যে সব কথা লেখা হয় না
পর্ব-৫
সুমনা সাহা
প্রবাদ আছে, যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন’জন। আমাদের বাড়িতে ক’জন সুজন ছিল বলা মুস্কিল, তবে আক্ষরিক অর্থেই ন’জন বাস করতাম ঐ ছোট্ট ফ্ল্যাটে—তেঁতুল পাতাই বটে! দুটি মাত্র ঘর, একটি ডাইনিং রুম, কিচেন, ব্যালকনি এবং সবচেয়ে ভয়াবহ—একটিই টয়লেট! ঝগড়াঝাঁটি আর বাথরুমের দরজা ধাক্কাধাক্কির কথা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। ছোট-পিসি আর দাদার তো জন্মেও ভাব ছিল না। আমরা ছোট-পিসির দলেই থাকতাম। তবে দাদার আর পিসির ঝগড়ায় দাদা-ই মা-র সাপোর্ট পেত বেশি। ওদিকে একটা ঘরের বিছানায় সর্বদা শুয়ে থাকা ঠাকুরদা ঘরে চেঁচামেচি শুনলেই ভয়ানক রেগে যেত আর কাশতে আরম্ভ করত। সেই অদম্য কাশি শুনে মা আমাদের হাতজোড় করে বলত, “ওরে বুড়ো মানুষটা মরে যাবে। তোরা একটু চুপ কর।” কোনও কারণহীন শান্ত দিনে, যখন গরমের ঝিমধরা দুপুরে সব চুপচাপ, হঠাৎ দাদুর অকারণ কাশির শব্দে দিবাতন্দ্রার সুখালস্য ভেঙে মা চমকে উঠে বসত, “কি হল? কি হল?” মা ঠিকঠাক ওষুধ খাইয়েছে। ব্যাপারটা কি তাহলে? মা যতক্ষণে দুরদুর করে উঠে আসছে, তার মধ্যে দুপদাপ করে আমি হাওয়া। আর দাদুর চিল চিৎকার আর কাশি—“হতচ্ছাড়ি মর মর!” মা শিউরে উঠত, “ওকি! আপনি এমন করে শাপশাপান্ত করেন কেন? ও তো আপনার নাতনী?” “নাতনী না শয়তানী? ওরে বাবারে আমার বুক ধড়ফড় করছে, মরে গেলাম!” মা শান্ত ভাবে দাদুর বুকে হাত বুলিয়ে বলত, “জল খান, জল খান।” দুপুরবেলায় পাড়া যখন নিঝঝুম, তখনই তো অভিযানে বেরোনোর সময়! মা এটা বোঝে না। বেরোতে দ্যায় না বাইরে। এদিকে বাইরে পুকুরের জলে আলোছায়ার খেলা মধুর হয়ে উঠেছে, “জলের উপর ঝলোমলো টুকরো আলোর রাশি/ঢেউয়ে ঢেউয়ে পরীর নাচন হাততালি আর হাসি,” ওদিকে আবার বাগানের পশ্চিম দিকে, যেখানে বুড়োমালীর ঘর, সেই কোণে একটা বিরাট ফলসার গাছ। তাতে কালচে সবুজ ফল ধরেছে, নিচে ঝরে পড়া অজস্র টক-মিষ্টি ফলসা! আহ ভাবতেই জিভে জল। সহজ পাঠ তো ঠোঁটের ডগায়—“ফলসা বনে গাছে গাছে ফল ধরে মেঘ ঘনিয়ে আছে, ঐখানেতে ময়ূর এসে নাচ দেখিয়ে যাবে!” যত পড়াশুনো না করা, মায়ের ভাষায় ‘দুনিয়ার নচ্ছার’ ছেলেমেয়েগুলো খেলতে বেরিয়ে পড়েছে, মন কি মানে ঘরের ঘেরাটোপে? তাই তো বাধ্য হয়ে দাদুর খাটে উঠতে হয়। খাটের পায়ার নিচে ইট পেতে উঁচু করা, নিচে হাঁড়িকুঁড়ি আরও কত জিনিস। লোহার ভারি ভারি ট্রাংকে চাবি দিয়ে রাখা, ওখানে রাখা আছে দাদুর গুপ্তধন। চারদিকে চারটে খুঁটি পোঁতার মত ছত্রী দেওয়া খাটের একটা পায়া ছিল নড়বড়ে। গ্রামের বাড়ি থেকে লড়িতে চাপিয়ে নিয়ে আসবার সময় ভেঙে গেছিল। সেই ভাঙা পায়াই আমার অস্ত্র। খাটের উপর এক লাফে উঠে কোমর দুলিয়ে নাচলেই জোরসে ঝাঁকুনি খেয়ে খাট যেন রেলগাড়ি ঝমাঝম। তারপরেই দাদুর চিৎকার, মায়ের উঠে আসা, আর আমাদের খেলতে যাওয়ার পারমিশন। সব সময়ের রান্না এবং ঘরের কাজের জন্য একজন মাসি আমাদের সঙ্গেই থাকত। সে শুত ডাইনিং রুমে। দাদুর খাটে না উঠলে চলে যেতাম সেই মাসির কাছে। কাঁত হয়ে মুখ হাঁ করে ঘুমন্ত সেই মাসির কানে একটু জল ঢেলে দিলেই শুরু হত মরাকান্না, “মাগো মা! এগুলো বাচ্চা না চৌবাচ্চা? অ্যাঁ? সারাদিন খাটুনির পর একটু ঘুমাতে দেবে না গো!”
