জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোক গল্প-- ২৩৬(সাহারা, আফ্রিকা)সাপেদের পা গেলো কোথায় /চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 
দূর দেশের লোক গল্প-- ২৩৬
(সাহারা, আফ্রিকা)
সাপেদের পা গেলো কোথায়
চিন্ময় দাশ

অনেক কাল আগের কথা। মানুষ আসেনি তখনও পৃথিবীতে। আগুনের আবিষ্কার হয়নি। সূর্য ডুবে গেলে, ঘন অন্ধকার। সে সময় চাঁদই খানিকটা রেহাই দিত বনের পশুপাখিদের। 
আহা, কী মিষ্টি আর নরম আলো চাঁদের! শরীর মন জুড়িয়ে যেত সবার। তাই চাঁদকে ভারি মান্য করত সবাই। পূজা করত চাঁদের। চাঁদও ভারি ভালোবাসত তাদের। 
এক বছর হোল কী, বৃষ্টির দেখা নাই। কালো মেঘের দেখাই নাই আকাশে। চাঁদ বুঝে গিয়েছে খরা আসছে সামনে। ভয়ানক খরা। বঁচে থাকাই দায় হয়ে উঠবে অবলা জীবগুলোর।
অনেক ভেবে, গঙ্গাফড়িংয়ের কথা মনে পড়ল চাঁদের। সংখ্যায়ও অনেক তারা। থাকেও বেশ দল বেঁধে। কারও সাথে বাদ-বিবাদ নাই তাদের। 
ডাক পেয়ে, গঙ্গাফড়িংদের মোড়ল গিয়ে হাজির হয়েছে চাঁদের কাছে। চাঁদ বলল—শোন, মোড়ল। সামনে খুব বড় বিপদ আসছে। বৃষ্টি হবেই না। মাঠ-ঘাট নদী-নালা সব শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। জলের অভাবেই মারা পড়তে হবে সবাইকে।
মোড়ল ভয় পেয়ে গেছে খুব। সেসময় বনের সবাই মা বলে ডাকত চাঁদকে। সে বলল—মা, তাহলে উপায় কী? ছেলে-পুলে নিয়ে বাঁচব কী আমরা?
--শোন, শোন । তোমরা ভাবতেও পারবে না, কী বিপদ আসছে। চাঁদ বলল-- এই জায়গাটার বিশাল এলাকা জুড়ে মরুভূমি গজিয়ে উঠবে। চিহ্ন থাকবে না এক ফোঁটা জলেরও। সবাইকে মারা পড়তে হবে। 
মোড়ল কাতর গলায় বলল—তুমিই বলো মা, কী করব আমরা। বাঁচার কিছু একটা উপায় বলে দাও তুমি। 
চাঁদ বলল—উপায় একটাই। এই এলাকা ছেড়ে সরে যাও সকলে। অন্য কোনও রাস্তা নাই এই বিপদের সময়। দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ো। ঘুরে ঘুরে বলে দাও সবাইকে। পশু পাখি সবাইকে বলবে। যে যাবে না, টিকতে পারবে না সে।

