বার্লিনের ডায়েরি ৭২পর্ব
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
( ভিসুভিয়াসের পথে)
সবুজে ভরা ঘনবন। বিশাল গাছদের ডালপালা পাতার ফাঁক দিয়ে চুপিসারে নেমে এসেছে নীলাম্বরী উন্মুক্ত আকাশ। চলার পথের মাঝে হলদে আলোর নিষ্পাপ ছোঁয়ায় ওদের মনে আনন্দ -- ভ্রমণের বাকী সময় টুকু নির্বিঘ্নে কাটবে। মেঘ বৃষ্টি বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। বেশ কিছুটা দূরে এক জায়গায় নগরের প্রান্তে সবুজের বিপুল সমারোহ দেখতে পেয়ে ভারী উতলা শ্রী। এতক্ষন ওরা যেদিকে তাকিয়েছে সর্বত্র শুধু চোখে পড়েছে পম্পেইয়ের ইট কাঠ পাথরের ধ্বংস স্তূপে ভরা মৃত নগরীর কঙ্কাল। গাইড ব্রানটার নির্দেশিত পথ ধরে অদ্রিজার সাথে এগিয়ে যেতেযেতে সেখানে ও কিছু গাছপালা ফল ফুলের বাগান, একটি আঙুরের লতায় ভরা সাজানো উদ্যানের দেখা পেয়ে শ্রী থমকে দাঁড়িয়েছিল। ভারী লোভনীয় থোকায় থোকায় টুসটুসে পাকা আঙ্গুর ঝুলছে আঙ্গুরলতায়।
অজস্র মৌমাছির গুঞ্জনে সতর্ক হয়ে শ্রী এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে ,তারা ঢাউশ এক চাকবেঁধেছে পাশের পাঁচিলের ধারে বুড়োওকের ঝুঁকে পড়া ডালে। অদ্রিজা একরাশ খুশিতে শ্রী কে দেখায় বার্লিনের সেই সেলিনা আন্টির ভিলেজের ফার্মের মত এখানে ও আলুবোখরার গাছসার দিয়ে রয়েছে অগুনতি। মিস ব্রানটা বলে , বিশেষ করে সেই প্রাচীন সময়ের বনভূমি তে যে ধরণের গাছপালা দেখা যেত বর্তমান যুগে ও সে সব গাছপালা কে সযত্নে রোপন করে উদ্যান গড়ে তুলে মৃত শহরে প্রাণের সংযোগে সবুজে সমৃদ্ধ করে তোলার চেষ্টা চলেছে। দেখ তাকিয়ে দূরের ঐ পাহাড়ের গা বেঁয়ে কেমন উচ্ছল ঝর্ণা ধারা তিরতিরিয়ে বয়ে চলেছে। বুনো ফুলেরগন্ধে নেশা জাগায় । প্রতিটা গাছের গায়ে ল্যাটিন ভাষায় নাম ও বয়স ট্যাগ করা-- ঋষভ উদ্যান সংরক্ষণের এত কর্ম কান্ড দেখে বলে ,ওরা প্রকৃত অর্থেই প্রকৃতি প্রেমিক। ধ্বংসের মাঝেও কেমন সংরক্ষনের প্রয়াস চালিয়ে যায় অবিরত।
পম্পেই শহর।
শ্রীর মন গভীর এক বেদনার অনুভূতিতে ভারাক্রান্ত। হাজারো প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরে বেড়ায় কে দেবে উত্তর ? চিন্তার সাগরে আছড়ে পড়ে অজস্র ঢেউ। নগরের পথে আনাচে কানাচে ইটের পাঁজরে কত গল্প স্মৃতি গাঁথার চিহ্ন,মর্মব্যথার কাহিনী। যার পথে প্রান্তরে অলিগলিতে মৃত্যু শোকের তীব্র হাহাকারের প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি। গত তিনশো বছর ধরে পম্পেই এর ভগ্নাবশেষ নিয়ে চলছে নানা রকম অনুসন্ধান পরীক্ষা নিরীক্ষা। চলছে অজস্র গবেষণা। মাটি খুঁড়ে পাওয়া অতীতের কবর থেকে নতুন তথ্যের সম্ভাবনায় এর ইতিহাস আধুনিক কালে অনেকটাই নানা দিক খুলে দিয়েছে। ওকে যে সব টুকু ওর ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে।
🍂
ব্রানটার সাথে চুক্তি অনুযায়ী প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ দেখা শেষ হলে অদ্রিজা ইরিনা চলেছে দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের পর্ব সমাধানের জন্য রেস্তোরাঁর সন্ধানে। এড্রিক ওদের সাথে পা মিলিয়ে যোগ দিয়ে জানায় ,পম্পেই এর পথে বিশাল ভিলা এবং ব্যস্ত পাবলিক স্কোয়ারের মাঝে রাস্তার ধারে যে খাবারের দোকান সাজানো ছিল তা আসলে থার্মোপোলিয়া। রোমান রন্ধন শৈলী সম্পর্কিত সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক থার্মোপোলিয়া। যা নতুন গড়ে ওঠা নগর টির চারদিকেই সাজানো ঠিক আগের মত করে। আধুনিক ফাস্ট-ফুড রেস্তোরাঁর মতো এই প্রাচীন স্থাপনাগুলি শুধুমাত্র দ্রুত খাবারের জায়গা ছিল না বরং প্রাণবন্ত সামাজিক উৎসব ও আলোচনা কেন্দ্রও ছিল যেখানে প্রতিদিনের পম্পেই বাসীর জীবনের বিভিন্ন ধরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা হতো। আসলে ,'থার্মোপোলিয়া ' শব্দটি গ্রীক শব্দ থার্মোস থেকে এসেছে ,যার অর্থ গরম এবং পোলিও যার অর্থ বিক্রি করা অর্থাৎ জনসাধারণের কাছে গরম খাবার ও পানীয় বিক্রি করা। বিশেষ করে পম্পেই সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য প্রস্তুত খাবারের রান্নাঘর। সাশ্রয়ীমূল্যের সহজ লভ্য প্রস্তুত খাবার সরবরাহকারী সংস্থা। সেকালের মত একালেও খুবই জনপ্রিয়।
অদূরেই পথ নির্দেশিকা অনুসরণ করে পম্পেইয়ের কেন্দ্রস্থলে একটি ঐতিহাসিক ভবনে এসে পাওয়া গেল 'গারুম পম্পেই - রিস্টোরেন্ট -এনোটেকা ' নগরের এটি একটি পুরোনো রেস্তোরাঁ যেখানে ঐতিহ্যবাহী ইতালীয় খাবার এবং স্থানীয় ওয়াইন পরিবেশিত হচ্ছিল। রেস্তোরাঁটির রাজকীয় পরিবেশ অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও মার্জিত।ডিসপ্লেবোর্ডের উজ্জ্বল আলোয় গারুম পম্পেইয়ের মেনুতে বিভিন্ন ধরণের ক্লাসিক ইতালীয় সুসজ্জিত খাবার রয়েছে। যেমন পিৎজ্জা পাস্তা, রিসোটো এবং গ্রিলকরামাছ , রোস্টেড হাঁসের মাংস ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের সামুদ্রিক প্রাণী এবং অন্য জন্তুর মাংসের লা-জবাব স্বাদের প্রিপারেশন। নিরামিষ ডিসের সংগ্রহ ও রয়েছে। সমস্ত খাবার তাজা,স্থানীয় উপাদান দিয়ে তৈরি এবং সুন্দরভাবে পরিবেশন করা দেখে শ্রীর সাথে সকলের মন অদ্ভুত চমৎকারিত্বে ভরে উঠেছিল। মেনুতে দৃষ্টি নন্দন নানা রকমের খাবারের বিজ্ঞাপন কিন্তু শ্রী ও তিতিরের মার্গারেট পিৎজ্জা সবথেকে পছন্দ। স্টার্টারে ইতালীয়ান ওয়াইন বারোলোর সাথে কাঁকড়ার কাটলেটের আধুনিক স্বাদ এখোনো ওর মন দিব্যি অনুভব করতে পারে ।
