জ্বলদর্চি

যে সব কথা লেখা হয় না /সুমনা সাহা


যে সব কথা লেখা হয় না

সুমনা সাহা 


প্রত্যেক লেখকের একটি ইতিহাস থাকে। তিনি বিখ্যাত বা অবিখ্যাত যেমনই লেখক হোন না কেন, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল তিনি লেখালিখিকে সিরিয়াসলি নিয়েছেন কি না, নিজেকে তিনি লেখক ভাবেন কি না। অনেকেই লেখেন। বিশেষত আজকের এই সোশাল মিডিয়ার যুগে সবাই লেখক। সেটা ব্যাঙ্গার্থে বলছি না। বরং এটা একটা ভাল লক্ষণ। যাঁদের লেখা আমাদের কোনদিনই পাওয়া হত না, সেসবও সামনে আসছে, লজ্জা ফেলে তাঁরা অন্যের দেখাদেখি উৎসাহিত হয়ে পোস্ট করছেন অথবা তাঁদের স্নেহভাজন কেউ অজান্তে বা আবদার করে তাঁদের লেখা বা অন্য প্রতিভাকে সামনে টেনে আনছেন। তেমনই প্রত্যেক লেখার নেপথ্যেই থাকে গল্প। লেখকও নিজেকে তৈরি করেন দীর্ঘ সময় ধরে। লেখালিখির অনেক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরে বিখ্যাত সাহিত্যিকও তাঁর পুরনো লেখাকে ‘কাঁচা লেখা’ বলেন। আবার কেউ কেউ প্রথম গল্প কিম্বা উপন্যাস লিখেই বিখ্যাত হয়ে যান, সেই একটিমাত্র লেখাই তাঁকে সাহিত্যের ভুবনে সরাসরি শক্ত মাটিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। 


🍂

আমিও নিজেকে লেখক ভাবি। অবিরাম নিজেকে পরিমার্জিত করার চেষ্টা করতে থাকি। বইপত্র পড়ে, অগ্রজ সাহিত্যিকদের লেখা পড়ে বা সিনেমা দেখে—নানা ভাবেই সাহিত্যের গ্রুমিং চলতে পারে। একদম শুরুর দিকের কথা বলতে গেলে কোন শেখার বালাই ছিল না। বসন্তে যেমন ফুল ফোটে, সদ্য কৈশোর পেরোনো যৌবনেও তেমন কবিতা আসে। এটা একটা মিথ তুল্য সত্য। সকলের ক্ষেত্রে না হলেও শতকরা আশি ভাগ তরুণ যৌবনে কখনো না কখনও কবিতা লিখেছে। আমিও আরম্ভ করেছিলাম স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। সাপ্তাহিক ওয়াল-ম্যাগাজিন, বার্ষিক পত্রিকা এইসবই তখন ছিল সাহিত্যপ্রতিভা প্রকাশের জায়গা। আর এই আদেশ আসত দিদিমণিদের কাছ থেকেই। বাংলায় যে হায়েস্ট নম্বর পায়, ভাল রচনা লিখে তাক লাগিয়ে দেয়, তার খাতা জুনিয়র ক্লাসে পড়ে শোনানো হয় এবং সেই মেয়েটি আদেশ পায়, ‘তুমি এবারের ম্যাগাজিনে লিখবে।’ সেই আরম্ভ। তারপর ক্রমে দায়িত্বের পরিধি বিস্তার। অন্যদের দিয়ে লেখানোর, মানে লেখক খুঁজে বের করা, সম্পাদনা ইত্যাদি। তারপর পড়ার চাপে সেসব শিকেয় ওঠে, কেবল ডায়েরির পাতায় মাঝে মাঝে ফুটে ওঠে বসন্তের পলাশ কিম্বা বর্ষার গন্ধরাজ। তারপর দীর্ঘ দীর্ঘ প্রান্তর। তবে ধু ধু প্রান্তর নয়, শস্য শ্যামলা সবুজ ক্ষেত। সংসার। সন্তান। তারও অনেকদিন পরে আবার সেই স্কুলবেলার মত একটু কম চাপের ফুরফুরে বেলা। 