বাবা ছিল শান্ত মানুষ। বাবার সহকর্মীরা বলত, “চক্রবর্তী দা, পুলিশে কেন যে জয়েন করলেন? জীবনেও কাউকে একটা চড় মারতেও দেখলাম না!” সত্যি কথা। আমরা যত দুষ্টুমিই করি না কেন, বাবা কখনও আমাদের গায়ে হাত তোলেনি। স্নান করে আঙুলে পৈতে পেঁচিয়ে গায়ত্রী জপ করছে, বাবার এই রূপটা মনে ভাসে। কোথাও কেউ কোন গণ্ডগোল পাকিয়েছে এবং থানায় ধরে এনেছে, এমন অনেকেই বাবা উপস্থিত থাকলে পা জড়িয়ে ধরে কাঁদত, “বাবু আর মারবেন না, মরে যাব, আর কোনদিন করব না।” বাবা বলত, “আচ্ছা পাজী তো? তোকে মারলাম কখন?” লোকটা বলত, “মারবেন তো? তাই আগে থেকেই বলে রাখলাম!” বাবা এসব গল্প ছুটির দিনে খেতে বসে আমাদের বলত, আমরা খুব মজা পেতাম। প্রায়ই “অভাবে পড়ে চুরি করেছি বাবু”, কিম্বা “কাজ বাজ নেই, ঘরে হাঁড়ি চড়েনি” এই ধরণের কৈফিয়ত শুনলে বাবা তাদের কোন না কোনও কাজে ঢুকিয়ে দিত, বাবার সাধ্য মত বহু লোককে বাবা নানা কাজে ঢুকিয়ে দিত, সেই ব্যাপারে বাবার একটা নাম হয়ে গিয়েছিল। রঙের কারখানায়, জুতোর কারখানায়, গ্যারেজে অল্প বেতনের কাজে থানায় আসা এইসমস্ত ছিঁচকে চোর বদমায়েশদের কাজে লাগিয়ে দিত। মাঝে মাঝে খবর নিয়ে আসত, “কিরে, ঠিকঠাক কাজ করছিস তো? দেখিস আমার নাম ডোবাস না!” সেই লোক কান মুলে জিভ কেটে বলত “বাবু কি যে বলেন?” অনেক ক্ষেত্রে বাবু বলত, “তোর বৌকে জিজ্ঞাসা করিস, আমার কোয়ার্টারে কাজ করবে? ঘর টর মুছবে, বাচ্চাদের একটু চোখে চোখে রাখবে, তরকারি কুটে দেব, পারবে না? মাইনে দেব।” এইভাবে বাবু একটা না একটা কাজের লোক থানা মারফৎ জোগাড় করে আনত। মা ভয় পেত, “বাবারে, চোর খুনে ডাকাত কার ঘরের বৌ কে জানে? রাত বিরেতে যদি গলা কাটে?” বাবা অগাধ কনফিডেন্স নিয়ে বলত, “কার ঘাড়ে কটা মাথা আমার বাড়িতে চুরি করবে? এক আছাড়ে ব্যাং বানিয়ে দেব না?” এইটা ছিল বাবুর পাঞ্চ লাইন। নিরীহ মানুষটা রেগে গেলে যেন আগুনের ভাটার মত হয়ে যেত চোখদুটো, বাজখাই গলায় বলত ‘এক আছাড়ে ব্যাং বানিয়ে দেব’, ব্যাস তাতেই কাজ হত, কোনদিন মারধরের দরকার পড়েনি। বাবা থানার কাজ সামলে রাত্রি করে ফিরত। অনেকসময় গভীর রাত্রেও থানার ভ্যান এসে কোয়ার্টার থেকে বাবাকে ডেকে নিয়ে যেত, শুনতাম ‘আর্জেন্ট ইস্যু’। মা আমাদের ঘুম পাড়িয়ে জেগে বই পড়ত। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম। বাবার কড়া নাড়ার বিশেষ ছন্দ ছিল মুখস্থ। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়তাম আর এক ছুটে মায়ের পিছনে দরজায়। বাবার পা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাফাতাম। তখন আমার মাথা ছুঁয়েছে বাবার হাঁটু। মা বলত, “মানুষটাকে ঘরে ঢুকতে দিবি তো?” বাবা সস্নেহে খালি হাসত, “এখনো ঘুমাসনি কেন মানু?”
