বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৭০
ওল
ভাস্করব্রত পতি
'কখনো খেও না ওলে আর ঘোলে।
কখনো ভুলো না রমণীর (ঢেমনা) বোলে'॥
গ্রামের মানুষ তাঁদের গ্রাম্য ছড়ায় ওল, ঘোল আর রমণীর বোল নিয়ে এভাবেই সতর্ক করেছে। তেমনি আরেকটি কিংবদন্তিমূলক স্থাননামের ছড়ায় বলতে শোনা যায় 'ওল কচু কিটনা, তিন নিয়ে ময়না'। আঞ্চলিক ইতিহাসকারদের কাছে এটি বেশ জনপ্রিয় ছড়া।
প্রাক আর্য ভাষায় এক বলা হত 'ওল্ল'। অর্থাৎ যার নিটোল গড়ন, কিন্তু ভিতরে সুবৃত্ত নয় অর্থাৎ দুর্বৃত্ত (যার প্রকৃতি হিংসুক), তাকেই প্রাক্ আর্য' ভাষায় 'ওল্ল' বলে। এই 'ওল্ল' থেকেই এসেছে 'ওল'। এছাড়াও ওলকে রক্তকন্দ, স্থলকন্দ, ওল্ল, ওল্ব বলে। ওল পরিচিত 'সুবৃত্ত' নামেও। আবার 'শুরণ', 'অর্শোয়' নামেও পরিচিত। 'সুবৃত্ত' বা 'শূরণ' অর্থে গোল বা সৎচরিত্র বোঝায়। অনেকের মতে, এটি অর্শ রোগ দূর করে বলে এর অন্য নাম অর্শোয়। চক্রপাণি দত্তের গ্রন্থ 'চক্রদত্ত সংগ্রহ'তে বুনো ওলকে 'শূরণ' এবং চাষের ওলকে 'ভূকন্দ' বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন --
'শূরণঃ দীপনো রুচাঃ কফঘো বিশদো লঘুঃ।
ছাতার মতো আবরণ তৈরি করেছে ওল গাছ
হিন্দিতে জমিন্ কন্দ, ওল, ওড়িয়াতে ওলুখ, তামিলে করুন, তেলুগুতে মুণ্ডাকন্দ এবং ইংরেজিতে Elephant Foot Yam বা Whitespot Giant Arum বা Stink Lily নামে চেনে ওলকে। অথর্ববেদের পরবর্তী সংহিতা গ্রন্থ উপবহণ সংহিতায় আছে সুবৃত্তের কথা -- 'যোহ অস্মভ্যং অরাতীয়াদ্যশ্চ সুবৃত্তং দ্বেষতে জনঃ। নিন্দাদ্যো অস্মান্ ধিপ্প্সাণ্ড সর্বং তৎ ভস্মনা কুরু'। একবর্ষজীবি এই সুপরিচিত কন্দটির বিজ্ঞানসম্মত নাম -- Amarphophallus campanulatus roxb. blume। এটি Araceae পরিবারের অন্তর্গত। এছাড়াও আরও যে যে প্রজাতির সন্ধান মেলে --
Amorphophallus paeoniifolius
Amorphophallus chatty Andrews
Amorphophallus decurrens (Blanco) Kunth.
Amorphophallus dixenii K.Larsen & S.S.Larsen
Amorphophallus dubius Blume
Amorphophallus gigantiflorus Hayata
Amorphophallus malaccensis Ridl.
Amorphophallus microappendiculatus Engl.
Amorphophallus rex Prain
Amorphophallus sativus Blume
Amorphophallus virosus N.E.Br.
Arum decurrens Blanco
Arum phalliferum Oken
Arum rumphii Oken
Conophallus sativus (Blume) Schott
Dracontium paeoniifolium Dennst.
Dracontium polyphyllum G.Forst.
