জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত /বংশীর খেলাধূলা পর্ব ১

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
বংশীর খেলাধূলা পর্ব ১ 

রবিবারের সকালবেলাতেই রাস্তা জ্যাম? হাতে মাংসের থলিটা ঝুলিয়ে বংশীবদন বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে আটকে গেল। ইউটিউবে সুপ্তির রান্নাঘরের মাংসের মখমলিটা করার প্ল্যান অনেকদিন। আজ রান্নার মাসী ছুটি নিয়েছে। একই রেসিপি খেয়ে খেয়ে জিভে শ্যাওলা পড়ে গেছে। আজ নিজেকে একটু যত্ন আত্তি করার ইচ্ছে হয়েছে বংশীবদনের। তাড়াতাড়ি শুরু করতে হবে। কিন্তু বাড়ীর রাস্তায় জটলা, যাতায়াত বন্ধ। 
এবড়ো খেবড়ো ফুটপাথে পাত পেড়ে বাসি পচা ভাত খাচ্ছে কুড়ি বাইশটি কাক। রাস্তায় পার্ক করা অডি থেকে অল্টো, ফলে যাতায়াত দুপাশ থেকে কমতে কমতে সরু। একদিকে দিয়ে ঢুকছে একটা ছোটহাতি ঝরঝরে মালবাহী গাড়ি, তাতে চাপানো গোটা কয়েক খাট, নানা আকারের রান্নার বাসন, পুরনো চাকা লাগানো কাঠের ক্যাবিনেট, প্লাস্টিকের চেয়ার, দুটি রোদ লেগে বিবর্ণ। নতুন পিজি ঢুকছে ই ফোরে। রোজ নতুন নতুন ছেলে মেয়ের দল, রাস্তায় fffff হয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তাদের ভাষা জাভা, তাদের আশা ভিসা, পিঠে পিট্টু ব্যাগে টপাটপ ল্যাপটপ। তারা উড়ে আসছে রোজ। এসেই যাচ্ছে পরিযায়ী পক্ষীর মত। ভরে ফেলছে বুড়োমানুষগুলো টেঁসে যাওয়ার পর ফাঁকা হয়ে যাওয়া আস্তানাগুলো।
কিন্তু ই ফাইভের সামনে স্বর্গরথ লেখা সাদা গাড়ী। দেখলেই ভক্তি হয়। লোকে প্রণাম করতে করতে যায়। ভরতলাল ঠক্করের তিন নম্বর স্ট্রোক হল কাল। সেই স্ট্রোকই হল কাল। সকালে ডাক্তার চ্যাটারজী সার্টিফাই করে গেছে। তিনি নিজেই বেশ বুড়ো মানুষ। লোকজনের যাওয়ার হার আবাসনে দিন দিন বাড়ছে। সাতদিন আগে গেছেন সেন সাহেব। রিটায়ারড জজ। দেশে ভালো জজ কমছে। যেমন আসার তাড়া তেমন যাবারও তাড়া এই আবাসনে। কিন্তু রাস্তা বড্ড সরু।

