বাপন দেব লাড়ু
রাত দশটা। কলকাতার একটি পুরনো ফ্ল্যাটবাড়ির চতুর্থ তলার বারান্দায় বসে ধ্রুব একটা সিগারেট ধরাল। ঘর অন্ধকার, কেবল বারান্দার হলুদ আলোয় তার মুখটা আধোআঁধারি। সিগারেটের আগুন জ্বলে উঠলে চোখ দুটো আরও তীব্রভাবে চমকে ওঠে— যেন ঘুম ভাঙা কোনো পুরনো স্মৃতি চোখ খুলেছে।
ধ্রুব একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। পেশায় মানুষকে ‘স্বাভাবিক’ করার দায়িত্ব তার। অথচ আজকাল নিজেকেই বড় অস্বাভাবিক মনে হয়। গত কয়েকমাসে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তাকে ধীরে ধীরে একটা অলক্ষ্য খাদে ঠেলে দিয়েছে— সে খাদের নাম, অভিজিৎ।
তিন মাস আগে, ধ্রুবর চেম্বারে আসে অভিজিৎ সরকার। বয়স আনুমানিক ৩৫। একসময়ে কলেজে পড়াত, এখন চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি গৃহবন্দি। অভিজিৎ জানায়, তার মনে হয় কেউ তাকে অনুসরণ করছে। সব সময়, সব জায়গায়। সে জানে এটা অবাস্তব, তবু অনুভূতিটা এত বাস্তব লাগে যে সে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারছে না।
ধ্রুব প্রথমে ভেবেছিল এটা ক্লাসিক Paranoid Delusion, কিন্তু যত দিন গেছে, তত ধ্রুবর নিজেকেই অদ্ভুত অস্থির লাগতে শুরু করে। অভিজিৎ কথা বলত খুব ধীরে, কিন্তু প্রতিটা শব্দ যেন মনে দাগ কেটে যেত।
“ডাক্তারবাবু,” একদিন অভিজিৎ বলেছিল, “আপনি কি কখনও এমন কাউকে দেখেছেন, যে আপনার ছায়ার মতো থাকে? আপনি তাকালে সে নেই, কিন্তু আপনি চোখ বন্ধ করলেই সে পাশে দাঁড়িয়ে?”
ধ্রুব হেসে ফেলেছিল, “আপনার ছায়ার নাম আছে?”
অভিজিৎ চোখ নামিয়ে বলেছিল, “সে আমিই। আমার আরেক রূপ।”
---
ধ্রুব ঠিক করতে পারে না কখন থেকে সে নিজেই অভিজিৎ-কে দেখতে শুরু করল। প্রথমে রাস্তায়— তারপর নিজের ফ্ল্যাটের করিডোরে। এমনকি একদিন আয়নায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দেখল, নিজের প্রতিবিম্ব তার সঙ্গে ‘ম্যাচ’ করছে না। ধ্রুব জোর করে যুক্তিবোধ ধরে রাখে। এ হতে পারে induced delusion— জটিল, কিন্তু সম্ভাব্য। হয়তো অভিজিৎ-র সঙ্গে মানসিক সংযোগ গড়ে ওঠায় এই হ্যালুসিনেশন শুরু হয়েছে।
🍂
কিন্তু এই যুক্তিগুলো ধ্রুবকে শান্ত করতে পারছিল না। সিগারেট শেষ করে ঘরে ঢুকল সে। ঘর অন্ধকার, অথচ আয়নায় আলো পড়ে রয়েছে। ধ্রুব থমকে যায়— আয়নায় একটা ছায়া। সে নিজে আয়নার সামনে দাঁড়ায়নি, তবু তার প্রতিবিম্ব যেন তাকে দেখছে।
সে ঘেমে উঠল, আলো জ্বালাতে গেল, কিন্তু সুইচটা কাজ করল না। পুরো ঘর অন্ধকার, কেবল আয়নায় একটা মুখ জ্বলজ্বল করছে।
অভিজিৎ।
“তুমি তো জানো আমি কে, তাই না, ধ্রুব?” আয়নার ভেতরের মুখটা বলে ওঠে।
“তুমি নেই, তুমি কেবল একটা মানসিক প্রতিচ্ছবি,” ধ্রুব ফিসফিস করে।
“তুমি নিজেই তো আমাকে বানিয়েছো। তোমার নিজের ছায়া— আমি। তুমি যখন অন্যদের বোঝাও কীভাবে তারা ঠিক হতে পারে, তখন নিজের মনকেই তো বোঝাতে পারো না।”
ধ্রুব আয়নার দিকে এগোয়, গলা চিৎকারে ফাটিয়ে বলে, “চুপ! তুমি নেই! তুমি কেবল অভিজিৎ-এর হ্যালুসিনেশন, আর আমিও তাতে বিশ্বাস করে ফেলেছি। তোমাকে আমি তৈরি করিনি!”
মুখটা হেসে বলে, “তাহলে অভিজিৎ কোথায়? তোমার ফাইলগুলো দেখো।”
ধ্রুব তড়িঘড়ি করে ডেস্কে ছুটে যায়। ফাইল বের করে অভিজিৎ-এর কেস হিস্ট্রি দেখতে চায়।
কিন্তু... কোনো অভিজিৎ সরকার নামে রোগীর ফাইল নেই।
তার চেম্বারের রেকর্ডেও না, অনলাইন ডেটাবেসেও না, এমনকি সে যে নোট নিয়েছিল, সেটাও নেই।
তার মাথা ঝিমঝিম করে। তাহলে কি... অভিজিৎ তার নিজের মানসিক বিভ্রম?
সে আয়নার দিকে ফিরে চায়, কিন্তু আয়না ফাঁকা।
---
পরদিন ধ্রুব নিজেই একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেল— ডা. মেহেরা। সব কথা খুলে বলল। মেহেরা তার দিকে চেয়ে চুপ করে শুনলেন, তারপর বললেন, “ধ্রুব, তুমি হয়তো Dissociative Identity Disorder-এর শিকার। কিন্তু এটাও হতে পারে একধরনের অবচেতন গিল্ট— হয়তো তুমি কাউকে ভুলভাবে ডায়াগনোজ করেছো, বা কোনো পেশাগত ট্রমা।”
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, “আমি একজন পেশাদার। আমার মস্তিষ্ক এইরকম বিভ্রম তৈরি করবে কেন?”
ডা. মেহেরা কেবল একটুও হাসলেন না। বরং বললেন, “বুদ্ধিমান মস্তিষ্কই সবচেয়ে জটিল ফাঁদ তৈরি করে।”
---
ধ্রুব আবার বারান্দায়। রাতে। নিজের হাতে আঁকা একটা স্কেচ তার সামনে— অভিজিৎ-এর মুখ। সে তো এঁকেছিল, স্পষ্ট মনে পড়ে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে মুখটা তার নিজের মুখের মতো।
হঠাৎ পেছন থেকে ফিসফিস একটা শব্দ, “আমি বলেছিলাম, আমরা এক...”
ধ্রুব ঘুরে দাঁড়ায়। কেউ নেই।
কেবল তার ছায়া।
1 Comments
একটু অন্য রকম,ভালো লাগলো।
ReplyDelete