কমলিকা ভট্টাচার্য
কলির জীবনে আজ এক নতুন অধ্যায়ের শুরু। ইউনাইটেড কিংডমের সাউথহ্যাম্পটনের মিট্রি ইনফ্যান্ট এন্ড প্রাইমারি স্কুলে তার প্রথম দিন। চাকরি জীবন শুরুরও প্রথম দিন তাও আবার বিদেশের মাটিতে ,একটু নার্ভাস লাগছিল বটে, তবে উত্তেজনাও কম ছিল না।
স্কুলের সদর দরজা পেরিয়েই কলি দেখল বড় একটা খেলার মাঠ, তার পাশে ছোট ছোট ক্লাসরুম, লবি, লাইব্রেরি, আর বাচ্চাদের খেলার নানান জায়গা। স্কুলটা ছোট হলেও, বেশ সাজানো-গোছানো আর প্রাণবন্ত।
প্রিন্সিপাল মিস্টার মে হাসিমুখে কলিকে স্বাগত জানালেন। "ওয়েলকাম, মিস কলি! আশা করি, তোমার নতুন পরিবেশ পছন্দ হবে।"
তারপর তিনি একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলার দিকে ইশারা করলেন। "জেনি, তুমি কি আমাদের নতুন টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টকে সব দেখিয়ে দেবে?"
জেনি হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল, "চলো, তোমাকে তোমার ক্লাসরুমটা দেখাই। তুমি মিসেস ব্র্যাডলির সঙ্গে কাজ করবে। তিনি খুবই ভালো একজন শিক্ষক, তোমার কাজ সহজ হবে।"
কলি যখন ক্লাসরুমে ঢুকল, মিসেস ব্র্যাডলি তার ছাত্র-ছাত্রীদের বললেন, "এই যে বাচ্চারা, আমাদের নতুন টিচার এসেছেন মিস কলি, উনি তোমাদের অনেক কিছু শেখাবেন। সবাই হ্যালো বলো !"
🍂
বাচ্চারা কচি গলায় বলে উঠল, "হ্যালো মিস কলি!"
কলি মিষ্টি হেসে হাত নাড়ল, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল সে নিজের সর্বোচ্চটা দেবে এই শিশুদের জন্য।
কলির কাজ ছিল বিশেষভাবে সক্ষম কিছু শিশুর সঙ্গে, যারা পড়তে-লিখতে পারে না কিংবা স্বাভাবিক ভাবে অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারে না। সেখানেই তার দেখা হল ছোট্ট পাঁচ বছরের ছেলেটি, আব্বাসের সঙ্গে।
মিসেস ব্র্যাডলি ফিসফিস করে বললেন, "আব্বাস বাংলাদেশের ছেলে। ওর পরিবার এখানে একটা কারি শপ চালায় কিছুদিন আগেই এসেছে। কিন্তু ও খুব চুপচাপ থাকে, কাউকে কিছু বলে না, পড়াশোনায় মন দেয় না, এমনকি মাঝেমাঝে অন্য বাচ্চাদের মারে। ওকে বোঝানো বেশ কঠিন।"
কলি আব্বাসের দিকে তাকাল। ছোট্ট ছেলেটি এক কোণে বসে ছিল, চোখে একরাশ অনিশ্চয়তা আর গুটিয়ে থাকা ভাব। কলি তার পাশে গিয়ে বসল।
"তোমার নাম আব্বাস, তাই তো?"
আব্বাস তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না।
কলি একটু হেসে বলল, "তুমি জানো, আমি তোমারই ভাষায় কথা বলতে পারি?"
আব্বাসের চোখে বিস্ময়। এই প্রথম সে যেন একটু নড়েচড়ে বসল।
"তোমার আম্মু কি তোমাকে গল্প বলে?"
আব্বাস আস্তে করে মাথা নাড়ল।
"আমিও গল্প বলতে পারি। শুনবে?"
আব্বাস এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল কলিকে, যেন বোঝার চেষ্টা করছে, সত্যিই এই মিস কলি বাংলা বলে কিনা!
কলি একদিন তাকে বলল, "আচ্ছা, তুমি কি জানো, পিঁপড়েরা কত শক্তিশালী?"
আব্বাস অবাক হয়ে তাকাল, "পিঁপড়ে?"
"হ্যাঁ! ওরা অনেক ভারী জিনিস তুলতে পারে, আর ওরা কখনো একা চলে না সবার সাথে মিলে থাকে। তুমি একটা মজার গল্প শুনবে।"
আব্বাস আস্তে করে মাথা নাড়ল।
সেইদিন দুপুরে আব্বাস কলিকে টেনে নিয়ে গেল স্কুলের প্লে গ্রাউন্ডের এক কোণায়। "দেখো, এখানে একটা পিঁপড়ের বাসা আছে!"
কলি মুগ্ধ হয়ে দেখল। "তুমি খুব ভালো করে খেয়াল করো সবকিছু, তাই না?"
