জ্বলদর্চি

বাঘ তাড়ানো হবু /সুদেব কুমার ঘোষ

ছোটগল্প

বাঘ তাড়ানো হবু
                   
সুদেব কুমার ঘোষ

এক গ্রামে হবিন্দ্র নামে এক চাষী বাস করত। সম্পন্ন চাষী। মজুর নিয়ে যেমন চাষ করে তেমনি নিজেও নিজের জমিতে কাজ করে। মাঝারি গড়ন। গায়ের রং ফর্সা। তবে রোদে কাজ করে গায়ের রং কিছুটা তামাটে বর্ণের হয়ে গেছে। সহজ সরল মানুষ। তবে বেশ বুদ্ধি ধরে কাজ করে । এরকম পরিচয় তার অনেক পাওয়া গেছে। যেমন এই সেদিন গ্রামে এক চোর ধরা পড়ে। গ্রামবাসীরা চায় চোরকে গাছে  বেঁধে প্রহার করা হোক। অনেকে বলল "মরে যেতে পারে।" কেউ কেউ বলল "মরে তো মরুক। চোরকে মেরে ফেলায় ভালো। "আবার কেউ কেউ বলল "আমরা মারধর না করার থেকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ায় ভালো।" এই দলে লোকসংখ্যা মুষ্টিমেয়। চোরকে শাস্তি দেওয়ার নেশায় তাদের কথাকে কেউ গুরুত্ব দিলনা। হবিন্দ্র ভিড়ের মাঝ থেকে বলে উঠল "আমার একটা বক্তব্য আছে।" সবাই তার দিকে তাকাল। সবাই জানে হবিন্দ্রের কথার একটা গুরত্ব আছে ।বয়স্ক লোকেরা তাকে আদর করে হবু বলে ডাকে ।একজন বয়স্ক লোক বলল " হবু , বল। তোমার কী বক্তব্য।"
হবু গামছাতে মুখ মুছে বলল "চোরকে আমাদের শাস্তি দেওয়ার থেকে ,ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া ভালো। কারণ পুলিশ আইন অনুযায়ী কাজ করবে। আমরা আইন হাতে তুলে নেব কেন ? চোরের বাড়ির লোক যদি কেস করে তাহলে আমাদের সকলকে পুলিশ ধরতে পারে।"
কথাটি সকলের মনে ধরল। দু - একজন প্রতিবাদ করল বটে, কিন্তু ধোপে টিকলনা। এরকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে হবুর। মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে জানে। হবুর সংসার আছে। ঘরে বউ আছে। ছেলে -, মেয়ে আছে। তারা স্কুলে পড়ে। একদিন হবু মজুর নিয়ে মাঠে ধান রোপণ করছে। দিনের অন্তিমলগ্নে মজুরদের ছুটি দিয়ে একায় ধান রোপণের কাজ করছে। সামান্য অংশই বাকি ছিল। মাঠে কেউ নেই। সূর্য্য অস্তমিত। প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে মাত্র। এমন সময় পাশের জঙ্গল থেকে তিনটি বাঘ বেরিয়ে এল। হবুর সামনে দাঁড়াল। হবুর নাম - ধাম জিজ্ঞেস করার পর বলল "হবু তোকে খাবু।"
হবু মাথা ঠান্ডা রেখে বলল "আচ্ছা , সে এখন হবে।দেখতে পাচ্ছিস তো এতটা ধান রোপণ করতে বাকি আছে। আগে সবাই মিলে আমার ধান রোপণ করে দে। তারপর খাবি।"

