জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২৩০কোরিয়া (এশিয়া)ব্যাঙ ডাকে বৃষ্টি এলে /চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 
দূর দেশের লোকগল্প— ২৩০
কোরিয়া (এশিয়া)
ব্যাঙ ডাকে বৃষ্টি এলে
চিন্ময় দাশ

অনেক কাল আগের কথা। ছোট্ট একটা পুকুরে একটা ব্যাঙ থাকত। আর থাকত তার ছেলেও। মায়ের একমাত্র ছেলে। কিন্তু মায়ের মনে সুখ নাই। ছেলেটা ভারি অবাধ্য। মায়ের কোনও কথাই সে শোনে না। শুধু তাই নয়। মা যেটা বলবে, ছেলে করবে তার ঠিক উলটোটা। 
মা হয়ত বলল—ঘরে বসে আছিস কেন? পাহাড়তলিতে গিয়ে, খেলাধুলো করে আয় না। ছেলে হাঁটল ঠিক উলটো পথে। সোজা নদীতে গিয়ে হাজির হয়ে গেল। উপরে যেতে বললে, সে যাবে নীচে। ডাইনে বললে, বাঁয়ে। আসলে, এটা বললে, ওটা সে করবেই। 
এমন ছেলেকে নিয়ে সব মায়েরই দুশ্চিন্তা হয়। ব্যাঙেরও হয়েছে। এই এক চিন্তাই তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে সব সময়—ছোট-বড় আরও কতো ব্যাঙই আছে পুকুরে, কেউ তো এর মতো নয়। বড়দের কেন মান্য করে না এ ছেলে? কেন অবাধ্য হয় সব কথার? 
সব সময় মন মরা হয়ে থাকে মা। সব সময় একটাই ভাবনা, আমি মরে গেলে, কী হবে এই ছেলের? আমাকেই কিছু একটা করতে হবে। যাতে বদ স্বভাবটা বদলানো যায়। 
কতো বোঝায় ছেলেকে। কতো বকাঝকা করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। ছেলে চলেছে নিজের মর্জি মতো। বদল নাই এক্টুও।
এভাবেই দিন যায় । দিন যায়, সপ্তাহ যায়। সপ্তাহ যায়, মাস যায়। মাস যায়, বছর যায়। বছর যায়, আর মায়ের বয়স বাড়ে। ভাবতে ভাবতে যা হয়! একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে মা। তখনও ছেলে কিন্তু আছে ছেলের মতই।
একদিন মায়ের এই-যাই সেই-যাই অবস্থা। মা বুঝে গেল, আর নয়। যাবার সময় হয়ে গিয়েছে। সারাটা জীবন এই ছোট্ট একটা ডোবায় কেটে গিয়েছে। মা ব্যাঙের মনে সাধ আছে একটা।
আমরা সোনাব্যাঙেরা হোলাম জলের জীব। বিধাতা পুরুষই এই জলের জগৎ বেছে দিয়েছেন আমাদের জন্য। সারাটা জীবন এই জলেই কেটে গেল। ডাঙা কেমন জানলামই না। পাশেই কত বড় একটা পাহাড়। কিন্তু দেখাই হোল না আমার। মারা গেলে, ঐ পাহাড়ের তলায় যেন কবর দেওয়া হয় আমাকে, কোন নদী বা জলাশয়ের ধারে নয়।

