জ্বলদর্চি

হ্যাংগেরিয়ান বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড (H–Bomb) টেলার / পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ০৭
হ্যাংগেরিয়ান বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড (H–Bomb) টেলার 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ। অ্যাডল্ফ হিটলার তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্ষমতায়। জার্মানির একমেদ্বিতীয়ম নেতা। এসময় দুটো আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। এক, ইউরোপ এবং আমেরিকার বিজ্ঞানীরা বিস্ময়ের সঙ্গে কিছু দিন ধরে লক্ষ্য করলেন একটা ব্যাপার: জার্মান বিশেষজ্ঞরা পরমাণু গবেষণা সংক্রান্ত তাদের কোনও প্রবন্ধ আর ছাপতে পাঠাচ্ছেন না কোনও জার্নালে। তখন থেকে যেন খোলামেলা, আন্তর্জাতিক মানসিকতা উবে গেল বিজ্ঞানের মন্দিরগুলো থেকে। তার বদলে সেখানে চলে এল চরম গোপনীয়তা আর অন্ধ দেশভক্তি। সোজা কথায়, বিজ্ঞান যেন দাস বনে গেল কূটনীতির, রাজনীতির। ব্যাপারখানা গভীর চিন্তায় ফেলে দিল ইউরোপ ও আমেরিকার রাজনৈতিক ও বিজ্ঞানের পণ্ডিতদের। দ্বিতীয় ঘটনা আরও ভয়ানক ইঙ্গিতবাহী। জার্মানির দখলে থাকা চেকোশ্লোভাকিয়ার খনি থেকে ইউরেনিয়াম বিক্রি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। কার্য-কারণ সম্পূর্ণ অজানা। তবে বিষয়টি বেশ গম্ভীর। যেন কোনও বৃহৎ ভয়ংকর বিপর্যয়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। এ তারই পূর্বাভাস।

  প্রিয় পাঠক, সকলের অবগতির জন্য জানাই ইউরেনিয়াম হল স্বাভাবিক তেজস্ক্রিয় মৌল। তা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মারাত্মক তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নির্গত হচ্ছে অনবরত। যা শরীরে একবার প্রবেশ করলে ধীরে ধীরে ভয়ানক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় মানুষকে। শুধু তাই নয়, কারও শরীরে একবার প্রবেশ করলে দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে জিনের গঠন পাল্টে ফেলে এই রেডিয়েশন। বিকৃত জিন তৈরি করে আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে বেড়ায় তার বিকলাঙ্গতার অভিশাপ। তা সত্যি-মিথ্যা যা-ই হোক; ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম, প্লুটোনিয়াম-এর মতো তেজস্ক্রিয় পদার্থ দিয়ে অ্যাটম বোমা তৈরির উড়ো খবর হাওয়ায় ভাসছে তখন। কে বলতে পারে, হয়তোবা শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী মারণাস্ত্র তৈরির প্রস্তুতি চালাচ্ছে হিটলারের জার্মানি! একবার তেমন অস্ত্র হাতে এলে মুসকিল হবে হিটলারকে পরাজিত করা। সারা বিশ্বের ক্ষমতা তখন নিমেষে কুক্ষিগত করবে হিটলার জার্মানি।

