জ্বলদর্চি

মেঘের আড়ালে / মিলি ঘোষ

গল্প
 মেঘের আড়ালে 
 মিলি ঘোষ 

গাড়ি যেখানে থামল, সেখানে কিছুটা রুপোলি রোদ এমনভাবে আঁচল পেতেছে, যেন সব আয়োজন স্বস্তিকদের জন্যই।
 এই সেই বাড়ি, যেখানে বসে রবীন্দ্রনাথ 'রক্ত করবী' লিখেছিলেন। 
প্রকৃতির স্বাদ নিতে এসেছে স্বস্তিক আর রাজা। তবু রবীন্দ্রনাথ ওদের পিছু ছাড়লেন না। 
   রাজা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, "এই মানুষটিকে এড়িয়ে যাওয়া অত সহজ নয়।"
   স্বস্তিক রাজাকে সমর্থন করে বলল, "একটা মানুষ একটা জীবনে কী করে এত লিখলেন বল তো ?"
   "শুধু লেখা? আরও কত এক্টিভিটিস ছিল তাঁর।"
  "তোর কী মনে হয়, ভগবান কি একটু বেশিই পক্ষপাতিত্ব করেছেন কারও কারও ক্ষেত্রে?"
   "না রে। যতটা দিয়েছেন, ততটা আঘাতও করেছেন। কত বড়ো বড়ো শোক সামলেছেন বল তো?"
   স্বস্তিক একটা শ্বাস ফেলে বলল, "তা ঠিক। এই জন্যই তিনি মহামানব।"

প্রায় বছর ছয়েক কেটে গেছে। স্বস্তিক আর শিলংয়ের দিকে যায়নি। রাজা বলেছে অনেকবার। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। 
এর মধ্যে এক রবিবার স্ত্রী অলিকে নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার একটি শপিং মলে গেছিল স্বস্তিক কিছু কেনাকাটা করতে। মল থেকে বের হবার সময় একটি আঠেরো উনিশ বছরের মেয়ে এসে পথ আটকায়। 
   এক মুখ হাসি নিয়ে বলল, "ডাক্তারবাবু না ?"
এরকম তো কতজনই চেনে। স্বস্তিক অল্প হেসে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে পাশ কাটিয়ে চলে আসছিল। 
কিন্তু মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়াল। 

🍂

   বলল, "আমি কান্তা, ডাক্তারবাবু। শিলংয়ে থাকতাম।"
শিলং শুনে দাঁড়িয়ে যায় স্বস্তিক। এক সঙ্গে অনেকগুলো মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
   মেয়েটি আবার বলল, "আমার ভাইকে আপনি বাঁচিয়েছিলেন।"
    সে একাই বলতে থাকে, "আমি তো এখন কলকাতায় আছি।"
    পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষটিকে দেখিয়ে বলল, "আমার হাজব্যান্ড।" 
কলকাতায় ও যে একটা মসৃণ সুখের জীবন কাটাচ্ছে তা বোঝাতে চেষ্টার ত্রুটি রাখল না। কথার মধ্যে প্রবহমান আত্মসুখী নদীটির ছলাৎ ছলাৎ জল স্বস্তিককে ভিজিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু স্বস্তিকের হিসেব মিলছিল না। আপাদমস্তক আধুনিকতায় মোড়া এই কান্তাই, সে'ই কান্তা? শিলংয়ে খাদের ধারের একটি দোকানে দ্রুত হাতে পকোড়া ভেজে যাওয়া সেই মেয়ে, এ? কান্তা এখন রীতিমতো সুন্দরী। চালচলন, কথাবার্তায় কোথাও কোনও ফাঁক নেই। কান্তা কলবল করে কথা বলছে। যেন হাওয়ায় ভেসে ভেসে। হয়তো কান্তার সত্যিই মাটিতে পা পড়ছিল না। স্বস্তিক তখন পৌঁছে গেছে সেই পাহাড়ি রাস্তায়। 
কান্তার কথার মাঝেই প্রশ্ন করল স্বস্তিক, "তোমার মা, ভাই কেমন আছে? ভাই কি স্কুলে পড়ে?"
কান্তা যেন একটু ইতস্তত করল। কোনওরকমে ' সবাই ভালো আছে' বলে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সুস্পষ্ট সুর কাটার ইঙ্গিত। 

গাড়ি চালাতে চালাতে অলিকে কান্তার ভাইয়ের অসুস্থতার কথা, শিলং গিয়ে ওদের সঙ্গে দেখা হবার কথা বিশদে বলল স্বস্তিক।
   আরও বলল, "কত পেশেন্ট আসে যায়। সব সময় মনেও রাখতে পারি না। কিন্তু পেশেন্ট, তার বাড়ির লোক মনে রাখে। সবাই যে খুব শ্রদ্ধা করে তা নয়। বহু মানুষের রাগ থাকে ডাক্তারদের ওপর, নানা কারণে। তবুও মনে রাখে ভালোবাসায়, ঘৃণায়। আমরাই ভুলে যাই। যে মানুষটি তার আপনজনকে হারিয়ে ডাক্তারের গায় হাত তোলে, তাকে ডাক্তাররা ভুলতে পারে না। কিন্তু যারা শ্রদ্ধা ভালোবাসা ঢেলে দেয়, তাদেরই আমরা ভুলে যাই। কারণ তাদের সংখ্যাই বেশি।"

আরও তিন চার বছর কেটে গেছে। রাজা এবার শিলং থেকে কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে পাকাপাকিভাবে চলে আসছে। 
   স্বস্তিক শুনে বলল, "তুই আসার আগে একবার ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরে আসি।"
   রাজা বলল, "আমি তো কতবার বলেছি। বেড়াতে একেবারে যাসনা তোরা, তা তো নয়। এদিকেই এলি না।"
   "এবার যাচ্ছি। ফাইনাল।"
এবারের ট্যুরেও রাজাই গাইড। দু'জনেরই একটি করে কন্যা। মোট ছ'জনের দল। উচ্ছ্বাস তাই একটু বেশির দিকে। স্বাভাবিকভাবেই দুই বন্ধুর অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় ঘাটতি পড়ল। চা খেয়ে দশ মিনিটে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়া নেই। বাচ্চাদের বায়নাক্কা, শাসন সহযোগে ওদের আবদার মেটানো এবং সর্বোপরি ওদের মায়েদের সাজগোজের জন্য বেশ কিছুটা সময় যাওয়া। এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে স্বস্তিক আর রাজা হোটেলের বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে কিছুটা আড্ডার মেজাজে। শিলংয়ের অসাধারণ ফলস দেখা, তাঁবুতে রাত কাটানো, সব মিলিয়ে ওরা তখন দারুণ পুলকিত। সারাদিন আকন্ঠ প্রকৃতির স্বাদ নেবার পর ফেরার পথে ওরা গেল পাকোড়া সহযোগে চা খেতে সেই কান্তার মায়ের দোকানে। চেহারার পরিবর্তন সকলেরই হয়েছে। ভাই টুলু অনেকটা বড়ো হয়েছে। বয়স বেড়েছে মায়েরও। কিন্তু তিনি এতটাই কর্মঠ যে,বয়স হার মানতে বাধ্য। টুলু প্রথমে বুঝতে পারেনি ওদের। তবে ওর মা কিন্তু ঠিক চিনেছে।
   স্বস্তিক গিয়েই বলেছে, "এবার কিন্তু টাকা না নিলে চলবে না। আমাদের দলও বড়ো হয়েছে।"
টুলুর মা শুনে হেসেছে। দোকান এখন বেশ সাজানো গোছানো।
স্বস্তিকের চোখ ঘুরছে এদিক ওদিক। ঐপাশে পকোড়া ভাজছে যে মেয়েটি, সে কি কান্তা? মুখটা ঘোরানো। স্বস্তিক ভালো করে দেখল। না মনে হয়। কান্তা হবেই বা কী করে। ও তো কলকাতায়। কান্তার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাটা চেপেই গেল। কান্তার জীবনযাত্রা তো খুব স্বাভাবিক লাগেনি সেদিন স্বস্তিকের। তা ছাড়া বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করাতে এড়িয়ে গেছিল ও। 
মেয়েটি পিছন ঘুরে বিশাল কড়াইতে বড়ো ঝাঁজরি হাতা দিয়ে পাকোড়া ভেজেই চলেছে। স্বস্তিক একটু অন্য দিকে তাকাতেই মেয়েটি ওদের একবার দেখল। স্বস্তিক মুখ ফেরালে মেয়েটি এক ঝটকায় মুখ ঘুরিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। 
টুলু ওর মায়ের সঙ্গে তখন খদ্দের সামলাতে হিমশিম। 
   তার মধ্যেই একবার ওর মা বলল, "কান্তা হাত চালিয়ে কর। যেগুলো ভাজা হয়েছে, দিয়ে যা। লোক দাঁড়িয়ে আছে।"
   স্বস্তিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কান্তা ঝুড়ি ভর্তি পাকোড়া ওর মায়ের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। যাবার সময় এক ঝলক স্বস্তিকের দিকে তাকাল। সরাসরি চোখের দিকে না। পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নিল।
কান মানুষকে প্রবঞ্চনা করে ঠিকই। তাই বলে চোখ? এ সে কান্তা নয়, যাকে স্বস্তিক শপিং মলের গেটে দেখেছিল। কান্তা আবার আগের চেহারায় ফিরে এসেছে। চোখে কীসের ছায়া ওর? অভাব? নাকি শান্তি? মেকাপ না তুলে ঘুমিয়ে পড়লে যেমন হয়, মুখে তেমন একটা শুষ্ক সৌন্দর্য এখনও রয়ে গেছে।  
কলকাতার সুখের দিন যে কান্তার স্থায়ী হয়নি, সে নিয়ে প্রশ্নই থাকে না। শহুরে মোহো হয়তো অচিরেই ছুটে গেছে ওর। জীবনের চরম কঠিন রূপ হয়তো ও কাছ থেকে দেখেছে। তাই কি ও স্বস্তিকের সামনে দাঁড়াতে পারল না? কান্তা আর একবারের জন্যও সামনে ফেরেনি। ভাইকে ডাক দিয়েছে পাকোড়া নিয়ে যাবার জন্য। 

