জ্বলদর্চি

রঙের উৎসব /অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

রঙের উৎসব 

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় 

ফাগুন আগুন ছড়ায় সেটা বুঝতে কৈশোর পেরিয়ে গেছিল। আর আগুনের লেলিহান শিখার রঙ কত লাল সেই বোধ এসেছিল তার আগে, শ্মশানে। সে কথা থাক। তার অনেক আগে লালের লালিমা দেখে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। সবে জ্ঞান হচ্ছে। বয়সের হিসেব মনে নেই তবে দেখেছিলাম কাকিমা জেঠিমা এবং পাড়ায় মায়েদের বন্ধুরা সকলে মিলে বাড়িতে উপস্থিত।  সদর দিয়ে ঢুকে লম্বা টানা বারান্দা দিয়ে হেঁটে এসে ডাকাডাকি করে মাকে প্রায়ান্ধকার রান্নাঘরের থেকে বের করে মুখে লাল আবির মাখিয়ে দিল। মা ওদের থেকেই আবির নিয়ে ওদেরও মুখে লাগিয়ে দিল। চেক-ওলা রঙিন তাঁতের শাড়িতে তার গুঁড়ো ছড়িয়ে গেল। আর মায়ের টুকটুকে ফর্সা গোলগাল গাল রাঙা হয়ে রক্তিমাভায় উজ্জ্বল। সম্ভবত আমাদের ভাইবোনেদেরও আবির মাখিয়ে দিয়েছিল কারণ পরে মা আমাকে কুয়োতলায় বেশ করে সাবান আর ছোবরা দিয়ে ঘষে চান করিয়েছিল। ব্যস, এটুকুই স্মৃতি জীবনে প্রথম দোলের। পরে দেখেছি আগের রাতে বাড়ির কাছে মাঠে নানা শুকনো কাঠ পাতা গাছের ডাল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হত বুড়ির ঘর বা কুঁড়ে। সেটাতে আগুন জ্বালিয়ে পোড়ানোর স্মৃতি ফিরে আসে। আমরা ছোটরা দূর থেকে দেখতাম। কেন বুড়ির ঘরে আগুন দেওয়া হত প্রশ্ন জাগেনি সে বয়সে।

মুখে গায়ে রঙ মাখতে বেজায় আপত্তি ছিল। বাড়িতে আবির রঙ পিচকারি সবই আসত, বেরোতামও বন্ধুদের সাথে কিন্তু যেই বিদঘুটে বাঁদুরে বা গাড় বেগুনি ইত্যাদি রঙ বের করত বন্ধুরা ছুটে বাড়ি চলে আসতাম। দেখেছি সেই রঙ অনেক দিন অবধি বন্ধুদের হাতে মুখে লেগে থাকত। এটা আমার না-পসন্দ। সেই নিয়েই তারা স্কুল যেত, খেলতে মাঠে আসত। রঙ খেলা শেষ হয়ে গেলে তারা সবাই মিলে গঙ্গায় চান করতে যেত। আমরা বাড়িতেই পরিষ্কার হতাম এবং রঙের কোনও চিহ্ন থাকত না। সেদিন দুপুরে পাঁঠার মাংস ভাত অন্য এক আকর্ষণ। একটু বড় হতে বেলুনে রঙিন জল ভরে ছুঁড়ে মারা ছিল মজার। বিশেষ করে সন্ধ্যের পর। সে রঙ ছিল ভ্যানিশিং। লোকেদের ছুঁড়ে মেরে লুকিয়ে থাকার ভান। রেগেমেগে যতক্ষণে খুঁজে পেত তার মধ্যেই রঙ হাল্কা হতে হতে উধাও। এরকম বোকা বানানোর জন্য এটা ভারি মজার খেলা ছিল। দোলের প্রধান আকর্ষণ ছিল আমার কাছে - সেদিন থেকে পাড়ায়  ফুটবল খেলা শুরু হত। ক্লাবের নাম পাঁচ পাগলা আর পরিচালক গোড্ডাদা। কিছু বোঝার আগেই যেমন জন্ম থেকে হিন্দু ব্রাহ্মণ মোহনবাগান তেমনই শৈশবের শেষে পাড়ায় পাঁচ পাগলার সদস্য। 

🍂

কৈশোর শেষ হওয়ার আগেই দোলে রঙ মাখা বা দোল খেলার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলি। ততদিনে কাদা পাঁক মেশানো ময়লা জল ছোঁড়াছুড়ি শুরু হয়ে গেছে। এরপর শুধু বাড়ির গুরুজনদের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম। দূর থেকে বন্ধুদের দোল খেলা দেখতাম। দুপুরে খোল করতাল বাজিয়ে পাড়ার বড়রা হৈচৈ করতে করতে রাস্তা দিয়ে যেত। বাড়ির সদর দরজা বন্ধই থাকত। কখনও কড়া নেড়ে বাবাদের ডাকত। বাবা যদি খিল খুলে ওদের সামনে দাঁড়াত তো ওরা পায়ে আবির দিয়ে চলে যেত। তার আগে মা পেছনে দাঁড়িয়ে ওদের মঠ ফুটকড়াইয়ের একটা ঠোঙা দিয়ে দিত। বাবার গাম্ভীর্যকে ওরা ভয় পেত আবার শ্রদ্ধাও করত। ষাটের দশকের মাঝামাঝি দোলের দিন মিত্তির পাড়া থেকে কিছু ছেলে আমাদের পাড়ায় এসে হুজ্জোতি করেছিল, দোল খেলারত মেয়েদের অসম্মান করেছিল। সেই নিয়ে গণ্ডগোল হয়, মারপিটও হয়। সেই সময় থেকেই যুব শ্রেণির মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন শুরু যা কম্যুনিস্ট দল ভাগ হওয়ার সাথে যুক্ত। তখন থেকেই দোলের দিন পাড়ার দাদারা সতর্ক থাকত। দোলে ফুটকড়াইয়ের সাথে লাল নীল সাদা হলুদ সবুজ নানা রঙের মঠ আসত বাড়িতে, খেতাম। কেন মঠ তা জানতাম না। পরে জেনেছিলাম চৈতন্যোত্তর যুগে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের সাথে মিশনারি মঠ বিনষ্টের যোগ আছে তাই ওগুলো চিনি দিয়ে বানিয়ে চেবানো হয়। সত্যাসত্য জানি না। 

দোল খেলা হত একদিনই, ফাল্গুনী পূর্ণিমায়। হোলির চল ছিল না। হোলি প্রথম জানি কলেজে এসে। কিন্তু দোলের আগে রঙ আবির খেলা আমাদের কলেজে না হলেও বাড়ি ফেরার সময় ট্রেনে দেখতাম কিছু ছেলে রঙ মেখে ফিরছে। তাও শুধু দোলের আগের দিন। কয়েকবছর এই দিনে কলকাতার ভবানন্দ রোডে কাটিয়েছি। সেই ভয়ংকর রঙ খেলা ও মাখামাখি দৃশ্য এখনও মনে পড়ে। এরকমই দেখেছিলাম আমেদাবাদে আশির দশকে। চার তলার ওপর থেকে বেহিসাবি রঙ খেলা। চাকরি সূত্রে রাজস্থান গুজরাতে থাকলেও মার্চে সাধারণত বনে জঙ্গলেই কেটে যেত। সেখানে দোলের ছোঁয়া ছিল না। কেবল একবার বিখ্যাত ডান্ডিতে থাকায় সেখানে আবির নিয়ে রঙ খেলা দেখেছি। গ্রামের মাতব্বররা ক্যাম্পে এসে শ্রদ্ধা ভরে কপালে আবির দিয়েছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি মাকে নিয়ে হোলির দিন দ্বারকায় ছিলাম। মন্দিরে দেখেছিলাম এক অভূতপূর্ব রঙ খেলা। কেউ কারোর গায়ে রঙ দিচ্ছে না। ঘন্টা বাজিয়ে আরতি হচ্ছে আর চাতালে পিচকারি দিয়ে নানা রঙের আবির কোণাকুণি ওপরের গম্বুজের দিকে ছুঁড়ছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আর সেই আবিরের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে। এমন রঙের খেলা আর দেখিনি।

হুতোমের গল্পে কলকাতায় দোলের সময় যে কদর্য ঘটনার উল্লেখ আছে তার কিছু কিছু এখনও দেখা যায় শহরের অলিগলিতে। অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রকাশ ঘটে অকারণ মাতলামিতে। সকাল-সন্ধ্যেয় ভাঙ চরসের নেশায় মত্ত থাকে কিছু লোক। কিশোর যুবকদের মধ্যে এর অধিক প্রবণতা লক্ষ্য করার মত যা আগেও ছিল। আসলে এটাই ছিল আমাদের সমাজে দোলের রীতি। বৈষ্ণব সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে কতজন আর পরিচিত, পরিচয় করানোর মত কোনো লোকের উদ্যোগ দেখা যায় না যতদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের রচনা এবং দোলকে উৎসব করে তুলতে উদ্যোগী হতে দেখা যায়। তিনি না থাকলে আজও বসন্তের রঙ গাছে গাছেই থাকত, মনের গহীনে ঠাঁই পেত না। আবেগ চারিয়ে তুলতো না প্রেম বিরহের আনন্দ বেদনা। কত প্রেমের মুকুল ফুটেছে এই দিনে আবার কত কচি প্রেম অকালে ঝরে গেছে। বসন্ত তখনই যখন প্রকৃতি মনকে রাঙিয়ে তোলে, দোল তখনই যখন সেই রঙ ভালোলাগা ভালোবাসার আবেগে দোলা দেয়।
রঙিন শুভেচ্ছা রইল সবার জন্য।।

Post a Comment

0 Comments