Hydrosme gigantiflora (Hayata) S.S.Ying
Plesmonium nobile Schott
Pythion campanulatum Mart
যাইহোক, এই ওল কিন্তু বেশ জনপ্রিয় খাদ্য। বাঙালির হেঁসেলে ওলের প্রবেশের জন্য অবারিত দ্বার সবসময়ই। রাঁধুনিদের কাছে ওলের ডালনা, ওল সেদ্ধ রসনা তৃপ্তকারী খাদ্য। উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল এটি। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অস্ত্রপ্রদেশ, তামিড়নাড়ু, ওড়িশা এবং মহারাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে ওল চাষ হয়। ছাতার মতো সুন্দর আবরণ তৈরি করে ওলগাছ। এরাজ্যে 'বিধান কুসুম' একটি অন্যতম প্রজাতির ওলগাছ।
ওল কন্দ
প্রবাদে আছে 'চোদ্দ শাকের মধ্যে ওল পরামাণিক'। কার্ত্তিক মাসের ভূত চতুর্দশীতে চোদ্দ শাক তুলবার সময় বলা হয়- 'চোদ্দ শাকের মধ্যে আমি ওল পরামাণিক'। অর্থাৎ উত্তম সমাজে অধম ব্যক্তি অধিষ্ঠিত।
পরামাণিক = প্রামাণিক (শ্রেষ্ঠ)
আরও কিছু প্রবাদে মেলে ওলের প্রসঙ্গ। যেমন -- 'ওল কচু মান / তিনই সমান', 'ওল ধরেছে নিজের গুণ', 'ওল বলে -- মানকচু, ভাই তুমি নাকি লাগ', 'হাঁদা পোদ, ওলকে বলে তালের নোদ'। ডাকের বচনে রয়েছে ওলের কথা --
'কার্তিকে ওল, মার্গে বেল, পৌষে কাঞ্জি, মাঘে তেল।
ফাগুনে আদা, চৈত্রে তিতা, বৈশাখেতে নিম নালিতা।
জ্যৈষ্ঠে ঘোল, আষাঢ়ে দই, শ্রাবণে চূড়ান্ত খই।
ভাদ্রে তাল, আশ্বিনে শশা,
ডাক বলে এই বারোমাসা'।
খনার বচনে ওল সম্পর্কে লেখা হয়েছে --
'চৈতে গিমা' তিতা, বৈশাখে নালিতা মিঠা,
জ্যৈষ্ঠে অমৃত ফল।
আষাঢ়ে খই, শাওনে দই,
ভাদরে তালের পিঠা, আশ্বিনে শশা মিঠা,
কার্তিকে খলের ঝোল।
আগনে ওল, পৌষে কাজি,
মাঘে তেল, ফাল্গুনে চূড়ান্ত বেল'॥
এটিকেই আবার একটু অন্যভাবে বলতে দেখা যায় --
'জ্যৈষ্ঠে খই আষাঢ়ে দই,
শ্রাবণে ঘোল পাস্তা
কার্তিকে ওল, অঘ্রাণে খলিসার ঝোল
বুনো ওলের মধ্যে থাকে ক্যালসিয়াম অক্সালেট। তাই অনেক সময় ওল খেলে গলা চুলকায়। ছড়ায় আছে --'ওল খেওনা ধরবে গলা, ঔষধ খেতে মিছে বলা'। তখন তেঁতুল বা লেবু জাতীয় টক খেলে চুলকানি বন্ধ হয়। কারণ লেবুতে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিড এবং তেঁতুলে থাকা টারটারিক অ্যাসিড এই গলা চুলকানো থেকে উপশম দেয়। তাই বলা হয় -- 'যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেতুল'। আবার গ্রামাঞ্চলে এও বলতে শোনা যায় -- 'ও সখি না বুঝে খেয়েছি ওল, এখন তুই তেঁতুল গোল'। এই ছড়াটিই অন্যভাবে বলতে দেখা যায় 'ওল খেয়ে করেছি গোল / ঠাকুরঝি তুই তেঁতুল গোল'।
সাধারণত ওলের মধ্যে থাকে এনজাইম (Enzyme), ক্যালসিয়াম অক্সালেট (Calcium Oxalate), প্রোটিন (Protein), কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrate), ভিটামিন-এ, বি ইত্যাদি। মারাঠিরা 'মদন মস্ত' তৈরি করে ওলকে টুকরো টুকরো করে কেটে শুকনো করে। অর্শের রক্তস্রাবে, গাঁটে বাত, অগ্নিমান্দ্য, কফ প্রবণতা, গ্রহণী রোগ, বাতের ব্যাথা, দাদ, হাজা, মুখের ক্ষত উপশমে ওল খুব কার্যকরী। কার্তিকের কৃষ্ণাচতুর্দশীর চৌদ্দশাকের মধ্যে ওল রাখতেই হয়। নলসংক্রান্তির ছড়াতেও বলতে শোনা যায় --
'অন সরিষা কাঁকুড় নাড়ি
যা রে পোক ধানকে ছাড়ি
এতে আছে শুকতা / ধান ফলবে মুকতা
এতে আছে কেঁউ / ধান হবে সাত বেঁউ
এতে আছে হলদি / ধান ফলবে জলদি
এতে আছে নীল আদা / ধান হবে গাদা গাদা
এতে আছে পূন্যা খড় / মাচা করে কড়কড়
এতে আছে নিম / পোকার মাথা ঝিমঝিম
এতে আছে ওল / মহাদেবের ধ্যান করে বল হরিবোল'।
🍂
0 Comments