🍂

কেউ কাউকে ছাড়বে না। ইনপুট আউটপুটে কলিসান। দুই ড্রাইভারের রেষারেষি। একজন হিন্দীতে, আরেকজন বাঙ্গালী কিন্তু সেও হিন্দীপ্রচেষ্ট বাংলায় লড়ে যাচ্ছে। চলছে ঝগড়া। কেউ রাস্তা ছাড়বে না। ইফাইভের সদ্যপিতৃহারা মেয়ে অন্বেষার করুণ অনুরোধ কেউ কানে তুলছে না। কাকের দল কিন্তু নির্বিকার ভাত খাচ্ছে। পচা ভাত। তাতেও অসুবিধে নেই। 
প্রায় দশ মিনিট কেটে গেল, কেউ পেছোবে না। এদিকে শবদেহ ধীরে ধীরে শক্ত হচ্ছে। গোয়েন্দা সিরিজ দেখে তুখোড় শহুরেরা জানেন একে বলে রাইগার মরটিস। মাছিরা খবর পাঠাচ্ছে তাদের পারটির লোকদের। তারা যোগ দেবে ঘাটে যাবার মিছিলে।
এদিকে চারজন মেয়ে বোর্ডার ফোন ঠেসে ঠেসে বিরক্ত। পঁচিশ থেকে তিরিশ বয়স হবে। দুজন পরেছে জিন্স আর টপ, একজন অফিস স্যুট, টাইটাও আছে, একজন একটু পয়সায় খাটো মনে হয়, পাঞ্জাবী পোশাক। শাড়ী আজকাল মডেল ছাড়া কেউ পরে না। বংশীর কাকার শাড়ীর ব্যবসা লাটে উঠেছে, করোনার সময় মাস্ক বেচে অনেক পয়সা করে এখন সে ইভেন্ট ম্যানেজ করে, বিয়েবাড়ী, শ্রাদ্ধ বাড়ী, আলোচনা সভা, হঠাৎ ফুটপাথের ধারে লেকচার দেবার পোডিয়াম সব। খুব ভালো চলছে ব্যবসা। 
নতুন মেয়েরা অস্থির হচ্ছে, কখন থেকে দাঁড়িয়ে পিজিপ্রবেশ করবে বলে। লম্বা মেয়েটা সিগ্রেট খাবার জন্য মনে হয় উশখুশ করছে, ব্যাগ খুলে একবার বার করেই ঢুকিয়ে দিল। সাহস হচ্ছে না, প্রথম এপাড়ায় আসা। বংশী সিগারেট ছেড়েছে দশ বছর হল। মনে মনে উপদেশ দেয়, খুকি, প্লীজ ওটি ছাড়ো। ধুর, কে শুনছে। 
ঝগড়া হয়েই চলেছে। মড়া আগে না ভাড়া আগে। বংশীবদন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নিরীক্ষণ করতে থাকে। দেরী হচ্ছে। মাংস সিদ্ধ না হলে বংশীবদনর দাঁতে আটকায়। দুটো কাক এবারে তাক করছে থলির দিকে। কিন্তু লেখক মানুষ, দেখাটা ওর পেশা। ছাড়া যাচ্ছে না এই দৃশ্য।
হঠাৎ শব্দ ওঠে পুলিশ, পুলিশ। কাকগুলো ফটাফট হুস করে উড়ে ইন্টারনেটের লাইনের ওপর গিয়ে বসে। পুলিশের গাড়ী এখন আর কালো নয়। ধবধবে সাদা। নিষ্পাপ। আধুনিক। ঝপাঝপ এক মেয়ে পুলিশ আর এক ছোট অফিসার লাফ দিয়ে নামে। 
পুলিশ চুপচাপ স্বর্গরথকে রাস্তা ক্লিয়ার করে দেয়। মেয়েগুলো বাড়ীতে ঢুকে পড়ে, সিগারেট ধরায়। মড়া দেখা শুভ না অশুভ? বোধহয় গুগল করে। চ্যাটজ্পিটি করে। মেটা করে। উত্তর মেলে না। ভেবে বংশীর হাসি আসে। এই সমাজ অরণ্যের গহন রহস্যের কতটুকুই বা এ আই জানে, শুধু ইংরিজী জেনে ফটফটি।
যাওয়া আসার রাস্তা এবার খুলে যায়। অবাধ। যাও, এসো, যার যেদিকে যাবার। চারটি সফটওয়ার শালিক এসে নতুন কোটরে ঢোকে। একটি মানুষের হার্ডওয়্যার স্বর্গ রথে চড়ে চলে যায়। রাস্তায় পড়ে থাকে অজস্র খই, কিছু ফুলের পাপড়ি, আর কুড়ি বাইশটা কাক, ওদের ভাত এখনো শেষ হয় নি। রোদের ফালি ঘুরে এসে ছুরির মত বিদ্ধ হয় গলিতে। রবিবারের সকাল নীল আকাশকে চোখ মারে। আকাশ বলে গুড মর্নিং কলকাতা। বংশীর মনটা ভার হয়ে যায়। স্খলিত হাতে চাবি ঘোরায় তার গুহায়। 

