্ততিদের। এই ধর্মবিশ্বাস থেকেই পূর্বে উল্লিখিত শব্দটির প্রয়োগ। কোনও সন্তানের বিরুদ্ধে কেউ অমঙ্গলসূচক কথা বললে তখন সেই ‘কথা’ ঐ সন্তানের জীবনে যেন না ফলে এই কামনায় উচ্চারিত হয় 'বালাই ষাট’ কথাটি৷ বহুদিন আগে পাঁশকুড়া থানার গৌরাঙ্গপুর গ্রামে শ্রীমতি তরুলতা চক্রবর্তী এরকমই ষষ্ঠীদেবীর নামে একটি ছড়া বলতেন। এই ছড়া দ্বিতীয় কোনও মহিলার মুখে কখনও শুনিনি। স্মৃতি থেকে সেই ছড়াটি তুলে ধরছি। যখন কোনও নাতি বা নাতনি ‘হ্যাঁচ্ছো’ করে হেঁচে ফেলতো, তখন তিনি বলতেন- “শত জিও /  ষষ্ঠীবুড়ির পাদটি তুমি খেয়ো”। অর্থাৎ ‘হ্যাঁচ্ছো’ বলা বা হাঁচি পড়া হল অমঙ্গলসূচক। তখন বাড়ির বয়স্ক মহিলারা উপরোক্ত ছড়ার মাধ্যমে ষষ্ঠীবুড়ির নিকৃষ্ট দ্রব্য ‘পাদ’ বা ‘বাতকর্ম’ খাওয়ার কথা বলতেন নাতি নাতনিদের। এতে সন্তুষ্ট হয় ষষ্ঠীবুড়ি। আর তাঁর বিনিময়ে সন্তানেরা পায় শত বছর বাঁচার অধিকার।

ষষ্ঠীপুজোর ব্রত বিভিন্ন রকম। নবজাতক জন্মের ষষ্ঠ দিনে যে ষষ্ঠীপুজো হয় তার কথা আগেই বলা হয়েছে। একে বলে ‘ঘাট ষষ্ঠী’। যেহেতু পুকুর ঘাটে পুজো হয়। সেখানে দুটি মাটির গোলাকার পিন্ড, শিলনোড়া দিয়ে যষ্ঠীর মূর্তি কল্পনা করে পূজিত হন দেবী। আবার ভাদ্রমাসের শুরুতে পুকুরের পাড়ে বেল অথবা মনসা গাছের তলায় বেদী বানিয়ে পূজা করা হয় ‘সরদেশী ষষ্ঠী’। এসময় দেবীর জন্য নৈবেদ্য হিসাবে দেওয়া হয় ‘এস্কা’ বা ‘আসকে পিঠা’। আবার অনেক বাড়িতে নবজাতকের বয়স একুশ দিন হলে পালন করা হয় ‘একুশে’ বা ‘একুশা’। ঘরের ঈশানকোনে ঘটস্থাপন করে দেবীষষ্ঠীর পূজা করা হয় এদিন। পূজা পদ্ধতি অনেকটাই নবজাতকের ষষ্ঠীদিনের পুজোর মতোই। শিশু যত বড় হয় তত বাবা মায়ের ভয় বাড়তে থাকে। এসময় শিশু হাঁটাচলা করতে শেখে। ফলে তখন জলে ডুবে যাওয়ার ভয় থাকে। এই ‘ফাঁড়া’ কাটাতে বারো বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিবছর ঐ শিশুর জন্মতিথিতে পালন করা হয় ‘জলষষ্ঠীর’ ব্রত। মানুষের বিশ্বাস জলষষ্ঠী শিশুকে জলে ডোবা থেকে রক্ষা করে। সন্তানের মঙ্গল কামনায় ষষ্ঠীপূজার সময় পুকুর ঘাটে এয়োস্ত্রীরা গিয়ে যে পূজো করে পানপাতা, সুপুরি, সিঁদুর, বাতাসা, ধান, দূর্বা, ফুল, ধূপ সহ সেখানে শিলনোড়া নিয়ে যাওয়া হয় ষষ্ঠী জ্ঞানে। আসলে ষষ্ঠীদেবীর মূর্তি কল্পনায় ব্যবহার করা হয় শিলের নোড়া। কাদা মাটির দুখানা মণ্ড বসানো হয়। তার উপরে পানপাতা রাখা হয়। পূজোর শেষে এ কাদার মণ্ড সহ পানপাতা ভাসিয়ে দেওয়া হয় পুকুরে। যদিও শিলষষ্ঠীর পূজা আলাদা।