🍂

বনের সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে, সবাইকেই খবর দিয়েছে গঙ্গাফড়িংয়ের দল। সবাই বুঝেছে ব্যাপারটা। সবাই বউ-বাচ্চাদের নিয়ে, গোছগাছ করে বেরিয়ে যাচ্ছে এলাকা ছেড়ে। কোথায় একটু সবুজে ঢাকা বন থাকবে আর জল পাওয়া যাবে, সেদিকেই চলেছে সবাই।
সেসময় বনের অন্য জীবদের মতো, সাপেদেরও পা ছিল। তাও আবার চার-চারখানা পা। অন্য সবার মতো, তারাও পায়ে হেঁটেই চলাফেরা করত। কিন্তু সাপ তখনও ছিল ধূর্ত, হিংস্র আর অহঙ্কারী। তাদের মোড়ল কানেই তুলল না ফড়িংয়ের কথা। হেসেই উড়িয়ে দিল—মরুভূমি হয়ে যাবে, বললেই হোল। যত সব উজবুকের দল।
সাপেরা স্বভাবে আলসে, আর ঝগরুটেও। সাপ বলল- যাদের বেড়াবার সাধ হয়েছে, তারা যাক। আমরা মরুভূমিকে ভয় পাই না।
সাপেরা রয়েই গেল নিজের এলাকায়। কিছুদিন না যেতেই শুরু হোল সমস্যা। বৃষ্টির একটা ফোঁটাও পড়ল না আকাশ থেকে। মাঠের ঘাস হলুদ হয়ে শুকিয়ে গেল। গাছগুলো কঙ্কালটির মতো। একটা পাতাও নাই কোনটাতে। নদী-নালা শুকিয়ে কাঠ। মাটি শুকিয়ে ফুটিফাটা হোল। তার পর মাটি ঝুরঝুরে হয়ে, বালির ম্রুভূমি গজিয়ে উঠল এলাকা জুড়ে। 
এইবার বিপদ এলো সাপেদের। ইঁদুর, গিরগিটি, ব্যাঙ সবাই চলে গেছে এলাকা ছেড়ে। এমনকি ছোট্ট একটা ব্যাঙও নাই। আগুন জ্বলছে পেটে। অথচ পেটে দেওয়ার মতো কিচ্ছুটি নাই এলাকায়। শুকিয়ে সরু কাঠি হয়ে উঠছে শরীর। 
এত দিনে সাপের মাথায় এসেছে, বাঁচতে হলে সরে যেতেই হবে এলাকা ছেড়ে। তাই বেরিয়ে পড়েছে ঘর ছেড়ে। ঘর থেকে বেরিয়েই হুঁশ হোল, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। বালি ভয়ানক গরম। পা ফেলাই দায়। তাছাড়া, ঝুরো বালি হয়েছে সবচেয়ে বিপদ। 
পা ফেললেই, ঝুরঝুরে বালিতে ডুবে যাচ্ছে। টেনে তোলাই দায়। সামনের পা তুলতে যাচ্ছে, ততক্ষণে ডুবে যাচ্ছে পেছনের পা। তার উপর রয়েছে রোদের তাত। মাথার উপর আগুন ঝরে পড়ছে গনগনে সূর্য থেকে। 
পেটে খিদে। বাইরে আগুনে পোড়া বালি। আর এক পাও এগোন সম্ভব নয় সাপের পক্ষে। নাজেহাল হয়ে চাঁদের পায়ে পড়ে গেল সাপ। আকুল গলায় হাঁক পেড়ে বলল—দোহাই তোমার, আমাদের বাঁচাও, মা। ভুল হয়েছে আমাদের। গোঁয়ার্তুমি  করেছি। তোমার কথা কানে তুলিনি। এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু এই বালির জন্য এক পাও আর এগোতে পারছি না। পাগুলো পুড়ে যাচ্ছে। বাঁচাও আমাদের।
চাঁদ তো সবার মা। ভারি দয়ালুও তিনি। সবার উপরেই তাঁর সমান করুণা। চাঁদ বলল—আচ্ছা ঠিক আছে। এগোও তোমরা। আর অসুবিধা হবে না। তাড়াতাড়ি চলে যাও এখান থেকে। 
সাপ এগোতে গিয়েই অবাক। তাদের পাগুলো খসে গিয়েছে। বালির ভিতরেই থেকে গিয়েছে। আরও অবাক করবার মত ব্যাপার, পেটে ভর দিয়েই দিব্যি চলাফেরা করা যাচ্ছে। এবং বেশ জোর গতিতেই এগোতে পারা যাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, মরুভূমি ছেড়ে পালিয়ে গেল তারা। সেই থেকে পা নাই সাপেদের। 
অনেক পরে, কিছু কিছু বিষাক্ত সাপ ফিরে গিয়েছে মরুভূমি এলাকায়। তারাও বেশ স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারে বালির ওপর। কোনও অসুবিধাই হয় না। মায়ের কথার অবাধ্য হয়েও, চাঁদের করুণা পেয়েছিল সাপ। সেই সুবিধা আজও ভোগ করছে তারা।

Post a Comment

0 Comments