🍂

জীবনভর এই ছোট্ট একটা সাধই সে পুষে রেখেছে
মনে মনে। কিন্তু এ কাজ তো করতে হবে তার ছেলেকে। সেই ছেলে, যে সারা জীবন তার একটা কথাও শোনেনি। এক বললে, দুই করে রাখে। তাই, মনে মনে একটা উপায় বার করল মা।
একদিন ছেলেকে ডেকে পাশে বসাল। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে, আদর করে বলল—আমি আর বাঁচব না, বাছা। একটা সাধ আছে আমার। সেটা পূরণ করতে হবে তোমাকে।
ছেলেও বুঝেছে, মা আর বেশিদিন বাঁচবে না। সে বলল—বলো তুমি। কী তোমার সাধ?
মা বলল—আমরা জলের জীব। বিধাতা এটাই বেছে দিয়েছে আমাদের জন্য। মরার পরেও, এখানেই থাকতে চাই আমি। পাহাড়তলির কথা মনেও আনবি না। কথা দে আমাকে।
ছেলে অভ্যাস মতো বলল—কথা দিলাম তোমাকে। চিন্তা কোর না। ভুলে যাব না।
এ ছেলেকে মা খুব ভালোই চেনে। তার কথা শুনে, মা বেশ নিশ্চিন্ত হোল। ঠিক বিপরীতটাই করবে তার ছেলে। পাহাড়তলীতেই নিয়ে যাবে মাকে। তাতে জীবনের একটা সাধ অন্তত পূরণ হবে তার। জলের জীব, মৃত্যুর পরেও, জলেই থাকতে হবে না।
দিন চারেক বাদে, মা সত্যিই মারা গেল। দুনিয়ায় নিজের বলতে এখন আর কেউ নাই তার। এই পুকুরে আরও এতগুলো ব্যাঙ আছে। কিন্তু সে একেবারে একাই। আপন কেউ নাই। এই প্রথম বার সত্যি সত্যিই মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হোল অবাধ্য ছেলের। 
মনে পড়ে যাচ্ছে সারা জীবনের কথা। কত অবাধ্য হয়েছে মায়ের। কোন দিন মায়ের কোন একটা কথা ঠিকঠাক শুনেছে, মনেই পড়ল না। সারা জীবন ধরে, অবাধ্যতাই করে এসেছে মায়ের সাথে। নিশ্চয় মা কষ্ট পেয়েছিল মনে মনে। কিন্তু আজ তো আর করবার কিছু নাই। ভুল যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। আজ আর সুযোগ নাই শুধরে নেবার। 
এই বার ছেলের মন বলল—যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। সেই শেষ, আর নয়। সারা জীবন কোন কথা শুনিনি মায়ের। এখন আর উলটো পথে চলব না। মায়ের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ আমি করবই। মাকে কথা দিয়েছি আমি। সেটা রাখতেই হবে আমাকে।
মরা মাকে নিয়ে নদীর পারে হাজির হোল ব্যাঙ। যদিও তার মন বলছে, এখানে মাকে কবর দেওয়াটা বিবেচনার কাজ নয়। বৃষ্টি নামলে, জল বাড়বে নদীর। পাহাড়ি নদী বয়ে যাবে দু’কূল ভাসিয়ে। মাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে নিশ্চয়। 
কিন্তু তার মন বলল, মায়ের শেষ ইচ্ছা, এখানেই যেন তাকে মাটি চাপা দেওয়া হয়। তাছাড়া, কথাও দিয়েছি আমি। শেষ কথাটা আমি রাখবই। 
মা মনে মনে চেয়েছিল পাহাড়তলির কথা। ডাঙার জন্য মন কেঁদেছিল মায়ের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, সেই জলের ধারেই ঠাঁই হোল মায়ের!
তার পর? তার পর দেখতে দেখতে গ্রীষ্মকাল এসে গেল। তার পেছন পেছন এল মৌসুমী বায়ুর দল। জল্ভরা কালো মেঘদের তাড়িয়ে আনল তারা। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল বন-পাহাড়, মাঠ-ঘাট জুড়ে।
নদীর পাড়ে দৌড়ে এসেছে ব্যাঙ ছেলে। তার সাথে এসে গিয়েছে পুকুরের অন্য ব্যাঙেরাও। নদী তখন ফুলে ফেঁপে উঠতে লেগেছে জলের তোড়ে। বুকটা ছাঁৎ করে উঠল ছেলের। এবার বুঝি তার মাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে নদী।
চিৎকার করে, বিধাতা পুরুষকে ডাকতে লাগল—দোহাই ঠাকুর, আমার মাকে তুমি ভাসিয়ে নিয়ে যেও না!
ছেলেটার সাথে ব্যাঙেদের পাড়া শুদ্ধ ডাক পাড়তে লাগল গলা ছেড়ে—গ্যাঙর গ্যাঙ! গ্যাঙর গ্যাঙ! জলের স্রোতে ভেসে ভেসে, সেই শব্দও ভেসে যেতে লাগল। সে শব্দ পৌঁছাতে লাগল অন্য ব্যাঙেদের পাড়ায় পাড়ায়। তারাও ডাকতে শুরু করল গলা ছেড়ে। 
সেই শুরু। শুরু হয়েছিল কোরিয়ায়। তার পর সেটা ছড়িয়ে পড়েছিল দুনিয়া জুড়ে। আকাশে কালো মেঘ দেখলেই, বিধাতাকে ডাক পাড়তে শুরু করে ব্যাঙেরা। আজও দুনিয়ার দেশে দেশে বৃষ্টিফোঁটা পড়বার সাথে, ব্যাঙেদের ডাক একাকার হয়ে যায়।

Post a Comment

0 Comments