আব্বাস গর্বিতভাবে মাথা নাড়ল।
দিন যেতে লাগল, আর ধীরে ধীরে আব্বাস বদলাতে লাগল। বাংলা ভাষার উষ্ণতায় সে যেন আপন করে নিল কলিকে। কলি ছোট ছোট গল্প বলে তাকে পড়তে শেখাত, ছবি আঁকার মাধ্যমে শব্দ শেখাত। ধীরে ধীরে আব্বাস অক্ষর চিনতে লাগল, শব্দ পড়তে শিখল, এমনকি নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিশতেও শুরু করল।
কলির পড়ানোর পদ্ধতি শুধু আব্বাসকেই নয়, অন্য বাচ্চাদেরও খুব আকৃষ্ট করেছিল। তার গল্প বলা, ছবি আঁকা, আর হাসিঠাট্টা শেখার পরিবেশটাকে আনন্দময় করে তুলেছিল।
মিসেস ব্র্যাডলি, মিস্টার মে সবাই কলির বাচ্চাদের সঙ্গে এই অল্প সময়ের মধ্যে মিশে যাওয়া নিয়ে তাকে সব সময় প্রশংসা করত এবং বাচ্চাদের মধ্যে অভাবনীয় পরিবর্তনের জন্য তারা কলিকে বারবার ধন্যবাদ জানাত।
একদিন এক মজার ঘটনা ঘটল। সেদিন কোনো ইন্ডিয়ান ফেস্টিভ্যাল ছিল ,তাই কলি একটু সেজেগুজে ছিল।কলি যখন ক্লাসে ঢুকল, বাচ্চারা কৌতূহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল।
"মিস কোলি, এটা কী?" এক ছাত্র তার কপালের দিকে ইশারা করল।
কলি বুঝল, তারা তার টিপ নিয়ে প্রশ্ন করছে। সে হেসে বলল, "এটা আমার তৃতীয় চোখ! এটা দিয়ে আমি তোমাদের সব দেখতে পারি, এমনকি যখন তোমরা বাড়িতে থাকো তখনও!"
সব বাচ্চারা হেসে উঠল, কেউ কেউ তো মুখ ঢেকে বলল, "ও মাই গড!"
ছয় মাসের মধ্যে আব্বাস পুরোপুরি বদলে গিয়েছিল। এখন সে হাসত, পড়ত, লিখত, বন্ধুদের সঙ্গে খেলত। সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল তার এই পরিবর্তন দেখে।
আর কলির সাথে তার যত মনেরকথা, নতুন নতুন গল্প ,তার বেশির ভাগই তার পরিবেশে আবিষ্কার করা নতুন নতুন জিনিসের বাসা কখন পাখির ,কখন লেডিবার্ড,কখনোবা কোনো মাটির পোকা।
হয়ত ও নিজের মাটি নিজের দেশ, নিজের বাসা, নিজের ভাষাকে খুব মিস করত আব্বাস।
আব্বাস আর কলির মধ্যে যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল মাতৃভাষার টানে তা শুধু আব্বাসকে নয় কলিকেও নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে অনেক সাহায্য করেছিল।
এই রকম ভাবে বেশ চলছিল একদিন কলি জানাতে পারল তার হাজব্যান্ড এর প্রজেক্ট শেষ তাদের দেশে ফিরে যেতে হবে।
বিদায়ের দিন, পুরো স্কুল মন খারাপ করে বসেছিল।
কিন্তু শুধু আব্বাস ছিল ভীষণ খুশি,ছুটে এসে কিছু না বলে কলির হাতে একটা কাগজ দিল।
কলি অবাক হয়ে দেখল, সেখানে পেন্সিলে আঁকা পাশের গাছের পাখির বাসাটা যেটা ক্লাসরুম থেকে দেখা যেত আর আব্বাস মাঝেমাঝে সে দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যেত,
ছবির পাশে লেখা—
"I love you, I miss you, Koli Didi."
কলির চোখে জল এসে গেল।
"তুমি জানো, আমাদের দেশে যখন আমরা ছোট ছিলাম, আমরা আমাদের শিক্ষিকাদের 'দিদি' বলে ডাকতাম?"
আব্বাস মাথা নাড়ল,"আম্মি বলেছে।"
কলি বলল," আব্বাস তুমি আমাকে মিস করবে কিন্তু তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে আমি চলে যাবো শুনে তুমি খুব খুশি হয়েছো।"
আব্বাস মাথা নামিয়ে আস্তে করে বলল,"মিস তুমি যে তোমার নিজের বাসায় ফিরবে।"
আব্বাস দৌড়ে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলায় মেতে গেল।
কলি অবাক হয়ে
দাঁড়িয়ে রইল প্লে গ্রাউন্ডে সেই গাছটার নিচে, যেখানে বসে আব্বাস তাকে প্রথমবার পিঁপড়ের বাসা দেখিয়েছিল। গাছের ডালে একটি ছোট্ট পাখির বাসা দুলছিল।
সেদিন সেই ছোট্ট আব্বাস রেখে গেল সবার জন্য একটা বড় শিক্ষা আমাদের বাসা ,আমাদের ভাষা থেকে দূরে গিয়ে আমরা কখনো মুক্ত ভাবে বাঁচতে পারিনা, ঠিক
করে কিছু শিখতেও পারি না।
কলি পিঁপড়ের বাসা টার দিকে তাকিয়ে বলল, "ধন্যবাদ, আব্বাস... ধন্যবাদ !"
হাওয়ায় উড়ে আসা কয়েকটা শুকনো পাতা তার পায়ের সামনে পড়ল। কলি সেটাকে আলতো করে তুলে হাতে নিল, যেন এই স্মৃতিটুকু সে চিরদিন বয়ে নিয়ে যেতে চায়।
1 Comments
খুব সুন্দর গল্প।
ReplyDelete