  বিপদের গন্ধ পেয়ে আইনস্টাইনের কাছে ছুটে এলেন তিন বন্ধু-বিজ্ঞানী। লিও ৎজেলার্ড, ইউজিন উইগনার এবং এডওয়ার্ড টেলার। তিনজনই হ্যাংগেরিয়ান। ইহুদি। সেহেতু ইউরোপ থেকে বিতাড়িত অথবা স্বেচ্ছা-নির্বাসিত। নাৎসিদের ইহুদি-নিপীড়নের ভয়ে সকলে জন্মভূমি ছেড়ে আমেরিকায় হাজির। সেদিন তারা কড়া নাড়লেন আইনস্টাইনের দরজায় আমেরিকার কেন অ্যাটম বোমা বানানো অত্যন্ত জরুরি বোঝাতে। কাজ হয়েছিল আইনস্টাইন মধ্যস্থতা করতে রাজি হওয়ায়। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সেদিন ফেলতে পারেননি প্রবীণ বৈজ্ঞানিকের কথা। তৈরি হল ম্যানহাটন প্রোজেক্ট। পারমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে বোমা তৈরির মিশন। মাত্র ছ'বছরের প্রচেষ্টায় ১৯৪৫-এ আমেরিকা বানিয়ে ফেলেছিল তেমন শক্তিশালী বোমা আর উল্টোদিকে ততদিনে জার্মানি বাধ্য হল বোমা তৈরির মিশন বন্ধ করে দিতে। আসলে তারা কখনও বোমা বানানোর ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি।

  তো, এমন মারাত্মক নিউক্লিয়ার মারণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের পরে পরেই দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল ম্যানহাটন প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদল। একদল চায় না যুদ্ধে বোমা ব্যবহার করে আবারও বিস্ফোরণ ঘটাতে। অন্য পক্ষের মত শত্রুকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। প্রথমে দ্বিতীয় মত পোষণ করলেও হিরোশিমা-নাগাসাকি ঘটনা চাক্ষুস করার পর বিস্ফোরণের বিরোধিতা করে বসলেন রবার্ট ওপেনহেইমার। ম্যানহাটন প্রোজেক্টের সর্বময় কর্তা। সংস্থার ডিরেক্টর। তিনি হ্যারল্ড ট্রুম্যানকে বলে বসলেন 'মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমার হাতে রক্ত লেগে রয়েছে'। ব্যাস, রাতারাতি হিরো থেকে তিনি ভিলেন বনে গেলেন প্রশাসনের চোখে। শুধু মার্কিন প্রশাসন নয়, সতীর্থ বিজ্ঞানীদের একাংশেরও চক্ষুশূল হলেন তিনি। যার মাথা মূলত এডওয়ার্ড টেলার। হ্যাঁ, সেই মানুষটি, যিনি একসময় আইনস্টাইনকে প্ররোচিত করেছিলেন বোমা বানানোর পথে নামাতে! ভারী অদ্ভুত মানুষ এই এডওয়ার্ড টেলার! বিজ্ঞানী হিসাবে তিনি যতটা শ্রদ্ধা ও সম্মান পেয়েছিলেন, যুদ্ধ পরবর্তী তাঁর ভূমিকা আরও বেশি বিতর্কিত ও নিন্দিত করে তাঁকে।

  তা, এ হেন বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেলার-এর জন্ম ১৯০৮ সালের ১৫-ই জানুয়ারি। অস্ট্রিয়-হ্যাংগেরি'র অন্যতম শহর বুদাপেস্ট-এর এক সম্ভ্রান্ত ইহুদি পরিবারে। মা ইলোনা দেবী ভালো পিয়ানো বাজাতেন। বাবা ম্যাক্স টেলার একজন নামকরা আইনজীবী। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান টেলার তিন বছর বয়স পর্যন্ত কোনও কথা বলতে পারতেন না। বুদাপেস্ট-এর বিখ্যাত 'মিন্টা জিমনেশিয়াম'-এ তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয়। গণিতে প্রবল ঝোঁক। সংখ্যা নিয়ে বেশ আগ্রহ তার। যখন তার বয়স মাত্র ছয় বছর, ইউরোপ জুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটে। যুদ্ধশেষে প্রথম বারের মতো হ্যাংগেরি স্বাধীনতার স্বাদ পেল। তবে তা খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। বেলা কুনের সমাজতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলে ধনাঢ্য ইহুদি পরিবারগুলিতে অন্ধকার নেমে আসে। রাষ্ট্রের ঠিক করে দেওয়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত পারিবারিক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে প্রশাসন: হুইপ জারি হল। বাদ গেল না টেলারের পরিবারও। বাজেয়াপ্ত করা হল তাদের সম্পত্তি।
       