🍂

বাঘ তিনটে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিল।পরে বলল "ঠিক আছে। আমরা তোর ধান রোপণ করে দিচ্ছি। তারপর তোকে কিন্তু খাব।"
হবু এবং তিনটি বাঘ মিলে খুব তাড়াতাড়ি ধান রোপণের কাজ শেষ করল। কাজের শেষে তিনটি বাঘ আবার জিদ ধরল " হবো এবার তোকে খাবো।"
হবু মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলল " খাবি তো খাবি। কিন্তু আমি দেখতে চাই তোরা কেমন কাজ করেছিস।তোরা তো ধান রোপণ করলি। কেমন ধান হলো দেখি। যদি ভালো ধান হয়,তাহলে সেগুলি তো কাটতে হবে। কেটে ঘরে তুলে দিতে হবে।"
সর্দার বাঘ বলল "ধান হতে তো অনেক দেরী।কমকরে তিন মাস। সেই ফাঁকে তুই তো কোথাও পালিয়ে যাবি। না। তা হচ্ছে না। আমরা এক্ষুনি খাবো।"
হবু বলল  "তা কি হয়। আমার জমির ধান আমাকে কাটতে হবেনা। ধান না কাটলে ছেলেপুলে সম্বৎসর খাবে কী ? আমাকে আসতেই হবে। তাছাড়া ধান লাগিয়ে দিলেই কি ধান হয়ে যাবে ? তার পরিচর্যা আছে। সার দিতে হবে। জল দিতে হবে। কতবার এখন আসতে হবে তার ঠিক নেই। "
বাঘ তিনটি কী বুঝল কে জানে। সর্দার বাঘ বলল "ঠিক আছে। আমরাও দেখতে চাই আমরা কেমন কাজ করেছি।"
হবু তাদের আশ্বস্ত করে বলল "তোরা জঙ্গলে অপেক্ষা কর। আমি যেদিন কাস্তে হাতে আসব মনে করবি ধান কাটতে আসছি। সেদিন তোরা চলে আসবি । আমি আর কোনো মজুর করব না। তোরাই ধান কাটবি।"
বাঘ তিনটি " ঠিক আছে" বলে বনে ঢুকে গেলো। হবু ঘরে ফিরে এলো।
হবু মাঝে মধ্যে জমি পরিদর্শনে যায়। ধানের পরিচর্যা করে। জল দেয়। সার দেয়। কার্তিক মাসে ধান ফ লতে শুরু করেছে। অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি নাগাদ সোনালী রঙের ধানগুলি মাথা নত করেছে। হবু দেখল এবার ধান কাটার সময় হয়ে এসেছে। সে কাস্তেতে শান দিয়ে রাখল। একদিন কাস্তে হাতে ধান কাটতে যায়। বাঘ তিনটি সেই মুহূর্তে বেরিয়ে আসে।হবুকে দেখে তারা বলে "আজ কি ধান কাটা হবে?" 
হবু বলে "ধান কাটার জন্যই তো আসছি। তোরা যদি লাগিস তাহলে আজই শুরু করব।"
বাঘ তিনটি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বলল "আমরা রাজী। আসলে ধান কাটা হলেই তো তোকে খাবো। তাই আমরা রাজী।"
হবু বলল "বেশতো, তাহলে কাটতে লেগে পড়।"
হবু এবং তিনটি বাঘ কাস্তে হাতে নিয়ে ধান কাটতে শুরু করে দিল। ধান কেটে ঘরে তুলে দিল। দিনের শেষে আবার সেই কথা তুলল "হবো এবার তোকে খাবো। মাঠে চল। বেশ যুত করে খাবো। হাড় গোড় চিবিয়ে চিবিয়ে খাবো। ওহ্ ! কতদিন মনুষ্য মাংস খাইনি। কি রে আনন্দ হচ্ছে।" বলে তারা হবুর চারদিকে ঘুরতে লাগল।
হবু বলল "সে হবে এখন । ধান তো ঝাড়াই মাড়াই হলো। এর সাথে যে পোহাল বেরিয়েছে সেগুলো তো ঝাড়াই মাড়াই করতে হবে।"
বাঘ তিনটি খুব রেগে গেল। বলল " এরকম তো কথা ছিলনা। তুই কেবল সময় নিয়ে টালবাহানা করছিস।আমাদিকে নিয়ে একটার পর একটা কাজ করিয়ে নিচ্ছিস। আর বলছিস "খাবিতো খাবি।এই কাজটা কর । ওই কাজটা কর। এ সব আর কোনো কথা শুনব না।" 