দ্বিতীয় ইনিংস আরম্ভ হল অনুবাদের হাত ধরে। প্রথম যখন মহারাজ অনুবাদের দায়িত্ব দিলেন, ভয় পেয়েছিলাম। আমি কি পারব? স্বামী পরমানন্দের লেখা কনসেনট্রেশন অ্যান্ড মেডিটেশন। কবিত্বপূর্ণ ভাষা। বললাম, “যদি ভুল টুল হয়, কেউ দেখে দেবেন তো?” চিন্তা ছিল, নাহলে লোকে কি বলবে? বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত বইয়ে অনুবাদের মান খারাপ হলে সেটা আমারই খারাপ লাগবে। মহারাজ (বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়, বেলুড় মঠ-এর প্রাক্তন উপাচার্য, স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দ) বললেন, “আমাদের লোকবল নেই। এখানে তো উদ্বোধন-এর মত পাবলিকেশন টিম নেই, তোমাকেই সব দেখে দিতে হবে।” কোন জায়গা বুঝতে অসুবিধা হলে মহারাজকেই বলতাম। উনি সেসময় প্রচণ্ড ব্যস্ত। তবুও কোন কোনদিন ক্লাসের (উপনিষদ) আগে ডেকে নিতেন, আধঘণ্টা আমার অসুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। আমি নোট করে নিতাম। এক একদিন দুপুরবেলা ফোন করে বলতেন, “তুমি কি একবার আসতে পারবে এখন? আমাদের একজন অধ্যাপক এসেছেন, অনুবাদ নিয়ে বসা যাবে।” আমি তখনই ছুটতাম, বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস। গিয়ে দেখি, প্রফেসর সৌটিরকিশোর চট্টোপাধ্যায় ও আরও কয়েকজন বসে আছেন। ওঁর লেখা উদ্বোধন পত্রিকায় পড়েছি, স্বামী ভজনানন্দজীর লেখার ওঁর করা অনুবাদও পড়েছি। খুব উপকার হল ওঁর সঙ্গে আলোচনা করে। তখন ‘আলাসিঙ্গা পেরুমল’ (স্বামী সুনির্মলানন্দজীর লেখা) বইয়ের অনুবাদ চলছে। যাইহোক, কথার মাঝে ওঁকে ‘সৌটির বাবু’ সম্বোধন করেছিলাম। মনে আছে, আমার দিকে একবার তাকালেন মহারাজ। আমি বুঝলাম কিছু একটা ভুল করেছি। পরে রাম বকুনি। “এসব বাবু টাবু কি? প্রফেশনাল ক্ষেত্রে পুরুষদের স্যার এবং মহিলাদের ম্যাডাম সম্বোধন করবে, এটাই স্ট্যান্ডার্ড।” তাঁর নির্দেশ আজও মেনে চলি অক্ষরে অক্ষরে। এরপর মহারাজের ইংরাজি লেখার (প্রবুদ্ধ ভারত, বেদান্ত কেশরী ইত্যাদি ইংরাজি পত্রিকার) বাংলা অনুবাদ করার সূত্রে যাতায়াত আরম্ভ হল উদ্বোধন পত্রিকা অফিসে। পেলাম আরেকজন মেন্টরকে। স্বামী চৈতন্যানন্দ। সেসময় উনি উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক। 

চৈতন্যানন্দজী আরও খুঁতখুঁতে। উনি কখনোই আমার লেখা বা অনুবাদের প্রশংসা করতেন না। কিন্তু মনে মনে যে স্নেহ করেন, সেটা টের পেতাম। একদিন ওঁকে অনুযোগ করেই ফেললাম, “আপনি কখনোই আমার লেখার প্রশংসা করেন না!” উনি বললেন, “তোমার প্রশংসা কি তোমার সামনে করব?” আগেকার দিনের মানুষদের এইরকম ট্রিটমেন্ট ছিল, সামনাসামনি প্রশংসা করলে অহংকার তৈরি হবে। তাই সবসময় সমালোচনার আতসকাচে রাখতেন। বানান ভুল দেখলে উনি ভয়ংকর রেগে যেতেন। আমাকে প্রুফ দেখতে শিখিয়েছিলেন। কোথায় কোন চিহ্ন বসাতে হয় ইত্যাদি। বলতেন, “লিখতে বসলে পাশে সংসদের অভিধান নিয়ে বসবে। যখনই কোন বানানে সন্দেহ হবে, অভিধান খুলে দেখে নেবে।” এখনও যে নিখুঁত বানান লিখি, তা হয়তো নয়। ভুল আজও হয়, অসতর্কতায়। পরে চোখে পড়লে লজ্জা লাগে, ওঁর কথাগুলো মনে পড়ে। দুপুরে শ্রীশ্রীমায়ের বাড়িতে প্রসাদ পেয়ে ওঁর ঘরে যেতাম, যেদিন যাওয়ার কথা থাকত। উনি কোনও লেখা আমাকে দেখতে দিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করতেন, বলে যেতেন, “এটা অনেক বড় হয়ে গেছে। ২০০ শব্দ কমাতে হবে। পারবে? দেখো, মনে রাখবে, যেন তুমি একজনের অনুপস্থিতিতে কারো ঘরে ঢুকেছ। ঘরটা এলোমেলো হয়ে আছে। তুমি চট করে একটু গুছিয়ে দেবে। এত বেশি গোছাবে না, যেন সে নিজের ঘরে ঢুকে ঘরটাকেই চিনতে না পারে। হালকা করে বিছানার চাদরটা একটু টান টান করে দিলে, ছড়ানো বইপত্রগুলো খানিকটা এক জায়গায় গুছিয়ে রাখলে... এইরকম টুকটাক আর কি!” আমি খুব মন দিয়ে তাঁর কথামত করার চেষ্টা করতাম। তাঁদের সান্নিধ্যে নিজেকে শিশুর মত মনে হত। আমার এতখানি বয়স হয়েছে বা আমার এত বড় ছেলে আছে, এইসমস্ত মনেই থাকত না! তাই বোধহয় কিছু কিছু শিখতে পেরেছি। শিখতে হলে ভিতরে একটি ভীরু ছাত্রীসত্তা থাকতে হবে। সেটা আজও আছে। আরও পরে ব্যাকরণের কিছু বিষয় শিখেছি নিবোধত পত্রিকার সম্পাদক প্রব্রাজিকা আপ্তকামপ্রাণার কাছে। তিনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, আমাকে দিদি বলেন, কিন্তু সংস্কৃতে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের কাছে আমি শিশুই।       

এভাবেই পথ চলেছি। শিখতে শিখতে, পড়তে পড়তে প্রতিদিন নিজেকে ঘষে মেজে নিচ্ছি। আগে করা অনুবাদ দেখলে এখন মনে হয়, আরও ভাল করা যেতে পারত। হয়তো পরে আবার কেউ করবে। সাহিত্যের ইমারত এভাবেই তৈরি হয়। হাজার হাজার ইট সাজিয়ে যেমন বিশাল অট্টালিকা, সৌধ গড়ে তোলা হয়, তেমনই কত লেখকের শত-সহস্র কাজ সাহিত্যের ইমারত গড়ে তোলে। সুনির্মল বসুর সেই কবিতাটিই শেষ কথা—

“বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র

নানান ভাবের নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র।” 

Post a Comment

0 Comments