  এদিকে পিতার ইচ্ছা অনুযায়ী বুদাপেস্টের বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১৯২৬-এ তিনি জার্মানি রওনা হলেন। সেখানে কার্লসরুহে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করতে। ১৯২৮-এ এখান থেকেই কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গ্র্যাজুয়েট হন। একবার এখানে মোল্যুকুলার স্পেকট্রোস্কোপি'র ওপর অতিথি অধ্যাপক হারমান মার্ক-এর লেকচার শুনে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা মনস্থির করলেন। এ কথা শোনামাত্র সিনিয়র টেলার ছুটলেন ছেলেকে বোঝাতে যে ফিজিক্সে ভবিষ্যৎ শূন্য। এমনকি ছেলের অধ্যাপকদের সঙ্গে কথাও বললেন। ওদিকে ছেলে অনড়, বড্ড জেদী। জেদের বশে ফিজিক্স পড়তে রওনা হয়ে গেলেন ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখ। অধ্যাপক আর্নল্ড সোমারফিল্ড-এর অধীনে ফিজিক্সে বিশেষ ব্যুৎপত্তি আয়ত্ত করলেন। 

  ইতিমধ্যে মিউনিখে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। সেদিন ১৪ জুলাই ১৯২৮। ট্রেনে চড়ে তিনি ঘুরতে যাবেন আল্পস-এ। মিউনিখ থেকে ভাড়াগাড়ি নিলেন। বেরুতে ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ট্রেন ধরার তাড়াহুড়োয় চলন্ত গাড়ি থেকে দিলেন ঝাঁপ। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একেবারে চাকার তলায় গিয়ে পড়লেন। ডান পা মাড়িয়ে চলে গেল চাকা। অপারেশন করে কেটে বাদ দেওয়া হয় তার ডান পা। কৃত্রিম পা প্রতিস্থাপন করা হয়। সেই থেকে সারাজীবন সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটেন তিনি। একসময় সুস্থ হলেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করলেন। তারপর ১৯২৯-এ লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হয়ে গেলেন। প‍রের বছর বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ-এর অধীনে ফিজিক্সে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করেন। এসময় তিনি রাশিয়ান বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো এবং লেভ ল্যান্ডাও-এর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। অতঃপর ১৯৩০-এ রওনা হলেন গটিনজেন ইউনিভার্সিটি। ১৯৩৩ সালে, হিটলারের উত্থানের পর, আন্তর্জাতিক রেসকিউ কমিটির সহায়তায় জার্মানি থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে চলে আসেন। মাঝে এক বছর কোপেনহেগেনে নীলস বোর-এর অধীনে কাজ করে ১৯৩৪-এর সেপ্টেম্বরে পুনরায় ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন। ইতিমধ্যে দীর্ঘদিনের বান্ধবী অগাস্টা মারিয়া, ডাকনাম 'মিকি', -কে বিয়ে করে ফেলেছেন ঐ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। তারপর আমেরিকা নিবাসী রাশিয়ান বন্ধু জর্জ গ্যামো'র আহ্বানে আমেরিকা পৌঁছন ১৯৩৫-এ। সেখানে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ইউনিভার্সিটিতে একসাথে দুই বন্ধু গ্যামো ও টেলার-এর খুব ভালো সময় অতিবাহিত হচ্ছে। ১৯৩৭-এ হারম্যান আর্থার জন-এর সঙ্গে টেলার অনুমান করলেন একটি প্রভাব। 'Jahn-Teller Effect'। বিশেষ শর্তে অণু ভাঙনের ঘটনা। এছাড়া পৃষ্ঠ বিজ্ঞান ও রসায়নে রাখলেন বিশেষ কৃতিত্বের ছাপ। ফলে তৈরি হল Brunauer-Emmett-Teller Isotherm। 
          