প্রিমিয়াম টেন্ডার গোট এখন মেরিনেট হচ্ছে। মিনিমাম দু ঘণ্টা, সুপ্তির পরামর্শমত। বংশী কাগজগুলো টেনে নিয়ে টেবিলে  বসে, ছোট্ট লেখার টেবিল, উল্টোদিকে একটা কম্পিউটার টেবিল, তাতে একটা পুরনো ল্যাপটপ। চটপট বানিয়ে নেয় এক কাপ লিকার টি, আর দুটো থিন। রুটিনমত এই সময় ওর লেখার সময়। একটু ছেঁড়া প্যাডটা টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করে। প্যাডের চেহারা সুবিধের নয়। এখানে ওখানে খামচা খামচা ছেঁড়া। কিন্তু বংশীর ধারণা, ওতে কিছু যায় আসে না, বড় লেখকরা একটু অগোছালোই হয়। ভাবতে ভাবতে টপাস করে থিন পড়ে যায় চাএর কুয়োয়। একবার সেদিকে তাকিয়ে, মনে মনে যাক গে বলে  বংশী মন দেয় লেখায়। 
‘মিনিগল্প এট দি স্টপ।
লেখক বংশীবদন (পদবী নেই)। 
হঠাৎ সব থেমে গেল। আকাশ থেকে একনাগাড়ে ঝরে পড়া বিধাতার অভিশাপ শেষ হলো। রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল তরল অভিশাপ। থেমে গেল   ম্যাজিকের মত। মানুষ ঘরের ভিতর ইঁদুরের মত আটকে ছিল, কোথাও বেরোতে পারত না। খাবার নেই আলো নেই, যানবাহন নেই যে দূরে এইসব থেকে পালিয়ে কোথাও চলে যাবে। ইন্টারনেট বন্ধ, পৃথিবীর সুখী সহৃদয় মানুষের কাছে সাহায্যের আবেদন করার কোন উপায় নেই। দূরে অন্য রাজ্যে, অন্য দেশের অন্য শহরে হয়ত হাওয়ায় ভেসেছে উজ্জ্বল এক ঝাঁক পারাবত। ভেসে যাচ্ছে বীয়ারের মত রোদ্দুর। আবার আর এক শহরে এখন সন্ধেবেলার উৎসব। ফিল্মি তারারা নাচতে মাটিতে নেমে এসেছে ঝলমলে রেস্তোরাঁয়। উন্মুখ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কাবাব, ককটেল আর জিমে খোদাই শরীরের সুবাস। তারা কি বুঝবে এখানে অন্ধকার কতটা। কেউ পারে? 
যখন মনে হলো আর পারা যাবে না, সর্বশক্তিময়েরও ইচ্ছে বা ক্ষমতা নেই এই সব লোকগুলোকে উদ্ধারের, কত জ্ঞানী ইউটিউবার ব্যাখ্যা করতে লাগলো কেন করুণাময় চাইছেন এই করুণ পরিণতি, তখনই হঠাৎ সব থেমে গেল। 
মুরুগণ বাইকটা ঠেলে ঠেলে স্টার্ট দিলো। দুধ আনতে হবে। ইডলি মাও আনতে হবে। রাস্তায় দুর্গন্ধ, ঘরের মধ্যে দুর্গন্ধ। পচা ব্যাং, গুগলি, ছোট্ট অক্টোপাস, সব আবার পরিষ্কার হবে। জটিল নকসা দিয়ে কোলম আঁকা হবে প্রাঙ্গণে । গরম ইডলি আর চাটনির গন্ধ পাল্লা দেবে মাল্লিপুর সুরভির সংগে। চেন্নাই শহরে বৃষ্টি থামলো দশ দিন পরে। 
দূরে, অনেক দূরে, এক যে ছিলো দেশ। সেখানেও হঠাৎ সব থেমে গেল। শিশুরা বেরিয়ে এসে খুঁজতে লাগল তাদের এখনও বেঁচে যাওয়া বন্ধুদের। কেউ ফিরে পেল তার পোড়া পুতুল। বন্ধ হলো আকাশ থেকে ঝরে পড়া বিধাতার অভিশাপ। বন্ধ হলো রাস্তায় ছুটতে থাকা মানুষের পিছনে তাড়া করা কৃত্রিম বুদ্ধিচালিত বোমারু পাইলটের দল। আবু আলেখ লিখতে বসলো ডেসপ্যাচ। অনেকদিন পরে আজ জানলা দিয়ে দেখেছে দুটো বাচ্চা ভাঙা বাড়ীর ভিতর থেকে বেরিয়ে বল খেলছে। টুকটুকে। লাল বল। লিখতে হবে আশার খবর। 
কিন্তু মাত্র চারদিন। শুধু চারদিন। চারদিনের সিজ ফায়ার। যুদ্ধবিরতি। বন্ধ আকাশ থেকে অক্লান্ত আগুনের বৃষ্টি। চারদিন পরে আবার শুরু। বিধাতার অভিশাপ আবার ঝরে পড়ল সেই দূরের শহরে। আমেরিকান রিপোর্টার ডেসপ্যাচ লিখলো, কাজ শেষ হবার দিকে এগোচ্ছে। তার ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল। দেখা গেল অজস্র ছড়িয়ে থাকা লালহলুদনীলগোলাপী শিশুর পোষাক। একটা কবি আগুনে ঝলসে যাচ্ছে, তার শরীর মাত্রাবৃত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে একটা মাংসের বৃত্ত হয়ে গেল। আর একটা লাল বল নিজে নিজে লাফিয়ে চলেছে। লাফিয়ে চলেছে। লাফিয়ে…. কোথায় যে গিয়ে পৌঁছবে কে জানে। 
মুরুগণের বাইক দুধ নিয়ে ফিরলো ঘরে। গরম ফিল্টার কাফি জন্ম নেবে এখন। জীবন কি সুন্দর।
আর সেই অন্য দেশে আবার ঝলসাতে লাগলো হ্যাম বারগারের প্যাটির মত, মানুষের মাথা, বিস্ফোরণের দ্মকায় উড়তে লাগল সীমানাহীন পাগল ডাক্তারদের ইউনিফর্ম, আর হাসিখুশি সেনারা টিপ করে করে শিকার করতে থাকল ছোট ছোট বাচ্চাদের। এক গুলিতে একটা মাথা। খেলা চলতেই থাকল। থামল না। থামবে না।
-ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments