হিং- কচুরি
কমলিকা ভট্টাচার্য
ভোরের আলো তখনও ভালো করে ফোটেনি। মধুবাবু স্পোর্টস শু পায়ে, ট্র্যাক প্যান্ট ,জগিং স্যুটে একদম তৈরি। কল্যাণী দেবী তখনও বিছানায়।
একবার খালি ডেকে বললেন, “আমি বাইরে থেকে চাবি দিয়ে যাচ্ছি।”
ইদানিং মধুবাবুর এই পরিবর্তন বিশেষ লক্ষ্যনীয়।
এর আগে সকাল সকাল হাঁটার কথা বারবার বলেও কল্যাণী দেবী হেরে গেছেন।
আর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—মধুবাবুর ড্রেসিং সেন্স।
আগে ছিল খুবই ক্যাজুয়াল—ফতুয়া-পাজামা।
এখন সোজা জগিং স্যুট!
ছেলের কাছ থেকে জেনে অনলাইনে সব আনিয়েছেন!
মধুবাবু বেরিয়ে যাবার পর কল্যাণী দেবী ঘুম থেকে উঠে নিজের কাজ সারতে থাকেন।
সাতটার সময় কলিং বেল বাজে। সুন্দরী কাজে আসে।
আজ নতুন বছরের প্রথম দিন, সব বাড়িতেই কাজ একটু বেশি। তাই সে এসেছে আজ একটু সকাল সকাল।
🍂
বাসন মাজতে মাজতেই বলে উঠল,
“কাকুকে দেখলাম ঐ গুপ্তা ম্যাডামের সাথে পার্কে হাঁটছে।”
কল্যাণী দেবী পিছন ঘুরে বললেন,
“কে গুপ্তা ম্যাডাম?”
“আরে কাকিমা, তুমি জানো না—ঐ হিন্দী-বালী মহিলা। এই বয়সেও কি সাজ! কী প্যান্ট, কী গেঞ্জি পরে হাঁটছে পার্কে!”
সুন্দরী একবার মুখ ঘুরিয়ে কল্যাণী দেবীর মুখের দিকে তাকাল। বোঝার চেষ্টা করল— জ্বালাটা ঠিক ধরেছে কিনা।
তারপর আবহাওয়াটা একটু জমিয়ে তোলার জন্য বলল,
“তুমিও তো কাকুর সঙ্গে একটু ঘুরতে যেতে পারো।”
কল্যাণী দেবী বুদ্ধিমতী।
তিনি কথা এড়িয়ে বললেন, “তুই কাজ সার, তাড়াতাড়ি।”
সুন্দরী, কান ভাঙানোটা ঠিকমতো কাজ হয়নি দেখে, একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
“আমার কী, আমি তো কাজ সারছি। তোমার শরীর মন ভালো থাকবে তাই বলছিলাম।
তবু আগুন লাগানোর শেষ ত্রুটি না রেখে বলল—গুপ্তা ম্যাডামের সঙ্গে কাকুকে প্রায়ই কথা বলতে দেখি সেদিন, তো দেখলাম উনার হাতে বাজারের থলি দিয়ে কী একটা বলছে।”
মুখে কিছু না বললেও কল্যাণী দেবীর মুখটা যে ধীরে ধীরে ভার হচ্ছিল সেটা আন্দাজ করে সুন্দরী বলল,
“চলো চলো, এবার আমি যাই। অনেক কাজ পড়ে আছে।”
মর্নিং ওয়াক সেরে মধুবাবু বাড়ি ফিরে সোফায় বসে বললেন,
“কল্যাণী, এক কাপ চা দাও তো। মাথাটা বড় ধরেছে।”
কল্যাণী দেবী এবার বললেন,
“কেন? আজ নববর্ষের দিনে তোমার গুপ্তা ম্যাডাম তোমাকে এক কাপ চা খেতে দেয়নি? বাড়িতে ডেকে?”
মধুবাবু বললেন, “তোমাকে কে বলল গুপ্তা ম্যাডামের কথা?”
কল্যাণী দেবী বললেন, “তুমি ভেবো না, আমার কাছে কিছু খবর নেই। ইদানিং তোমার চালচলন সবই আমার নজরে আসছে।”
মধুবাবু বললেন, “চা টা হয়ে থাকলে দাও। আমি বাজারটা সেরে আসি। আজ নববর্ষের দিন, একটু মুলো নিয়ে আসব—একটু মুলির পরোটা বানিও। আর দুটো পরোটা প্যাক করে দিও মিস্টার গুপ্তাকে দিয়ে আসব।”
কল্যাণী দেবী এবার বিরক্ত হয়ে বললেন,
“মিস্টার গুপ্তাকে না মিসেস গুপ্তাকে?”
মধুবাবু বললেন, “জানি না তোমার কী হয়েছে।”
কল্যাণী দেবী বললেন,
“আজ নববর্ষের দিনে মুলি পরোটা বানাবো না। মুলি পরোটা খেয়ে সারা বাড়ি মেহেকাবে তুমি!”
মধুবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন।
কল্যাণী দেবী বললেন,
“আজ নববর্ষের দিন হিংয়ের কচুরি বানাবো। মিস্টার ব্যানার্জি একলা থাকেন, ওনাকে ডিনারে ডেকেছি। সেদিন ফোন করেছিলেন—বলছিলেন অনেকদিন হয়ে গেছে আমার হাতের হিংয়ের কচুরি খাননি। উনি বলেন, আমার হাতের রান্নার জবাব নেই!”
মধুবাবু একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন,
“বাজারের ফর্দটা লিখে দাও। আজ তোমার স্পেশাল গেস্ট আসবে। তিনি যা যা ভালোবাসেন, তাই বানাও।”
কল্যাণী দেবী বুঝলেন, তির ঠিক জায়গায় লেগেছে।
বললেন, “হ্যাঁ, আর একটু গোবিন্দভোগ চাল এনো। ওনার আমার হাতের পায়েস খুব ভালো লাগে, বলেন অমৃত!”
মধুবাবু বলেন,
“হ্যাঁ, ওনারও তোমার সব জিনিসই ভালো লাগে।”
কল্যাণী দেবী বললেন,
“কেমন যেন পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে... তুমি কি হিংসায় জ্বলছো?”
“তোমারও তো হিংয়ের কচুরি ভালো লাগে!”
মধুবাবু বললেন,
“তা আমি বললে তুমি কী বানাও? না আমার জন্য! এই তোমার পছন্দের লোকেদের আগমনের সুযোগে দু'একটা জোটে—ভালোবেসে হিংয়ের কচুরি শেষ কবে খেয়েছি, কে জানে।”
কল্যাণী দেবী এবার বললেন,
“আচ্ছা, মিস্টার গুপ্তারা কোন ফ্ল্যাটে থাকে? সুন্দরী বলছিল, ওরা নাকি বিহার থেকে... তাই বুঝি তোমার এত পছন্দ?”
“ওনাদের ছেলেপুলে নেই?”
মধুবাবু এবার বিরক্ত হয়ে বললেন,
“যে তোমাকে মিসেস গুপ্তার খবর দিয়েছে, তার কাছ থেকেই এসব প্রশ্নের উত্তর জেনে নিও।”
বলে বাজারের থলিটা নিজেই নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
কল্যাণী দেবী ভাবলেন, ডোজ আজ একটু বেশি হয়ে গেল বোধয়।
সন্ধ্যায় ব্যানার্জি বাবু ধোপ- ধরস্ত পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে হাজির।
তাকে দেখেই কল্যাণী দেবী বলে উঠলেন,
“পায়জামা-পাঞ্জাবিতে আপনাকে কিন্তু দারুণ লাগছে! এটা নতুন কিনেছেন বোধহয়?”
ব্যানার্জি বাবু এক কালে হেসে বললেন,
“বুড়োর আবার সাজ!”
কল্যাণী দেবী মধুবাবুর দিকে একবার তাকিয়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে বললেন,
“আপনাকে দেখলে কিন্তু আপনার বয়স পঞ্চাশের বেশি মনে হয় না।”
মধুবাবু বললেন,
“আপনারা গল্প করুন, আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।”
কল্যাণী দেবী মধুবাবুকে চোখের ইশারায় বাড়িতে থাকতে অনুরোধ করলেন।
কিন্তু মধুবাবু বেরিয়ে গেলেন।
বললেন, “আমার একটি বিশেষ কাজ আছে, সেরে আধঘণ্টায় আসছি।”
মধুবাবু প্রায় ঘণ্টা দুয়েক কেটে যাওয়ার পরও ফিরলেন না।
কল্যাণী দেবী বাড়িতে অতিথি থাকলেও মনে মনে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
ব্যানার্জি বাবু কল্যাণী দেবীর উদ্বেগের কারণ আন্দাজ করে বললেন,
“আজ আমি উঠি, আরেকদিন আসা যাবে।”
কল্যাণী দেবী তাড়াতাড়ি ওনার জন্য কচুরি বানিয়ে দিলেন আর পায়েস দিয়ে ওনার ডিনার বেড়ে দিলেন।
উনি বললেন,
“আমি একলা একলা খাবো, ভালো দেখায় না। আপনি একটু সঙ্গে খান না?”
কল্যাণী দেবী বললেন,
“আজ তিরিশ বছরে আমি কোনোদিন ওনাকে ছাড়া খাইনি।”
ইতিমধ্যে কল্যাণী দেবী বারো বার মধুবাবুকে ফোন করেছেন। সবসময় ফোন ‘নট রিচেবল’।
কল্যাণী দেবী নিজের আচরণের জন্য খুব দুঃখিত বোধ করলেন।
তিনি এইরকম কিছুই চাননি।
আজ বছরের প্রথম দিনে তিনি মধুবাবুর সাথে একটু মজা করতে চেয়েছিলেন।
শুধুমাত্র তার মন জানে—এই হিংয়ের কচুরি আর পায়েস, তিনি খালি মধুবাবুর জন্যই বানিয়েছিলেন।
এইসব ভাবতে ভাবতে কল্যাণী দেবী ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন।
রাত প্রায় বারোটায় মধুবাবু বাড়ি ফেরেন।
কল্যাণী দেবী সঙ্গে উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করেন,
“এতক্ষণ কোথায় ছিলে? ফোনটা পর্যন্ত ধরা যায় না!”
মধুবাবু বলেন,
“আমি সরি কল্যাণী, আজ আমি তোমার স্পেশাল গেস্টকে অ্যাটেন্ড করতে পারিনি।”
কল্যাণী দেবী লজ্জিত ভাবে বলেন,
“সেসব কথা থাক, কিন্তু তুমি কোথায় ছিলে সেটা বলো।”
“মিসেস গুপ্তা মেসেজ পাঠিয়েছিলেন—একবার আসবেন।" তাই গিয়েছিলাম।
মিস্টার গুপ্তার কন্ডিশন খুব খারাপ—লাস্ট স্টেজ ক্যান্সার।
ওনারা এখানে নতুন, ভালো করে বাংলা জানেন না।
তাই মিস্টার গুপ্তাকে শেষ ক’দিন সঙ্গ দেওয়ার জন্য সকালে পার্কে যাই।
সঙ্গে মিসেস গুপ্তাও আসেন।
ডাক্তার বলে দিয়েছেন, যে কোনোদিনই যে কোনো সময় কিছু হতে পারে। তাই মিসেস গুপ্তা একলা সাহস পান না।
ওনাদের ছেলেপুলে নেই, নিজের বলতেও শহরে কেউ নেই।
আজ মিস্টার গুপ্তাকে হসপিটালাইজ করে এলাম।
নতুন বছরে হয়তো আর সকাল সকাল হাঁটতে যাওয়া হবে না।”
কল্যাণী দেবী বললেন,
“কে বলেছে? কাল থেকে আমি তোমার সাথে হাঁটতে যাব।”
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা
হাঁটতে থাকুন
6 Comments
'হিং-কচুরি' অপূর্ব!
ReplyDeleteখুবই ভালো লাগল
Deleteখুআয়াব
ReplyDeleteখুআয়াব
ReplyDeleteখুব হৃদয় ছোঁয়া দাম্পত্যের গল্প।
ReplyDeleteBhison sundoor lekha tomar... Eto natural
ReplyDelete