পাশের টেবিলে এড্রিক ভারী উত্তেজিত হয়ে ফেভারিট পানীয় নিয়ে ইরিনা কে বলেছিল, বারোলো পিয়মেন্ট অঞ্চলের নেবেওলো আঙ্গুর থেকে তৈরী একটি দারুণ রেড ওয়াইন যা স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। ইরিনা বলে মোটেই না ,বার্বারসকো ওয়াইন দি বেষ্ট। রেস্তোরাঁয় খাবার সার্ভ করতে একটু সময় লাগবে সেই মুহূর্তে বেশ জোরদার তর্ক ওর পছন্দের পানীয় পিয়মেন্ট অঞ্চলের নেবেওলো আঙ্গুর থেকেই তৈরী আরেকটি বিখ্যাত রেডওয়াইন যা বারোলোর চেয়ে হাল্কা ও সুগন্ধযুক্ত সেটি হলো বার্বারসকো ওয়াইন। নেক্সট টাইম ইরিনা বলেছিল এড্রিকের বার্থ ডে তে ঐ পানীয়টি ই গিফ্ট করবে। শ্রীর খুব মজা লাগছিল ওদের পানীয় সম্পর্কিত তর্কে। ঋষভ কে বলে কী ভালো? কী মন্দ? কিছু বুঝিনা শুধু বুঝতে পারছি এখন একটুও শীত লাগছে না। শরীরের সব ক্লান্তি যেন নিমেষে দূর হয়ে গিয়েছে। আরো কত পথ এখোনো সহজেই হাঁটতে পারবো।
সারাদিন ঘুরে এবারে ওরা নেপলসে ফিরে যাবার বাসে উঠবে । তার আগে ইরিনা ও এড্রিকের সাথে অদ্রিজা ও ঋষভের ইচ্ছে ওই দূরে পর্বত শিখরে মেঘমালার মাঝে যারা জীপ নিয়ে ভিসুভিয়াস পাহাড় দেখার জন্য এগিয়ে চলেছে তাদের মত ওরাও সেই বিশ্বগ্রাসী জ্বালামুখ দেখতে এক দৌড় লাগিয়ে তাদের দলের সাথে মিশে যেতে। তিতিরের কিন্তু শ্রী কে নিয়েই বড়ো চিন্তা--মা হয়তো পাহাড়ে চড়ার ধকল মোটেই সইতে পারবে না। শ্রীর অসম্ভব জেদ বলে '' বেশ পারবো ;আমি যাবোই। প্রাইভেট জীপে ভিসুভিয়াস বেড়ানোর ব্যবস্থা আছে সুতরাং অসুবিধার প্রশ্ন নেই ,আমি ভিসুভিয়াস দেখেই নেপল্সে ফিরবো।''
দূর থেকে দূরে একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের ছায়ায় ঢাকা সমাধি নগরী। চলন্ত গাড়ির জানলায় চোখ রেখে হলুদে সবুজে রাঙা পাথরের গায়ের ধারে গড়ে ওঠা বাড়ি ঘরগুলো ঠিক যেন গল্পে পড়া আলোছায়ায় সাজানো ছোট্টছোট্ট Doll's House এর মত সাজানো। পাহাড় নদীর পাশ দিয়ে গাছগাছালির মধ্য দিয়ে নব নির্মিত আঁকাবাঁকা ঢালাও কালো পথ ধরে ইউক্যালিপ্টাস বার্চ পাইন মেপল গাছের সারিসারি জঙ্গল পার হয়ে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ডুবে আছে মৃত নগরী। পথের দুই ধারের সবুজের মধ্য দিয়ে গাড়ি নির্বিঘ্নে এগিয়ে চলেছে। কোথাও পাহাড়ের পায়ের কাছে ,কোথাও বা সাগরপাড়ে গড়ে ওঠা শান্তির নীড়ের মত মনোরম স্বপ্নের দেওয়াল একেএকে পার হয়ে পাহাড়ের বুনো পথ ধরে নিঃশব্দে শ্রী দের জীপ এগিয়ে চলেছে।
এখান থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই যে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে আজো সগৌরবে বিরাজমান ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের ভিলেন নায়ক সেই ভিসুভিয়াস আগ্নেয় পর্বত মালা টি। বাতাসের গায়ে শ্রী কানপেতে আছে দূর থেকে যেন শুনতে পাচ্ছে তার গুমগুম বজ্র নিনাদে -- স্বঘোষিত নাসিকাগর্জন। ওর মনের ক্যানভাসে রং তুলির লড়াই চলছে। চলতে চলতে কথার প্রদীপ জ্বালিয়ে মনের ক্যানভাসে সযত্নে এঁকে রাখছিল ধ্বংস আর সৌন্দর্যের দ্বন্দ্বে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন নগরীর মর্ম ব্যাথার ইতিবৃত্ত। তখন মেঘাবৃত ভিসুভিয়াসের মাথায় কালচেনীলের সাথে আকাশীনীল মিলে মিশে একাকার। আকাশপারে রামধনু নেমে এসেছে সাতরঙ্গের ছোঁয়া নিয়ে। অনেকেই চলেছে হাইকিং করে ,ঋষভ বলে '' হাইকিংয়ের অভ্যাস না থাকলে ভিসুভিয়াসের পাহাড়ে চড়া খুবই কঠিন।