পাড়ায় পিসির এক প্রিয় বান্ধবী ছিল নীলা। রঞ্জু-মাসি, ববি-পিসি আর আমাদের খোকন-দাদা মিলে নীলাদের বাড়িতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারত। রঞ্জু-মাসি এসে অনেকদিন থাকত। বাবা খুব ভালবাসত আর মাসিরও আবদারের সীমা ছিল না জাম্বুর উপর। ওদিকে আবার মেজ-পিসিরা এলেই মিনিমাম একমাস থাকত। পিসতুতো দিদি সুলেখা আর ভাই অসীমের স্কুলে গরমের ছুটি পড়লেই পিসি চলে আসত সপরিবারে। পিসেমশাইকে বাবা বাটা কম্পানিতে কাজে লাগিয়েছিল। কম্পানি প্রায়ই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হত। বাবার মুখে মাঝেমাঝে শুনতাম, “ছবির সংসারটাও তো আমাকেই ঠেলতে হচ্ছে।” পিসেমশাইয়ের একটা দুরারোগ্য হার্টের অসুখ ছিল। খুবই ব্যায়সাধ্য চিকিৎসা তার। অনেক দামী দামী ওষুধও খেতে হত। সেসবই বাবা দেখত। পিসি মা-র কাছে বসে সাংসারিক দুঃখকষ্টের অনেক কথা বলত। মা বয়সে ছোট বলে ‘তুই’ বলত, অথচ বিজয়ার প্রণাম করবেই। মা যতই বাধা দিত, “না, তুই আমার দাদার বৌ, বৌদি হোস, পেন্নাম করতে দে।” এখন ভাবি, কেন ওই প্রবাদটার সৃষ্টি হয়েছিল। এই এতগুলো লোক, কে যে কোথায় শুত! ওই তো দুটো মাত্র ঘর, এতদিন পরে আর আমার মাথায় আসে না। এই নিয়ে একদিন দাদার সাথে কথা হচ্ছিল। আমি বললাম, আমরা এতগুলো মানুষ, আবার বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসা লেগেই ছিল, সবাই কোথায় শুত বলতো?” দাদা বলল, “তখন তো আলাদা বেডরুমের কোন কনসেপ্টই ছিল না। গ্রামের বাড়িতে ছিল গোবর দিয়ে লেপা মাটির মেঝে, ঘরের ভিতরেই কোথাও কচুগাছ, কোথাও কলাগাছ ফুটে বেরোচ্ছে—সেখান থেকে সিমেন্টের পাকা ঝকঝকে মেঝেওয়ালা কোয়ার্টারে চলে এলাম—মানে এটাই তো একটা বিরাট রেভোলিউশন! যে যেখানে পারত শুয়ে পড়ত। মাটি নেই, সব পরিষ্কার। কিছু একটা পেতে শুয়ে পড়া হত।” মনে পড়ে, সব ঘরে একটা করে কম পাওয়ারের বাল্ব ছিল। ফ্যান ছিল না। অনেক পরে মা আর আমরা যে ঘরে খাটে ঘুমাতাম, সেখানে একটা ফ্যান লাগানো হল। খৈতান ফ্যান। তার আবার সাত বছরের গ্যারান্টি। সেই ফ্যান যখন ঘুরত, আমরা সবাই পরম বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। গরমের সময় গায়ে ঘামাচি হওয়া ছিল চরম স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। সেটাই গরমকালের বৈশিষ্ট্য। খুব পিঠ চুলকালে বোন কাঁদত, মা বলত, “এই তো এবার বৃষ্টি এসে যাবে, সব কমে যাবে।” আমরা চাতকের মত অপেক্ষা করতাম বর্ষাকালের জন্য। প্রথম বৃষ্টির জলে ভিজলে ঘামাচি সেরে যায়, এমন একটা মিথ ছিল। প্রথম যেদিন আকাশ কালো করে মেঘ করত, যাকে বলে ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’, আমরা সবাই খালি গায়ে ছাদে বা মাঠে ছুটতাম। এখনই বৃষ্টি নামবে আর ঘামাচিগুলো বৃষ্টির জল লেগে মরে যাবে। পাড়ার সব বাচ্চারাই সমস্বরে চেঁচাত, “আয় বৃষ্টি ঝেপে/ধান দেব মেপে/ধানের ভিতর পোকা/জামাইবাবু বোওওকা!” বৃষ্টিও বুঝি উপভোগ করত তার আসার আকাংক্ষায় কি বিপুল সংবর্ধনার আয়োজন!
(ক্রমশ)
1 Comments
ভালো লাগছে
ReplyDelete