  ১৯৪১-এ স্বামী-স্ত্রী উভয়েই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী নাগরিক হলেন। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বন্ধু হান্স বেথে'র সঙ্গে শক-ওয়েভ সঞ্চালনের একটি সূত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিউক্লিয় বোমা বানাতে কোমর বেঁধে নেমেছে আমেরিকা। সেজন্য ১৯৪২-এ রবার্ট ওপেনহেইমারের গ্রীষ্মকালীন সেমিনার বসবে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে'তে। সেখানে আমন্ত্রিত টেলার। বিষয় সদ্য গঠিত প্রোজেক্ট ম্যানহাটন।
           

  নিউ মেক্সিকো'র লস অ্যালামস-এ গোপনে শুরু হল বোমা বানানোর কারখানা। ১৯৪৩-এর শুরুতে ল্যাবরেটরির সবরকম প্রস্তুতি সারা। মার্চে সেখানে এলেন টেলার। তাত্ত্বিক ব্যাপার স্যাপার দেখাশোনা করা তাঁর কাজ। চরম গোপনীয় এই মিশনে তাঁর ছদ্মনাম 'এড টিলডেন' (Ed Tilden)। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। সমস্যা বাধল থিওরি বিভাগের প্রধান কে হবে তা নিয়ে। তিনি সবার প্রথম লস অ্যালামস-এ এসেছেন। সুতরাং তিনি হবেন থিওরি বিভাগের প্রধান। এটা তাঁর যুক্তি। অথচ তাঁকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞানী হান্স বেথে'কে বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত করেছেন প্রোজেক্ট ডিরেক্টর ওপেনহেইমার। রাগে অপমানে মনের মধ্যে ক্ষোভ পুষে রাখলেন টেলার। ওপেনহেইমারের সঙ্গে তিক্ততার সেই শুরু। উপরন্তু ১৯৪৪-এর জুনে বিজ্ঞানী বেথে'র অনুরোধে টেলারকে থিওরি বিভাগ থেকে সরিয়ে দেন ওপেনহেইমার। তার বদলে একটি স্পেশাল 'সুপার' (Super) গ্রুপের প্রধান নিযুক্ত করেন। যারা সরাসরি ওপেনহেইমারকে রিপোর্ট করতে পারবে। থিওরি গ্রুপে (T গ্রুপ) তার জায়গায় ব্রিটিশ মিশন থেকে আনা হল রুডল্ফ পেয়ারসকে, যার মাধ্যমে লস অ্যালামস-এ এলেন বিজ্ঞানী ক্লস ফুকস। এই সেই ফুকস যিনি আদপে একজন সোভিয়েত চর। 

