কমলিকা ভট্টাচার্য
ডে - ১
শিবরাত্রির সকালে নন্দিনী খুব ব্যস্ত। প্রতিদিনের ঘরকন্নার পাশাপাশি আজ শিবরাত্রির বিশেষ পুজো, ভোগের জন্য পায়েসও রান্না করতে হবে। তার স্বামী দীপ্তর অফিসে ছুটি নেই, তাই সব কিছু একাই সামলাতে হচ্ছে। চেন্নাইয়ে কাজের লোক রাখা তার পক্ষে কষ্টসাধ্য—স্থানীয় ভাষা বোঝে না বলে কাউকে কাজ বুঝিয়ে দেওয়াটা বড় ঝামেলা। তাই সব কাজ নিজেই করে নেওয়াই তার অভ্যাস।
দীপ্ত প্রতিদিন সকালে হাঁটাতে যাওয়ার আগে দুধের প্যাকেটগুলো ধুয়ে ফ্রিজে রাখে। আজ নন্দিনী তাকে বলে ঠাকুরের পুজোর জন্য দুধ বাইরে রাখতে। দীপ্ত দুধ নিতে গিয়ে দেখে, প্রতিদিনের দুটো প্যাকেটের সঙ্গে এক লিটার দুধের কাঁচের বোতলও আছে! অবাক হয়ে সে নন্দিনীকে জিজ্ঞেস করে, সে কি আজ বাড়তি দুধ অর্ডার করেছিল? নন্দিনী তখন নানা কাজে ব্যস্ত, তাই না দেখেই বলে, "না, আমি দিইনি। তবে ওরা হয়তো কোনো নতুন প্রোডাক্ট প্রমোশনের জন্য দিয়েছে। আজ শিবরাত্রি তো!"
স্নান সেরে নন্দিনী পুজোর ঘরে ঢোকে। প্রতিদিনের নিত্য পুজো সেরে শিবরাত্রির বিশেষ পুজোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ফ্রিতে পাওয়া আনপ্রসেসড কাউ মিল্ক দেখে মনে মনে খুশি হয়—কাঁচা দুধ শিবের মাথায় চড়ানোর সুযোগ পেয়ে সে মনে করে, এ যেন শিবেরই ইচ্ছা!
পায়েস বানানোর সময় হঠাৎ মনে পড়ে, ঠাকুর ঘরের গোবিন্দভোগ চাল, গুড়, কাজু-কিশমিশ সব রান্নাঘরে নিয়ে গিয়েছিল, আর সেগুলো এঁটো হয়ে গেছে। একটু চিন্তায় পড়ে যায় সে। ভাবতে থাকে, অ্যাপ থেকে অর্ডার করলে পাঁচ মিনিটেই চলে আসবে। এই সময়ে এসব অ্যাপ দারুণ কাজে লাগে! নন্দিনীর ছেলেরা মজা করে বলে, "মাম্মি, তোমার জন্যই এই কোম্পানিগুলো চলছে!"
সে অর্ডার দিতে যাবে, এমন সময় চোখ পড়ে অন্নপূর্ণা মন্দির থেকে আনা হলুদ ব্যাগটির দিকে। মনে পড়ে, ওই ব্যাগে চাল থাকার কথা। ব্যাগ খুলে সত্যিই চাল পায়! তার সঙ্গেই একটা ছোট্ট প্যাকেট। খুলে দেখে, ভিতরে মিছরি! অবাক হয়ে যায় সে—এ যেন অলৌকিক ঘটনা! কিছুদিন আগেই ওরা কর্নাটকের অন্নপূর্ণেশ্বরী মন্দিরে গিয়েছিল, যেখানে বিশ্বাস করা হয়, শিব নিজেই মা অন্নপূর্ণার কাছে ভিক্ষা চেয়েছিলেন!
নন্দিনী তাড়াতাড়ি পায়েস রান্না শুরু করে। রান্নার মাঝে আবার চিন্তা আসে—আজ বাবার ভোগে কাজু-কিশমিশ দেওয়া হবে না!
চাল সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর যখন মিছরির প্যাকেট খুলে পায়েসে ঢালে, তখন হতবাক হয়ে যায়—মিছরির সঙ্গে কাজু-কিশমিশও মেশানো!
কখনো কখনো কিছু ঘটনা ব্যাখ্যার অতীত হয়। শুধু বিশ্বাস করলেই মন শান্তি পায়।
পুজো শেষ করে নন্দিনী প্রসাদ ভাগ করে দেয়। প্রথমে সিকিউরিটিকে দেয়, তারপর হঠাৎ মনে হয়, পাশের ফ্ল্যাটের তামিল প্রতিবেশী সঙ্গীতাদেরও দেওয়া উচিত,ওরাও বড় শিবভক্ত! ওরা প্রসাদ পেয়ে খুব খুশি হয়।
রাতে দীপ্ত আর নন্দিনী প্রসাদ খেতে বসে। দীপ্ত বলে, "এটা শুধু পায়েস নয়, অমৃত!"
নন্দিনী মৃদু হেসে বলে, "বাবা আজ নিজেই নিজের ভোগের ব্যবস্থা করেছেন!"
দীপ্ত মুগ্ধ হয়ে বলে, "শিব কি মহিমা অপার!"
🍂
ডে - ২
পরদিন সকালে চায়ের টেবিলে বসে দীপ্ত বলে, "কালকের বোতলের দুধটা খুব ভালো ছিল! পায়েসটাও দারুণ হয়েছে। এবার থেকে এই দুধটাই অর্ডার করো।"
নন্দিনী ফোনে অ্যাপ খুলে খোঁজ করে, কিন্তু এমন কোনো দুধের খোঁজ পায় না! অবাক হয়ে দীপ্তকে বললে, সে বলে, "বোতলটা নিয়ে এসো, দেখি!"
নন্দিনী কাঁচের বোতলটা এনে টেবিলে রাখে। দুজনে বোতলটির দিকে তাকিয়ে থাকে,দেখে দুধের বোতলটির গায়ে অন্য কম্পানীর নামও ছাপ, তারপর ওরা একে অপরের দিকে চায়। একইসঙ্গে দুজনেই বলে, "তাহলে...!"
হাসতে হাসতে ওদের অবস্থা খারাপ! কিন্তু হাসি থামার পর নন্দিনীর মুখ গম্ভীর হয়।
সে বলে, "ছি ছি! ওরা নিজেরা শিবের মাথায় দুধ চড়ানোর জন্য অর্ডার করেছিল, আর সেই দুধ আমরা...!"
দীপ্ত বলে, "কিন্তু দুধ তো শেষমেশ একই কাজে লেগেছে! আমি কাল অফিস থেকে ফেরার সময় পার্কিংয়ে ওদের বড় বেলপাতার মালা নিয়ে শিবমন্দির যেতে দেখেছি!"
নন্দিনী চিন্তিত মুখে বলে, "এখন কী করব?"
দীপ্ত হেসে বলে, "বোতলটা এত সুন্দর, ধুয়ে রেখে ভেবেছিলাম মানিপ্লান্ট লাগাবো। তা আর হলো না!"
নন্দিনী তড়পে ওঠে, "তোমার খালি নিজের ধান্দা! এখন কীভাবে ওদের বলব? তোমার তো নেওয়ার সময় দেখা উচিত ছিল।"
দীপ্ত বলে," যা বাবা!এতে আমার দোষ কি ?আমি তো জিজ্ঞেস করেছিলাম,তুমি কনফিডেন্সের সাথে বললে শিবরাত্রি বলে কাঁচা দুধ প্রমোশনের জন্য দিয়েছ,এখন যত দোষ নন্দ ঘোষ।"
অনেক জল্পনা-কল্পনার পর ওরা সিদ্ধান্ত নেয়, যা হবার হয়েছে, সত্যিটা স্বীকার করাই ভালো।
নন্দিনী সঙ্গীতাদের দরজায় বেল বাজায়। সঙ্গীতার স্বামী দরজা খুললে সব খুলে বলে। তিনি ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলেন, "সবই বাবার ইচ্ছা! উনি আপনাদের হাত থেকেই নিতে চেয়েছিলেন। এতে কোনো সমস্যা নেই!"
নন্দিনী দীপ্তর দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ওরা ক্ষমা চেয়ে দুধের দাম দিতে গেলে তিনি বলেন, "কালকের পায়েস অমৃতের মতো লেগেছিল! এবার যখন বানাবেন, আমাদেরও দেবেন!"
নন্দিনী হাসিমুখে বলে, "অবশ্যই দেব!"
ঘরে ফিরে দীপ্ত হেসে বলে, "শিব কি মহিমা অপার!"
0 Comments