তবে ‘জামাইষষ্ঠী’ এবং ‘ভাইষষ্ঠী’ আজও এই বঙ্গে দারুণভাবে বিরাজমান। এই দুটি অনুষ্ঠান তো এখন রীতিমতো উৎসবের পর্যায়ে। গ্রামবাংলায় ভীষণরকম জনপ্রিয় এই দুটি অনুষ্ঠান। কখনওবা জাতি ধর্ম বর্ণের বেড়া ডিঙিয়ে পেয়ে গিয়েছে বিশ্বজনীন স্থান৷ জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে পালন করা হয় ‘অরণ্যষষ্ঠী’র ব্রত। এই অরণ্যষষ্ঠী ব্রতেরই লৌকিক রূপ হল ‘জামাইষষ্ঠী'। এদিন শাশুড়িরা তাঁদের জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় না খেয়ে কপালে চন্দনের ফোঁটা দেন। মাথায় ধান দুর্বা ছড়ান। আশীর্বাদ করেন দীর্ঘ সুস্থ জীবনের। দেওয়া হয় নতুন বস্ত্র। কোথাও কোথাও জামাইয়ের হাতে হলুদ ছোপান ছয়গাছি পাকানো সূতা বেঁধে দেওয়া হয়। থাকে জামাইকে ভুরিভোজ করানোর ব্যবস্থাও। তেমনি ‘ভাইষষ্ঠী’র দিন ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় বোনেরা দাদা বা ভাইয়ের কপালে দেয় চন্দনের ফোঁটা। দেওয়ালীর পর কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে হয় ‘ভাইষষ্ঠী’ বা ‘ভাতৃদ্বিতীয়া’। তবে ‘ভাতৃদ্বিতীয়া’ নামটিই সমধিক পরিচিত। যেহেতু ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় ষষ্ঠীদেবীর কাছে আবেদন জানানো হয় তাই একে ‘ভাইষষ্ঠী'ও বলা হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ সর্বানন্দ সুন্দরীর লেখা একটি তালপাতার পুঁথি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে বলা যায়, খ্রীষ্টপূর্ব ৫২৭ সাল থেকে এই ভাতৃদ্বিতীয়ার প্রচলন। এথেকে জানা যায় যে, মহাবীরের মৃত্যুর পর রাজা নন্দিত বর্ধনের শোকাতুর বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়ে খাওয়ানো হয়। সেই থেকে এই দিনটায় পালিত হচ্ছে ভাতৃদ্বিতীয়া। আজ উপরোক্ত দুটি অনুষ্ঠানই সামাজিকতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পূর্ণ বাঙালীয়ানার জ্বলন্ত নিদর্শন হল জামাইষষ্ঠী এবং ভাইষষ্ঠী।

আবার চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিনে গ্রামবাংলায় পালিত হয় ‘অশোকষষ্ঠী’। এজন্য প্রয়োজন হয় অশোক ফুলের কুঁড়ি। এই ব্রত পালন করে মায়েরা। তাঁদের সন্তানের মঙ্গলের জন্য। সারাদিন উপোস করে বাড়ির মায়েরা ছয়টি অশোক ফুলের কুঁড়ি দাঁতে না লাগিয়ে মুগকলাই এবং দইয়ের সাথে গিলে নেন। এভাবেই পালিত হয় অশোকষষ্ঠী। এ-ও একধরণের ষষ্ঠীর ব্রত।

