জ্বলদর্চি

নেই তাই খাচ্ছ, থাকলে কী খেতে? কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে-যেতে / গৌতম বাড়ই

নেই তাই খাচ্ছ, থাকলে কী খেতে? কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে-যেতে

গৌতম বাড়ই


যদি কবিতার কথায় বলি তো এই সময়টা বড্ডো ঝুরঝুরে। সব কেমন যেন ঝর্ঝর করে ভেঙ্গে পড়ছে।দেশ ভাঙ্গছে মনেমনে। জাতপাত। লেখাপড়া। ধর্ম। স্বাস্থ্য। সম্পর্ক। রাজনীতি। দল-উপদল। ঘরে-বাইরে তার রোজ অবাধ যাতায়াত। আমরা যেন এক ভাঙ্গনের মুখোমুখি। আগন্তুককে জিগ্গেস করি তুমি এলে কোন ভাঙ্গনের পথ বেয়ে?

একটা হেঁয়ালি মনে পড়ছে। আগের সেই জনপ্রিয় কালিদাসের হেঁয়ালি। বলছি এখানে।

কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে যেতে, নেই তাই খাচ্ছ, থাকলে কী খেতে?
সবচেয়ে করুণ রস এখানে। হেঁয়ালির গোরুর থেকেও বাজে অবস্থা আমাদের। আমাদের আছে বলেই তাই বেঁচে আছি। না থাকলে অক্কা পেতাম। কি পরিষ্কার হল না তো? গোরুর মুখের ঠোনা আর আমাদের অতিমারি থেকে বাঁচবার মুখের মাস্ক। সেই চতুষ্পদ একটা জীবন নিয়ে বেঁচে আছি।তারচেয়েও খারাপ।আমাদের খাবার ভাঁড়ারে শূন্য। আর বেঁচে থাকাটা মুখোশধারী হয়ে ঐ মহাশূন্যে তাকিয়ে থেকে একটা শূন্য অবিরত রচনা করা।

একটা দৈন্যতা সৃজন শিল্পে, সাহিত্যে, জীবনের প্রতিটি সুকুমার ভাগে। রাজনীতির দৈন্যতা আরও বেশি প্রকট। সাহিত্যের ক্ষুধায় একদিন চমকে দিয়েছিল এই বাংলাদেশেই হাঙ্গরী জেনারেশনের সাহিত্য চর্চা। সেদিনও জীবনের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জ্বালা ধরাচ্ছিল এই সমাজ ব্যবস্থা। বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগটি ছিল প্রতিবাদের কাল আর শতাব্দীর শেষে আমরা দেখলাম শুধুই আত্মসমর্পণ। অনেকে বলেন এর পেছনে এক বা একাধিক কারণ। সমাজ নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের লেখায় উঠে এসেছে এমন অনেক কিছু। টিভি যেমন আমাদের গৃহবন্দী করেছে, তারপরে ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার আর মুঠোফোনের বিপুল আয়োজন আমাদের একক একটা মাত্রা দিয়েছে। আর পুঁজিবাদ যে আবার ১৫০-২০০ বছর আগের সমাজব্যবস্থায় ফিরে যাবে এ আর নতুন কী। একটা ছাদের তলায় আমরা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে শুধুমাত্র একাই। অনেক হিসেব কষে সমাজতাত্ত্বিকরা দেখেছিলেন মানুষের মানসিক ও শারীরিক গঠন ঠিক রাখতে হলে পরিশ্রমের সর্বোচ্চ
 সময় আটঘন্টা করা উচিত। আর আটঘন্টার লড়াই তো ঐতিহাসিক হয়ে রইলো বিশ্ব ইতিহাসে। সেই স্বীকৃতি আজ আস্তে আস্তে ক্রমশ ম্রিয়মাণ। পুঁজিবাদের মূল কথাই হল অল্পপুঁজি ঢেলে মুনাফার পাহাড়। আমাদের টিভিতে জোর করে দেখান হয় আমরা যা দেখতে চাইনা। যে চ্যানেল দেখবো না, সেটা দিয়েই শুরু। তাবিজ, কবজ, অষ্টধাতু যে নষ্টের মূল গোড়া তা বোঝাবে কে? আপনাকে দেখতেই হবে।একটা উন্নত সভ্যতা রক্ষা করতে গেলে বা তৈরী করতে গেলে বিজ্ঞান আর বুজরুকি পাশাপাশি চলতে পারে না। মহাশূন্যে বিজ্ঞানীদের পাঠাব আর গলায় কালচক্র ধারণ করব তা কী হয়! হাঁ তাই হচ্ছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা ধূলোয় লুন্ঠিত। বিরূদ্ধ মতবাদ চলবে না। সে ভাল হোক বা খারাপ। আজকের সমর্পণ করা এই সমাজে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

জীবতোষ দাসের একটি কবিতা খুব মনে পড়ছে।

রাজার সর্দি-কাশি

সংবাদে জেনে গেছি আমি 
রাজার সর্দি-কাশি, রক্তচাপ ও সামান্য জ্বরের কথা-
জেনে গেছি রাজার অনুচরদের কাতর প্রার্থনা
দালালদের সমবেত কন্ঠস্বর ও একঘেয়ে আলাপ
তবু আমি রাজার কথা ভাবি, ভাবতে হয়
এবং গড়গড় করে মুখস্থ করে তাই
রাজাদের রাজকীয় ইতিহাস।

আমি যে বাজারে যাই সে বাজারে আমার এক বাজার পরিচিত দিনুদা আছেন। দিনুদা আবার একটু ভাববাচ্যে কথা বলেন বেশি। আমায় দেখে বললেন সেদিন, খুব যে খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েছ বুঝতেই পারছি। বলি ট্যাকে টান না আগাম বিপদ বুঝে জমাচ্ছ টাকা? বলি সরকারি চাকরি করা হয় তো?তবে এত চিন্তা কেন?

কি করে বোঝাই দিনুদা নিজেই মোক্ষম জবাবটি  দিয়ে রেখেছেন তার কথায়। তবে শেষ করি সেই গোড়ার কথায়।

নেই তাই খাচ্ছ, থাকলে কী খেতে? কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে-যেতে।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments