জ্বলদর্চি

কামরাঙ্গা /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৬৪
কামরাঙ্গা

ভাস্করব্রত পতি

'একটুখানি ভুল পথ, অনায়াসে ফিরে যাওয়া যেত
আকাশে বিদ্যুৎদীপ্ত, বুক কাঁপানো হাতছানি
এই কামরাঙা গাছ, নীল রঙা ফুল, সবই ভুল
হে কিশোর, তবু তাই হলো এত প্রিয়?
সোনার মুকুট থেকে ঝুরঝুরিয়ে খসে পড়লো বালি…...'। …...'। 
'সোনার মুকুট থেকে' কবিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন কামরাঙ্গা গাছের কথা। সংস্কৃতে একে কর্ম'রঙ্গ, ধারাফল, গীতফল, শিরাল, বাংলায় কামরাঙ্গা, করভাঙা, ওড়িয়াতে কমরঙ্গা, মারাঠীতে কর্মরে, ইংরেজিতে Chinese gooseberry, Star Fruit বা Carambola, গুজরাটিতে কমারক, হিন্দিতে কযরথ, কামরাঙ্গা, তামিলে তমারট্টম মরম, তেলুগুতে তমারটা কয়া নামে বলা হয়। 

কামরাঙ্গার বিজ্ঞানসম্মত নাম -- Averrhoa Carambola Linn। এটি Oxalidaceae পরিবারের অন্তর্গত। এছাড়াও আরও কিছু প্রজাতি হল --
Averrhoa pentandra Blanco, 
Averrhoa acutangula Stokes, 
Connaropsis philippica Villar 

এই কামরাঙ্গার উল্লেখ রয়েছে রামায়ণে। কবি বাল্মীকি শূর্পনখার আসল রূপের পরিচয় দিয়েছেন অযোধ্যা কাণ্ডের ১৭/১৮ অধ্যায়ে। সেখানে রামচন্দ্র রাবণের বোন শূর্পনখার রূপ বর্ণনায় কামরাঙ্গার মতো শিরা সর্বস্ব রাক্ষসী হিসেবে তুলনা করে বলেছেন --
'ন কার্য্যং পশ্য বৈদেহীং পরিহাসঃ কথঞ্চন। কর্ম'রঙ্গশিরালাংত্বং বিরূপয়িতুমহসি'॥
গাছে ঝুলছে কামরাঙ্গা

আবার ১৬ শতকের রচিত ভাবপ্রকাশ গ্রন্থে কর্ম'রঙ্গ বা কামরাঙ্গার নামোল্লেখ দেখা গিয়েছে --
'কর্মারঙ্গঃ শিৱালং চ বৃহদল্লং বুজাকরম্। 
শীতবীৰ্য্যং হিমং গ্রাহি স্বাদ্বম্লং কফবাতকৃৎ'।। 
অর্থাৎ এটি শীতবীর্ষ, মল সংগ্রাহক, অম্লরস, অর তার কর্মগত। এটি কফবিকার ও বায়ুবিকার দূর করে। তেমনি চরক সংহিতাতেও আছে কামরাঙ্গার উল্লেখ --
'তং মধুরাম্ললবণ স্নিগ্ধোষ্ণৈ রূপক্রমৈঃ বায়াং'। 
অর্থাৎ মধুর, অম্ল, লবণ, স্নিগ্ধ ও উষ্ণদ্রব্য দ্বারা বায়, ও বায়ুবিকারের চিকিৎসা ক'রবে। 

এটি চিরসবুজ বৃক্ষ। ছোট বা মাঝারি আকারের গাছ। প্রায় ১৫ -২০ ফুট উচ্চ হয়। কামরাঙ্গার ফল ৩ - ৪ ইঞ্চি লম্বা, ৫ টি শিরাযুক্ত। দুটি শিরার মাঝখান অপেক্ষাকৃত নিচু। মেদিনীপুর জেলার একটি ধাঁধায় কামরাঙ্গাকে ব্যক্ত করা হয়েছে --
'চারিটি অক্ষরে নামটি তার
হল সে এক ফল। 
প্রথম অংশে প্রেমের আধার
দ্বিতীয়াংশে রঙ হয়'। 
কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পেকে গেলে হলুদবর্ণের ও সুগন্ধযুক্ত। জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ফুল আসে, তারপর ফল হয়। নভেম্বরে ফল পাকতে শুরু করে। এই কামরাঙ্গা ফল টক বা মিষ্টি দুটোই হয়। এতে ভিটামিন এ ও সি খুব মেলে। কিছু কিছু গাছে কাঁচা অবস্থায় কামরাঙ্গা টক, কিন্তু পেকে গেলে দারুণ মিস্টি স্বাদের হয়। মুর্শিদাবাদ এলাকায় কামরাঙ্গা নিয়ে একটি ছড়া --
'দেবদারু পাতা সরু
তার পোর নাম পাঁচসেরিয়া
খেলে লাগে টক মধুরিয়া'। '। 
গাছের কাণ্ডতেও গুচ্ছাকারে ঝোলে এই ফল। তা নিয়ে সিরাজগঞ্জ ও ফরিদপুরের লোকজনের মুখে শোনা যায় -- 'গাছের ফল গলায় ঝোলে'। 
হাতে কামরাঙ্গা

গ্রামাঞ্চলে এটি সাধারণত চাটনি হিসেবে খাওয়া হয়। অনেকে কাঁচা কামরাঙ্গা কুচি কুচি করে কেটে নুন লঙ্কা দিয়ে খায়। ইদানীং অবশ্য এই গাছের সংখ্যা কমে গিয়েছে। খুব একটা দেখা যায়না। কামরাঙ্গা বায়ুবিকার, অতিসার, অর্শরোগ, যকৃৎ শূল, পুরোনো জ্বর নিরাময়ে উপকারী। জামা কাপড়ে লোহার মরিচার দাগ লাগলে কামরাঙ্গার রস বেশ কার্যকরী। 

কম্বোডিয়াতে কামরাঙ্গা গাছের পাতা বেদনানাশক ঔষধ হিসেবে ও খোসপাঁচড়া রোধে ব্যবহৃত হয়। ইন্দোচিনে এই গাছের পাতার রস ক্রিমির উপদ্রবে ও চুলকানিতে প্রয়োগ করা হয়। তবে কামরাঙ্গা বেশি পরিমাণে খেলে কিডনির ক্ষতি হয়। যাঁদের কিডনির সমস্যা রয়েছে, তাঁদের কামরাঙ্গা খাওয়া উচিত নয়।

🍂

Post a Comment

0 Comments