হবু ঠাণ্ডা মাথায় বলল "তোরা সব কাজ করলি, আর এই শেষ কাজটা করবিনা ? এই সামান্য কাজটার জন্য আমি কাকে ডাকব  বল।?"
বাঘ তিনটি হবুর কথায় কিছুটা শান্ত হল। সর্দার বাঘ বলল "এই কাজটা করে দিচ্ছি। এরপর কিন্তু আর কোনো কথা শুনবনা।"
"কিন্তু এই কাজটার জন্য দুদিন সময় দিতে হবে। এই কাজটার জন্য কিছু সাজ - সরঞ্জাম লাগবে । সেগুলি জোগাড় করি। দুদিন নাহয় তোরা আমার গোয়াল ঘরে থাক।"বলে হবু বাড়ির অন্দরে চলে গেল।
দুদিন পরে হবু কামার ঘর থেকে লোহার তৈরী মোটা শিকল, একটি মোটা লোহার খুঁটি এবং একটি লোহার দণ্ড কিনে নিয়ে এল। খামারের মাঝখানে বেশ কিছুটা গর্ত করে লোহার খুঁটি পুঁতে দিল। শিকলে বাঁধা লোহার রিংটি খুঁটিতে গলিয়ে দিল। এবার বাঘ তিনটিকে ডেকে নিল। প্রথমে সর্দার বাঘকে শক্ত করে শিকল দিয়ে বাঁধল। তারপর অন্য দুজনকেও বেশ আঁটো সাঁটো করে বাঁধল। এরকম করে শক্ত করে শিকল দিয়ে বাঁধার যুক্তি খুঁজে পেলনা বাঘ তিনটি। তারা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। সর্দার বাঘ বলল " হবু , আমাদের এরকম করে বাঁধ ছিস কেন ? গলায় কি লাগছে মাইরি।
হবু বলল " দেখ , তোরা হয়ত জানিস না । পোহাল মাড়াই করার জন্য এভাবেই বাঁধতে হয়। " 
বাঁধা হয়ে গেলে হবু তাদের বলল "তোরা ঘুরতে থাক। তাহলেই কাজ হয়ে যাবে। আমি একটু তামাক খেয়ে নিই।" হবু তামাক খেতে ঘরে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে দেখল বাঘ তিনটি দাঁড়িয়ে আছে। ঘুরছেনা । হবু খুব রেগে গেল। লোহার ডান্ডাটি হাতে নিয়ে তাদের দমকা প্রহার করতে লাগল। মুখে বলল "তোদের ঘুরতে বলেছি । তোরা ঘুরলিনা কেন?"
বাঘ তিনটি মার খেয়ে প্রায় আধমরা হয়ে গেছে পালাতেও পারছেনা। কারণ লোহার শিকল ছিঁড়তে পারছেনা। তারা তখন হবুকে অনুনয় - বিনয় করে ছেড়ে দিতে বলল।  বলল  "আর তোকে খাবনা। আমাদের এবার ছেড়ে দে। "
হবু বলল "ঠিক বলছিসতো ?"
সর্দার বাঘ বলল --- "তিন সত্যি করে বলছি, তোকে খাবনা। আমাদের ছেড়েদে। তোর পায়ে পড়ি।"
হবু তখন মরিয়া হয়ে গেছে। এই সুযোগ। এদেরকে এ তল্লাট থেকে তাড়াতে হবে। তা নাহলে ওরা আমাকে খাবে আর আমার পরিবারের সবাইকে খাবে । তারপর গ্রাম শুদ্ধ সবাইকে সাবাড় করবে।  আবার তাদের প্রহার শুরু করল। বাঘগুলির প্রাণ ওষ্ঠাগত।তারা আবার হবুর কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইল। তা।রা বলল "আমরা আর তোকে খাবার কথা বলবনা।আমাদের এবার ছেড়ে দে।"
তাদের কান্না শুনে পাড়ার লোকজন ছুটে এল। তারাও বাঘের ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইল।
এদিকে হবু তাদের বলল "কেবল আমাকে নয় , তোরা শপথ কর যে আর কোনোদিন মানুষ খাবনা।"
বাঘগুলি তাতেই রাজী হল। হবু এক এক করে বাঘগুলির বাঁধন খুলে দিল। বাঘগুলি দৌড়ে পালিয়ে গেল। পিছন ফিরে তাকালো না। পাড়ার তথা দেশের লোকজন হবুর তারিফ না করে পারলনা। তারা আরো একবার হবুর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেল।

Post a Comment

0 Comments