  এনরিকো ফার্মি লস অ্যালামস পৌঁছলে 'সুপার গ্রুপ' ফার্মির F গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ১৯৪৪-এর সেপ্টেম্বরে। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হলেন স্টেনিস্ল উলেম, জিওফ্রে চিউ, মেয়ার প্রভৃতি বিজ্ঞানী। এত সবকিছুর পরেও সেদিনের অপমান ভোলেননি টেলার। মনের ভেতর দীর্ঘদিন লালন করেছেন রাগ। যুদ্ধ পরবর্তী ওপেনহেইমারের বিচারের সময় মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে তাই এতটুকু পিছপা হননি তিনি। সেদিনের সুন্দর প্রতিশোধ নিলেন ভুল তথ্য পরিবেশন করে। যদিও অধিকাংশ কলিগ বিজ্ঞানী তাঁর এরূপ আচরণ মেনে নেননি। তার ফলে একসময় সতীর্থ বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে প্রায় একঘরে হয়ে বিচ্ছিন্ন ছিলেন তিনি। অবশ্য তার আগে টেলারের রাগের কারণ ছিল বহুমুখী। ১৯৪৫-এর ১৬ জুলাই ভোর ৫টা ২৯ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে নিউ মেক্সিকোর অ্যালামোগোর্ডো'র মরুভূমিতে ফাটল মানুষের তৈরি এযাবৎ কালের বিধ্বংসী মারণাস্ত্র 'ট্রিনিটি'। এবার 'লিটন বয়' ও 'ফ্যাট ম্যান'-এর পালা। কী করা হবে এদের দিয়ে? ওপেনহেইমার মত দিলেন জনবহুল শহরের উপর ফেলবার। সেদিন এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন টেলার। তিনি বলেছিলেন শত্রুকে আগে সতর্ক করা হোক। বোমা দুটো ফেলা হোক জনশূন্য স্থানে। বিস্ফোরণের ভয়াবহ রূপ দেখে আপনাআপনি যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হবে শত্রুপক্ষ। তার সে-কথা মানা হয়নি সেদিন। আসলে বোমা কোথায় ফেলা হবে বা কোথায় ফেলা হবে না তা তাদের দুজনের কারও ওপর নির্ভর করেনি। তাদের সে ক্ষমতা নেই। যা কিছু সিদ্ধান্ত নেবেন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। উলুখাগড়ায় ঝগড়া লাগল আর হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা ফেলে দিল ট্রুম্যান। দুই শহরের ধ্বংসের ছবি দেখে অনুতপ্ত ওপেনহেইমারের সেই বিখ্যাত উক্তি 'মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমার হাতে রক্ত লেগে রয়েছে'। তারপর থেকে তিনি পুরোপুরি শুধু আর অ্যাটম বোমা নয়, হাইড্রোজেন বোমারও বিরুদ্ধে চলে গেলেন। অথচ পরমাণু বোমার সফল বিস্ফোরণের পর আমেরিকা জুড়ে তাঁর জয়জয়কার। পরমাণু বোমার জনক হিসাবে। উল্টোদিকে ১৯৪৬ সালের ১-লা ফেব্রুয়ারি টেলার লস অ্যালামস ছেড়ে শিকাগো চলে আসেন। মনোনিবেশ করেন অধ্যাপনায়, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও তাঁর একান্ত ইচ্ছা হাইড্রোজেন বোমা (H-বোমা) তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করুক ওয়াশিংটন। এজন্য তিনি লস অ্যালামস-এ থাকাকালীন অনেকটা কাজ এগিয়ে রেখেছেন। লস অ্যালামস-এর পরিত্যক্ত ল্যাবরেটরি হবে এর আদর্শ জায়গা। অথচ, ওপেনহেইমার চান লস অ্যালামস ফিরিয়ে দেওয়া হোক রেড ইন্ডিয়ানদের। 
           

  এমন টানাপোড়নের মাঝে বিশ্ব রাজনীতিতে শুরু হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ উত্থান-পতন। ১৯৪৮-এ চেকোশ্লোভাকিয়ায় ক্ষমতা দখল করেছে কমিউনিস্টরা। মস্কোর প্রত্যক্ষ মদতে। একই বছরে বার্লিনের বুক চিরে মাথা তুলেছে মস্ত দেওয়াল। ভাগ হয়েছে জার্মানি― পূর্ব ও পশ্চিমে। আমেরিকার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ১৯৪৯-এর শরতে ঘটল আরেক বিস্ময়কর ঘটনা। সোভিয়েত রাশিয়া ফাটাল অ্যাটম বোমা। ঘুম ছুটে গেল মার্কিন প্রশাসনের। ওদিকে লন্ডনের ওয়ার অফিসে গিয়ে স্বীকারোক্তি দিলেন কমিউনিস্ট ধারণায় বিশ্বাসী সোভিয়েত চর বিজ্ঞানী ক্লস ফুকস। যিনি ১৯৪২ থেকে ম্যানহাটন প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একটি পয়সাও নয়, কমিউনিজম ভাবধারায় বিশ্বাস করে এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করেছেন স্পষ্ট স্বীকারোক্তি ফুকস-এর। 

  কমিউনিজমের কথায় আগুনে ঘি পড়ল যেন। দারুণ ক্ষিপ্ত প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ১৯৫০ সালের ৩০ জানুয়ারি বিশেষ নির্দেশে সই করলেন। এক্ষুনি হাইড্রোজেন বোমা তৈরির লক্ষ্যে পুরোদমে কাজ শুরু করুন বিজ্ঞানীরা। ব্যাস, অভাবিত সুযোগ এসে গেল টেলারের সম্মুখে। তিনি লস অ্যালামস-এ ফিরলেন। হলেন হাইড্রোজেন বোমা প্রকল্পের চিফ। তাঁর তত্ত্বাবধানে শুরু হল H-বোমা তৈরির কর্মযজ্ঞ। দেশজুড়ে উঠল নিন্দার ঝড়। নিউক্লিয় অস্ত্রের বিরুদ্ধে। কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে অব্যাহত রইল H-বোমা তৈরির কাজ। হাতে নাতে মিলল সাফল্য। আমেরিকা হাইড্রোজেন বোমা ফাটাল ১৯৫২ সালের ১-লা নভেম্বর। পরীক্ষামূলক সেই বিস্ফোরণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল প্রশান্ত মহাসাগরের আস্ত একটা তিন মাইল দ্বীপ। কী এই হাইড্রোজেন বোমা? যার জন্য দ্বিধাবিভক্ত পণ্ডিতগণ!
             

  ভারী মৌলের (ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম, প্লুটোনিয়াম) নিউক্লিয়াস ভেঙে পরমাণু বোমা তৈরি করা হয়। ভারী নিউক্লিয়াসের ভাঙনে উৎপন্ন হয় দুটি মাঝারি সাইজের নিউক্লিয়াস ও দু'একটি নিউট্রন কণা। দুহিতা নিউক্লিয়াস ও নিউট্রনের মিলিত ওজন ভারী নিউক্লিয়াসের ওজনের চাইতে কম। আপাতভাবে মনে হয়, এই নিউক্লিয় বিক্রিয়ায় ভর হ্রাস পায়। কিন্তু না, ভরের এই পার্থক্য, আইনস্টাইনের E = mc2 নিয়ম মেনে, সমতুল্য পরিমাণ শক্তিতে রূপান্তরিত হয় ও মুক্ত হয়। এই প্রক্রিয়াকে নিউক্লিয় বিয়োজন বিক্রিয়া (Fission Reaction) বলা হয়। 

  নিউক্লিয় বিয়োজন-এর বিপরীত প্রক্রিয়া হল নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া (Fusion Reaction)। ফিউশনে দুই বা তার বেশি হালকা মৌলের (যেমন হাইড্রোজেন) নিউক্লিয়াসের সংযোগ ঘটিয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী মৌলের (হিলিয়াম) নিউক্লিয়াস উৎপাদন করা হয়। সেই সঙ্গে কিছু মৌলিক কণা বা নিউক্লিয়াস নির্গত হয়। এক্ষেত্রে বিক্রিয়াজাত পদার্থের মোট ওজন বিক্রিয়ক নিউক্লিয়াসের ওজনের চাইতে কম। পুনরায় আইনস্টাইনের E = mc2 নিয়ম মেনে, বিক্রিয়কের এই অতিরিক্ত ভর থেকে বিপুল পরিমাণ শক্তির মুক্ত ঘটে। এই প্রক্রিয়া নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া নামে পরিচিত। সূর্যসহ সমস্ত নক্ষত্রের শক্তির উৎস এই ফিউশন বিক্রিয়া। তা, এ হেন নিউক্লিয় সংযোজনে বিয়োজন বিক্রিয়ার চেয়ে দশ গুণ বেশি শক্তি উৎপন্ন হয়। আর হাইড্রোজেন বোমার ভিত্তি হল নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া। সেজন্য হাইড্রোজেন বোমার বিধ্বংসী ক্ষমতা পরমাণু বোমা অপেক্ষা হাজার গুণ বেশি। সুতরাং সেই মারণ বোমার জনক হিসাবে বিখ্যাত হলেন এডওয়ার্ড টেলার। এ হেন মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম লাভ করেন ঠিকই, এর থেকেও বেশি জুটেছিল সীমাহীন ধিক্কার। তিরস্কারের সেই স্ট্রমা থেকে আর কোনদিন বের হতে পারেননি তিনি এবং তাঁর পত্নী মিকি। যদিও এমন বোমা আবিষ্কারের পর তাঁর উত্তরোত্তর পদোন্নতি ঘটে। অনেক পুরস্কার ও সম্মানের অধিকারী হন তিনি।
          

