জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় লেখক সাবিত্রী রায় / ঈশিতা ভাদুড়ী


বিস্মৃতপ্রায় লেখক সাবিত্রী রায় 

 ঈশিতা ভাদুড়ী


বিশ শতকের চল্লিশের দশকের লেখিকা সাবিত্রী রায়ের (২৮-৪-১৯১৮ — ৮-১২-১৯৮৫) নারীবাদী লেখাগুলি মূলত তাঁর উপন্যাস এবং ছোটগল্পে প্রতিফলিত, যেখানে তিনি নারী ও সমাজের প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং নারীত্বের প্রতি গভীর মনোযোগ রেখেছিলেন।

 ১৯৪৭ সালে সাবিত্রী রায় প্রথম উপন্যাস লেখেন, ‘সৃজন’। সেই উপন্যাসে তিনি নারী সচেতনতার একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজের জটিলতা ও দ্বিচারিতা তুলে ধরেছেন। একটি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ধারাবাহিক ইতিহাস গল্পের সঙ্গে সঙ্গে লিপিবদ্ধ হয়েছিল তাঁর উপন্যাসে। তাঁর আরেকটি উপন্যাস ‘ত্রিস্রোতা’ তৎকালীন সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়ায়নি, সেখানে সাবিত্রী রায়ের আত্মজৈবনিক উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।

তিনি মোট আটটি উপন্যাস লিখেছিলেন, সেগুলির সব ক’টিকে সহজেই শিল্পমান উত্তীর্ণ বলা যায়। তাঁর দুটি উপন্যাস ‘পাকা ধানের গান’ এবং ‘মেঘনা-পদ্মা’ তিন পর্বে লেখা হয়েছিল, সেগুলি পাঠকপ্রিয় যেমন হয়েছিল, এমন কি সমকালীন খ্যাতিমান লেখকদের কাছ থেকেও বহুল প্রসংশিত হয়েছিল। সন্দেহাতীতভাবেই ‘পাকা ধানের গান’ একটি সফল রাজনৈতিক উপন্যাস। বিশ শতকের চল্লিশের দশকের শুরু থেকে পঞ্চাশ দশকের প্রথম বছরগুলো অবধি বাঙালী যে কঠিন সময় অতিক্রম করেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা, কঠোর রাজনীতি এবং সর্বশেষে মন্বন্তর-দাঙ্গা-দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু সমস্যায় জর্জরিত কঠিন সময়ে যেসব উপন্যাস রচিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে সাবিত্রী রায়ের ‘পাকা ধানের গান’ উপন্যাসটির নাম অন্যতম হিসেবে গণ্য হতে পারে। 


🍂
ad

সাবিত্রীর উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য বোধ হয় তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা, চাক্ষুষ ব্যক্তিচরিত্রগুলির সমকালীন সামাজিক-ঐতিহাসিক ঘটনাবলির উপস্থিতি। এক দিকে মূলত সমাজের বহিরঙ্গের বর্ণনা, অন্য দিকে মধ্যবিত্ত সমাজে মেয়েদের পরিবর্তিত অবস্থান নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর ফসল। নারীচেতনাকে অত দিন আগে সাবিত্রী রায় দেখেছেন এবং লিখছেন এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে, যেখানে দ্বন্দ্বের মূল জায়গাটা নারী-পুরুষ নয়, তার চেয়ে অনেক গভীর ও জটিল। তাঁর উপন্যাসে শাসিত, লাঞ্ছিত, পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক নারীও কম-বেশি উপস্থিত।

সাবিত্রী রায়ের লেখাগুলি শুধুমাত্র নারীত্বের প্রতি মনোযোগ রাখেনি, বরং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবন ও অভিজ্ঞতার প্রতিও গভীর মনোযোগ রেখেছিল। ১৯৫২ সালে লেখা তৃতীয় উপন্যাস ‘স্বরলিপি’ও আলোড়ন তুলেছিল বিবিধ কারণেই। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের ভারতের বামপন্থী আন্দোলন ও তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি, পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের অসহায়তার লড়াই, বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর কালের বৃহত্তর বাংলার বিপুল পরিবর্তন, তেভাগার মতো রাজনৈতিক আন্দোলন, এবং প্রগাঢ় ভালোবাসা নিয়ে এই উপন্যাস। শোনা যায় কমিউনিস্ট পার্টির সমালোচনার কারণে এই উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং বইটির প্রচুর কপি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। 

তাঁর তীক্ষ্ণ মননশীল, বিদগ্ধ, ও অতি সমাজ-সচেতন লেখনী সুদক্ষ আঁচড়ে জীবনকে সাহিত্যের পৃষ্ঠায় জীবন্তভাবে এনেছিল। এই উপন্যাস প্রসঙ্গে সাবিত্রী রায় বলেছিলেন “এ উপন্যাসও আমার পূর্ববতী উপন্যাস দুইটির মতই, কোনও চরিত্র মিথ্যা নয় – বাস্তবেরই ছায়া, আবার কোনও চরিত্রই সত্য নয় – কল্পনারই প্রতিছায়া মাত্র”, যাকে অবশ্যই ঔপন্যাসিকের সাহিত্যাদর্শ হিসাবে ধরে নেওয়া যায়। নিজ সময়ে প্রশংসিত এই লেখক যে আজ বিস্মৃতপ্রায়, সে আমাদেরই লজ্জা। ১২৭ বছর আগে জন্মানো এই লেখক আজও আমাদের বিস্ময়, একথা অনস্বীকার্য। তাঁকে আমার প্রণাম।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇



Post a Comment

0 Comments