ষষ্ঠীদেবীকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে রয়েছে অজস্র প্রবাদ প্রবচন। রেভারেন্ড জেমস্ লঙ তার ‘প্রবাদমালা' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এরকম বেশ কিছু প্রবাদ। সেগুলি হল - ‘‘দুর্গাপূজায় শঙ্খ বাজেনা / ষষ্ঠীপূজায় ঢোল” এবং “ষষ্ঠী রাগ করেন ছেল্যা ধরে খাবেন / অন্যে তিনি কি করিবেন”। এছাড়া ষষ্ঠীদেবীকে নিয়ে রয়েছে আরও বহু প্রবাদ। আমরা কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই উচ্চারণ করি ‘ষষ্ঠীর কৃপা’, ‘ষষ্ঠীর বেড়াল’ ইত্যাদি। “ষেঠের বাছা ষষ্ঠীদান / ষেঠের কোলে” প্রবাদটিতে ‘‘ষেঠ” আসলে “ষষ্ঠী’র বিকৃত উচ্চারণ। বংশবৃদ্ধির জন্য শরণাপন্ন হতে হয় ষষ্ঠীদেবীর কাছে। ফলে জনবিস্ফোরনের জন্য দেবী ষষ্ঠীকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। আরও কয়েকটি প্রবাদ এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। সেগুলি হ’ল - “মাগ ভাতারে দেখা নাই / যষ্ঠীপূজার ধুম’, ‘‘অর্ধেক সকল ঘরগোষ্ঠী / আর অর্দ্ধেক মা ষষ্ঠী”, "ষাটের বাছা, ষষ্ঠীর দাস", "লক্ষ্মীর কৃপা নেই, ষষ্ঠীর কৃপা আছে", "ষষ্ঠীর বেড়াল হয়ে মাছ দুধ খায়", “ধানাই পানাই কয়টি / তিন মানেনা ষাঠী”, “জন্মে হয়নি ষষ্ঠীপূজা / একেবারে দশভূজা” ইত্যাদি।

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’র ‘মালঞ্চমালা’ গল্পে ছয় দিনের নবজাতকের কথা লেখা আছে। “দেখিতে দেখিতে ছয় ষষ্ঠীর রাত। ছয় ষষ্ঠীর রাতে রাজা আঙ্গিনা ঘিরিয়া সোনার ঝালর সারি সারি চাঁদোয়া উঠাইলেন। চাঁদোয়ার নীচে ঘিয়ের বাতির সার দেওয়াইলেন। যত বাদ্য জোরে বাজিল। একশো এক গায়েনের গান, চারিদিকে চার আগুনের কুন্ড, পাইক, সিপাই, সান্ত্রী দিয়া রাজা, সারারাত খাঁড়া পাহারার হুকুম দিলেন। আর - আঁতুড়ঘর অবধি ‘ফুল পুষ্পের’ পথ; ফুলের মালা আর চন্দন সিঁদুরের আঁক! সেই পথ ধরে তাঁরা বিধাতারা আসিয়া রাজপুত্রের কপালের লিখন লিখিয়া যাইবেন”। এরপর কি হল তা আমাদের অনেকেরই জানা। ছয় ষষ্ঠীর রাত যে নবজাতকের জীবনে ভয়ঙ্কর রাত তা প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেও। আশুতোষ ভট্টাচার্য্য সম্পাদিত গোপীচন্দ্রের গানেও দেবী ষষ্ঠীর প্রসঙ্গ আছে – “ছয় দিবসে কৈল ছেলের ষষ্ঠী আচার / পন্ডিতে লিখিল কুষ্ঠি করিয়া বিচার”। আবার ‘বঙ্গীয় লোকসঙ্গীত রত্নাকর’ গ্রন্থে আশুতোষ ভট্টাচার্য্য লখীন্দর সম্পর্কে লিখেছেন - ‘‘ছয়দিনে লখিন্দরের ষষ্ঠ হইল / সাতদিনে লখিন্দরের অশৌচ তুলিল”।