  প্রশ্ন জাগে― মানুষটি কেন এত বিতর্কিত? কেন সকলের চক্ষুশূল? ওপেনহেইমার কেস-এ তাঁর স্বীকারোক্তি স্মরণে রেখেই বলি: কারণ সম্ভবত বিবিধ। এক, সতীর্থ বিজ্ঞানী স্টেনিস্ল উলেম-কে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রথম হাইড্রোজেন বোমার ডিজাইন তৈরি করলেন। অথচ সম্পূর্ণ কৃতিত্ব নিলেন নিজে। পরে তা সাংবাদিক ডেকে ঘোষণাও করলেন। ব্যাপারটা অনেক বন্ধু বিজ্ঞানী ভালোভাবে মেনে নেয়নি। দুই, তাঁর নিজের কথায়, 'একজন মানুষ; যে তার দেশ ছেড়ে, জন্মভূমি ছেড়ে, আত্মীয় পরিজন–বন্ধুবান্ধব ছেড়ে সুদূর প্রবাসে জীবন অতিবাহিত করে; বিদেশ বিভূঁই-এ একমাত্র তার প্রফেশনাল সহকর্মীদের সঙ্গে সে সময় কাটাবে, দুটো মনের কথা কইবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন সে দেখে তার শতকরা নব্বই ভাগ কলিগ তাকে শত্রু ভাবে, অবজ্ঞাভরে পরিত্যাগ করে, তার সংস্পর্শে আসতে সংকোচ বোধ করে; তখন তার ওপর এর একটা গভীর খারাপ প্রভাব পড়ে বই কি! এই প্রভাব আমাকে গ্রাস করেছিল। আমার পত্নী মিকি তীব্র মানসিক কষ্ট স্বীকার করে। তার পক্ষে যা চূড়ান্ত স্বাস্থ্যহানীকর।' তিন, হাইড্রোজেন বোমার পেছনে লেগে থাকা বোধহয় তাঁর শৈশবের কমিউনিজম বিদ্বেষ। প্রথম মহাযুদ্ধের পর হ্যাংগেরি'তে কিমিউনিজমের উত্থান হয়। সেসময় কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা তাদের পারিবারিক সম্পত্তির বেশ কিছু অংশ জোরপূর্বক বাজেয়াপ্ত করে নেয়। শৈশবে চোখের সামনে এ দৃশ্য দেখে তাঁর বেড়ে ওঠা। এ ক্ষোভ তো ছিল, তার সঙ্গে জুড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ জুড়ে মাথাচাড়া দিচ্ছে কমিউনিজম এবং কমিউনিস্ট গুপ্তচর ক্লস ফুকস-এর স্বীকারোক্তি।

  তবে, কারণ যাই হোক না কেন, শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নিরিখে তাঁর হাইড্রোজেন বোমা ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে; যদিও ধ্বংসাত্মক ও হিংসাত্মক যজ্ঞে এর ব্যবহার আজ পর্যন্ত কেউ করেনি। তারপর এল শেষের সে দিন। ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৩ সাল। হঠাৎ স্ট্রোক-এ আক্রান্ত হলেন তিনি। হাসপাতালে ভর্তি করা হল ৯৫ বছর বয়সী প্রবীণ বিজ্ঞানীকে। শেষ রক্ষা আর হল না। দুদিন পর ৯ সেপ্টেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড-এ চিরনিদ্রায় চলে গেলেন বিংশ শতাব্দীর চির বিতর্কিত মানুষটি।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন। 

Post a Comment

0 Comments