স্বস্তিকদের গাড়িটা ছিল ওই দোকান থেকে কিছুটা পিছিয়ে কয়েকটা গাড়ির পেছনে। স্বস্তিক গাড়িতে ওঠার সময় একবার ঘাড় ঘোরালো। কান্তা তখন দোকান থেকে এক পা বাইরে বেরিয়ে স্বস্তিকের দিকে তাকিয়ে। স্বস্তিকের চোখ পড়তেই মাথা নামিয়ে ভেতরে চলে গেল।
ফেরার পথে গাড়িতে বসে স্বস্তিক ভাবছে, জীবনের হিসেব তো কারোরই সবটা মেলে না। কান্তারও মেলেনি। কী পেল ও জীবনে? শুধুই একটা বিগ জিরো! একটি পাহাড়ি সরল মেয়ের জীবন নিয়ে খেলা করা কত সহজ। ওরা ভালো মন্দ বোঝে না। তাই সহজেই প্রলোভনে পা দেয়। তবু, কান্তা যে ফিরেছে এই অনেক। কত হাজারো কান্তা জীবনের চোরা পথে হারিয়ে যায়, সে খবর কি রাখে পৃথিবী? স্বস্তিক হয়তো কিছু অনুমান করেছে। শুধু কান্তার ফেরার পথটায় কতগুলো কাঁটা বিছানো ছিল স্বস্তিকের কল্পনা তার নাগাল পায়নি। গাছের সারিকে পথের পাশে রেখে এগিয়ে চলল স্বস্তিকদের গাড়ি। পাহাড়ি বিকেলের তখন বালিকাবেলা। প্রকৃতিও কিছুটা উদাস ও গম্ভীর। দূরে মেঘে মেশা শৈলমালাকে আটকাবার জন্যই যেন গাছগুলি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার গাছ না থাকলেই বেশ খানিকটা পৃথিবী। এমন মোহিনী রূপের আকর্ষণেই আজ ওরা ঘর ছাড়া।
গাড়ির মধ্যে সকলেই ক্লান্ত। দু'চোখের পাতা এক হয়েছে প্রায় সবারই। অতন্দ্র প্রহরী স্বস্তিক জানলা দিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করল। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো নীল আকাশ। পাইনের মাথা মিশে গেছে সেখানে। যেন রাজপ্রসাদের সবচেয়ে উঁচু কক্ষ থেকে রাজা তাঁর প্রজাদের দেখছেন। সেদিকে তাকিয়ে স্বস্তিকের মনে হলো, "এত উঁচু আকাশের নিচে মানুষ কত অসহায়। অথচ, দেখে বোঝার উপায় নেই। সবাই যন্ত্রের মতো কাজ করে চলেছে।"

এরপর রাজার বাড়িতে একটা দিন কাটিয়ে বাড়ি ফেরার পালা। গাড়িতে উঠেও স্বস্তিকের চোখের সামনে শপিং মলের সেই সুখী সুখী হাসি মুখের কান্তা। গাড়িটা একবার থামতেই স্বস্তিকের চিন্তার জাল ছিন্ন হলো। রাস্তার পাশে দু'জন পাহাড়ি মহিলা হাত নেড়ে কী যেন বলছে নিজেদের মধ্যে। পাশে একটা ছোট্ট ছেলে আপনমনে কয়েকটা পাথর নিয়ে খেলছে। ওদেরই কারোর ছেলে হবে। শিশুদের একমনে খেলার মধ্যে কোনও ছলনা নেই। স্বস্তিক জানলা দিয়ে ওর সারল্য উপভোগ করতে লাগল। হঠাৎ বাচ্চাটি মুখ তুলে তাকাল। স্বস্তিক ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। বাচ্চাটিও স্বস্তিককে দেখে হাসল। ঠিক পরিচিতের হাসি নয়। কিন্তু চওড়া হাসি। গাড়ি ছেড়ে দিতেই স্বস্তিক হাত নাড়ল। বাচ্চাটিও।

   স্বস্তিক ভাবতে লাগল, "এত কুয়াশাতেও বাচ্চাটির হাসিতে রোদের ঝিলিক। শহুরে শিশুরা কি এভাবে হাসে? হাসে না। খোলামেলা সরল পাহাড়ি মানুষদের হাসিতে কী আছে কে জানে, সমতলের মানুষ ওই হাসিটা পছন্দ করে। হয়তো এ জন্যই সরল মানুষগুলোকে বোকা বানানো যায়।"
   দূরের আবছা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে স্বস্তিক জানতে চাইল, "কেন তোমরা আড়ালে, পাহাড়? শিশুটি তো হাসল। ওর তো কোনও আড়াল নেই। তোমরা কেন ওর মতো নও? তোমরাও কি তবে কান্তার মতো জীবনের স্বাদ পেয়েছ?" 
                     

Post a Comment

0 Comments