সাংঘাতিক এক দুঃসাহসের কাজ। ভিসুভিয়াস প্রায় সাড়ে চার হাজার ফুট খাড়াই উঁচু পাহাড়। তার ঝুরঝুরে পাথরের ওপর দিয়ে রাস্তা। জীপ থেকে নেমে ও শুনেছি অনেকটা এবড়োখেবড়ো গড়ানে পথে পায়ে হাঁটতে হবে। সময় ও এখন শেষের পথে। ঘড়িতে চারটে বাজলেই সেখানে যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ভাবছিলাম যাওয়া হয়তো সম্ভব হবে না।
ভিসুভিয়াস
জীপে ও একজন গাইড স্যার সঙ্গে আছেন এবং ভিসুভিয়াস সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা চলেছে। সেই প্রাচীন যুগে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সারনো নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল এবং সমুদ্রতটও আগের থেকে উঁচু হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে পম্পেই শহরের অবস্থান না নদীর তীরবর্তী এলাকায় না সমুদ্রোপকূলবর্তী সংলগ্ন ভূমিতে। আগ্নেয়গিরির ও কালের পরিক্রমায় সময়ানুসারে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হয়েছে। এর আদ্যিকালের ঢালের সবুজ জঙ্গল ক্রমশঃ বিলুপ্ত প্রায়। এবং অগ্ন্যুৎপাতের ধাক্কায় ওর শীর্ষদেশ অনেকটাই বদলে গিয়েছে। সেই ৭৯ সালের পর থেকে বর্তমানের সময় পর্যন্ত ভিসুভিয়াস অনেকবার ক্ষেপে উঠেছে। অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে এবং চলেছে ধ্বংস লীলা প্রকৃতির প্রলয় নাচন তান্ডব। বর্তমানে ও এই সুপ্ত আগ্নেয়গিরি কে বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর আগ্নেয়গিরিগুলির মধ্যে একটি অন্যতম জ্বালাময়ী বিস্ফোরক আগ্নেয়গিরি হিসাবে গণ্য করা হয়। এর আশপাশের এলাকা জুড়ে এখনো আনুমানিক প্রায় ৩,০০০,০০০ মানুষের বসবাস গড়ে উঠেছে। এবং এই পাহাড়ে এখোনো সমান তালে বিস্ফোরণের মত অগ্ন্যুৎপাতের প্রবণতা রয়েছে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল অগ্নুৎপাতপ্রবণ এলাকা।
অদ্রিজার প্রশ্ন , এমন ভয়াবহ জায়গায় এখোনো প্রাণ হাতে করে এত মানুষের বাস কেন ?
এড্রিক আসলে প্রকৃতিবিদ, ভূতাত্ত্বিক ভারী উৎসাহিত হয়ে বোঝালেন , " অগ্নুৎপাতের ফলে যে মূল্যবান ছাই দিয়ে জমি ঢেকে দিয়েছিল যা এই পম্পেই এর পাথুরে মাটিকে কে বেশ প্রাণবন্ত উর্বর করে তুলছিল। যেখানে আঙ্গুরের চাষ ও ফলন ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ওয়াইন উৎপন্ন করা ও তার ব্যবসায়ীক বাজারে বিশাল প্রসার ঘটেছিল। ব্যবসায় এত বৃদ্ধি ,প্রসারতা লাভের জন্য প্রতিটি অগ্ন্যুপাতের পরে, এখানের জনসাধারণ ভিসুভিয়াসের ঢালে তাদের ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ করে। এই কারণেই তারা ভিসুভিয়াসের ঢালগুলিকে কোম্পানিয়া ফেলিক্স মানে সুখী ভূমি বলে ।"
0 Comments