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে নবজাতকের জন্মের ষষ্ঠদিনে আয়োজিত লোকাচারটি হল ‘সূতিকা ষষ্ঠী’। একে বলা হয় ‘ষেটেরা”। পূর্বোক্ত গানগুলি ষেটেরার উদাহরণ। প্রাচীনকালে ষেটেরা ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। ডঃ বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়, ডঃ কামিনীকুমার রায়, চিন্তাহরণ চক্রবর্তীরা বিভিন্নভাবে ষষ্ঠীপূজা বা ষেটেরা পূজার প্রসঙ্গ টেনেছেন। ডঃ মৃত্যুঞ্জয় গুঁই প্রাচীন 'বাংলা সাহিত্যে লোকাচার ও লোকবিশ্বাস' গ্রন্থে প্রাচীনকালে ষেটেরার গান তুলে ধরেছেন মনসানঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, মনসাপুরাণ, রামায়ণ, পদ্মাপুরাণ, মঙ্গলচন্ডীর গীত, ধর্মমঙ্গল, শ্রীধর্মঙ্গল গ্রন্থ থেকে। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দর ‘মনসামঙ্গল'-এ লেখা হয়েছে “সনকা সুন্দরী ষষ্ঠীপূজা করি / যাহার যে নীতি আছে / হাতে খড়গ লৈয়্যা রহিল জাগিয়া / মসীপত্র থুয়্যা কাছে / অর্দ্ধ রাত্রী গেলে বিধি হেনকালে / লিখিত আইন"। কবি কৃত্তিবাস 'রামায়ণ'- এ লিখেছেন “ছয়দিনে ষষ্ঠীপূজা নিশি জাগরণে”। “পদ্মপুরাণ'-এ বিজয়গুপ্ত লিখেছেন – “ছয়দিনে ষষ্ঠীপূজি করিল জাগরণ”। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চন্ডীমঙ্গল' কাব্যে পাই-“ছয়দিনে ষেটেরা কৈল জাগরণে”। তন্ত্রবিভূতির 'মনসাপুরাণ'-এ মেলে “ছয়দিনে ষষ্ঠীপূজা করে পরিপাটি”। ঘনরাম চক্রবর্তী ‘শ্রীধৰ্ম্মমঙ্গল’-এ জানিয়েছেন “ষষ্ঠদিনে তুই করে দেবী চন্ডীমাকে’’। মানিকরামের ধর্মমঙ্গল-এ পাই “সাদরে সূতিকা ষষ্ঠী পূজা ষষ্ঠদিনে”। রূপরাম চক্রবর্তীর ‘ধর্মমঙ্গল’-এ লেখা আছে “কুলক্রিয়া সকল সাধিল কূলবতী / ছদিনে ষেটেরা পূজে জাগরন রাতি’ “মঙ্গলচন্ডী’-তে দ্বিজমাধব লিখেছেন “ছয়দিনে পূজা কৈল ষষ্ঠী দেবতারে”। কৃষ্ণরাম দাসের ষষ্ঠীমঙ্গলে পাই, "রাণী বলে আমার তনয় যদি হয় / করিব ষষ্ঠীর পূজা কভু মিথ্যা নয়"।

ড. মৃত্যুঞ্জয় গুঁই এর অভিমত, ষেটেরা লোকাচারটির প্রচলন অতীতে হলেও তা বর্তমান কালেও প্রলম্বিত। তাই এটিকে উদ্বর্তিত লোকাচার বলা যায়। আজকের বিজ্ঞানের যুগে অবশ্য ষেটেরা বা ষষ্ঠীপূজা শিশুর ভাগ্যরচিত হওয়ার অনুষ্ঠান হিসাবে তেমন পালিত হয় না। আধুনিকতার মোড়কে থাকা মানুষজনের কাছে এই লোকাচার তথা লৌকিক উৎসবটি ক্রমশঃ গুরুত্বহীন হচ্ছে। কেননা, কমছে শিশুমৃত্যুর হার। তাই বোধহয় ষষ্ঠীদেবীর শরণাপন্ন হওয়ার বাসনাও কমছে। তবে আজও লোকমুখে ষষ্ঠীদেবীকে নিয়ে রচিত ছড়া ঘোরে "যেমন ঠাকুরের তেমন পূজা / ষষ্ঠী ঠাকুরের খই ভাজা”।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments