কমলিকা ভট্টাচার্য
পরম সঞ্চয়
সম্পর্কের তো কোনো শরীর নেই,
তবু প্রতিটি সকাল তাকে শাড়ির আঁচলে সাজাই,
ভোরের রোদে মেখে দিই স্নেহের সিঁদুর,
কান্নার ফোঁটায় গুঁজে দিই আদরের কুসুম।
এক মুঠো ভালোবাসা দিয়ে গড়ি তার মেরুদণ্ড,
একরাশ খুশিতে আঁকি তার চোখের পাতায় স্বপ্ন,
লুকোচুরির রোমাঞ্চে তার ঠোঁটে দিই ব্যাকুলতা,
অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাসে তার বুকে গাঁথি বাসনার মালা।
একটা সম্পর্ক মানে তো শুধু দুটি মানুষের গল্প নয়,
তা এক বিস্ময়-রান্না, যেখানে মশলা হয় বিশ্বাস,
নুন হয় বোঝাপড়া, আর আঁচ হয় সংযমের।
রাগের জলে সেদ্ধ হয় অভিমান, আর ভালোবাসা দিয়ে হয় তার পরিবেশন।
ঈশ্বর আমাদের আত্মায় দিয়েছেন হাজার স্বাদের উপাদান—
দারুচিনির মতো কোমল গভীর ভালোবাসা,
মধুর মতো নীরব স্নেহের উপশম,
লঙ্কার মতো তীব্র কিন্তু সত্য রাগ,
আর উচ্ছে-র মতো অনিচ্ছিত অথচ মানবিক হিংসে।
আমরাই নিজেদের জীবনের রাঁধুনি,
তবু আমরা ছুটে চলি শুধু সোনার থালার খোঁজে, স্বাদের কথা ভুলে।
অর্থ দিয়ে অর্থহীনের পাহাড় গড়ি, যেন ক্ষততে ছড়ানো নুন,
আর একাকীত্বের ঝোল খাই রূপোর চামচে।
তবু একটা সম্পর্ক, যত্নে গড়া —
সে যেন শরতের কাশফুলে লেখা পত্র,
যার প্রতিটি বাক্যে জড়িয়ে থাকে,
“আমি আছি”—এই মৃদু অথচ প্রবল প্রতিশ্রুতি।
সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা সম্পদ হারানো নয়,
সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা সেই নিঃসঙ্গতা,
যেখানে ঘরে ফেরা মানে ঝড়ের চেয়েও উচ্চ শব্দে নীরবতা,
যেখানে কোনো হৃদয় ধ্বনি মেলে না আনন্দে,
কোনো হাত নেই বৃষ্টির ছাতার মতো পাশে থাকার।
একটা সম্পর্ক—যদি হয় নীড় হয়ে গড়া,
তবে তা সময়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃক্ষ,
যার পাতায় পাতায় জড়িয়ে থাকে বেঁচে থাকার মানে।
কারও ভালোবাসা হয়ে ওঠে দীঘির শান্ত জলে মুখ দেখার সাহস,
কারও জন্য প্রতিটি শ্বাস—একটি প্রার্থনা, একটি প্রতীক্ষার দীপ্তি।
এই তো জীবনের পরম সঞ্চয়—
যেখানে হৃদয় খুঁজে পায় নিজের প্রতিধ্বনি,
আর অস্তিত্ব মিশে যায় কারও নিঃশ্বাসে
যেমন সন্ধ্যার হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ধূপের ধোঁয়া,
নীরব অথচ অনিবার্য।
তুমি ঘরে ফেরো
আর পারি না! আর পারি না!
গনগনে আঁচের সংসার মাথার উপরে,
তবু কিছু ভালোলাগা—তোমায় ভেবে
কেঁপে কেঁপে ওঠে আগুন ঘিরে বাতাসের মতো।
জ্বালানিকাঠে জমা শক্তি
ফুটিয়ে তোলে ভাত,
বেড়ে দেওয়া সুখে
একটু জিরোনোর ছুঁই ছুঁই মুখ তোমার।
চুরি করি আমি সেই স্বস্তি—
আমার দুপুরবেলায় হাত বোলানো ঘুম।
ঘুরে চলে পাখা, ক্যালেন্ডারের পাতা দুলে ওঠে,
সময়ের শরীর গড়িয়ে
বিকেল ডেকে আনে।
অবসরে দুটো কাপ,
তবু বাতাসে ‘চিয়ার্স’,
সন্ধ্যা নামার আগে
বাঁধা চুলে স্বপ্নগুলো জড়িয়ে
আয়নার সামনে দাঁড়াই—
তুমি বলো, "টিপ পরোনি আজ?"
বাহুর বাঁধনে আলগা শরীর,
তার গন্ধ মিশে যায়
ভালবাসার নিঃশব্দ পূজোয়।
তুমি ঘরে ফেরো,
আমার কাছে।
🍂
রাতের প্রতীক্ষা
সারা দিন শুধু ভাবি তোমায়,
তোমার কবিতার ছায়ায় ঘুম-না-আসা দুপুর পেরোয়।
হাতের কাজ ফেলে রাখি, হৃদয় শুধু এক নামে ডাকে—
তুমি আসবে রাতে, নিঃশব্দে, জোছনাভেজা পায়ে।
চাঁদের আলো মেখে আজ জানলাটাও যেন জেগে,
জানে, সে আসবে—হাতে কবিতার গন্ধ লেগে।
সে হাত ছুঁবে আমার ঠোঁট,
আদরে বিছানায় তাকে জড়িয়ে—
তার প্রশস্ত বুকে লিখে দেব আমার নাম,
কানেকানে বলব চুপিসারে,
"তোমার লেখা পংক্তি, সে-ই আমার শ্রেষ্ঠ উপহার,
জীবনের যত অভাব, সব পূর্ণ হয় সেই কথার ছোঁয়ায়।"
এভাবেই প্রতিরাত হয় উৎসব,
যখন তুমি আসো—কবিতা হাতে, ভালোবাসা বুকে গাঁথা।
আমি শুধু পড়ে যাই তোমায়,
প্রতিটি শব্দে খুঁজি তোমাকে নতুন করে।
তুমি ঘুমিয়ে পড়ো—
তোমার কপালে চুম্বন এঁকে,
বলি, “তোমাকে জেনে, আমি রোজ নিজেকে গড়ি।”
তুমি—আমার দিশারী
সকাল আসে না,
দুপুর আসে না,
আসে না বিকেল,
আসে না রাত্রি—
আসো শুধু তুমি।
মনের রঙ বদলায়,
দিন কেটে যায়—
তোমার গন্ধ কস্তুরীর মত
আবেশ হয়ে ছুঁয়ে থাকে আমায়।
যেমন মাটি থেকে গাছ শুষে নেয় রস,
বাতাস থেকে অক্সিজেন,
আলো থেকে শক্তি,
নিজের সবুজে ভরে উঠে,
তৈরি করে বেঁচে থাকার খাদ্য—
তেমনি আমি,
তোমার ভালোবাসার পুষ্টিতে ভরাই নিজেকে।
তবে আমিও গাছের মত একাকি বাঁচতে জানি না
ভালোবাসার কণা কণা বিলিয়ে
তৈরি করব জীবন–আনন্দের সেনা।
বৃত্তের পরিধি বাড়বে
কম্পন তরঙ্গের মতো,
আর সেই কেন্দ্রবিন্দুতে—
তুমি, শুধু তুমি
আমার দিশারী।
তোমার টানেতে আটকে আছি,
নিভৃত এক ঘূর্ণির মাঝে—
নিশ্চল, তবু প্রকম্পিত।
জীবনপথে হেমন্তকালে দাঁড়িয়ে
মন ছিল বেশ
মিছি মিছি ব্যস্ত,
কেটে গেছে সময়ের
অজান্তে কিছুটা অংশ।
হঠাৎ কে যেন ডাক দিল—
চারিদিকে সব ছিল খালি,
ফিরে ফিরে এলো আওয়াজ—
"একবার শুনেনে মনের কথা,
খুঁজেনে একটা জীবনের মানে।"
আগে যে পথের না জানা খোঁজ,
নেই সেদিকে কৈশোরের উদ্যোগ।
বারবার পড়েও উঠে দাঁড়াবার সুযোগ
নেই যৌবনের সাহসে গড়া ভোগ।
পিঠে চাপা পড়ে থাকা বোঝা,
স্বপ্নভাঙা জ্যোৎস্নার খণ্ড খণ্ড স্মৃতি
নিয়মের কাঁটাতারে বাঁধা মন,
যন্ত্রের মতো চলাকেনো আজীবন?
তবু এক কণ্ঠ বড় আপন করে ডাকলো
"আমি আছি,
আছি পাশে নীরব দীপ্তিতে।
জীবনটা শুধু হিসেবের নয় খাতা ,
জিয়ো, অনুভব করো—
এই বাতাস, এই আলো,
এই মুহূর্তের নিঃশব্দতা!"
পিছনের পাতা
খুলে দেখা অভিজ্ঞতা
তবু সামনের পাতায় কি হবে লেখা?
নতুন কিছু—
ভালোবাসার ভাষায়,
মায়ার নতুন ব্যাকরণে
শুধু ভালোলাগা মনে মনে।
তোমার কন্ঠেই কি সেই ডাক?
যে বলে যায়
তোমার জীবনের মানে হবো,
নীরবে হৃদয়ে রবো।
আমি যে রাজি
বিশ্বাসে ভেসে যাব
জানি নতুন দিগন্ত খুঁজে পাবো।
চুম্বনের দাগ
ধীরে ধীরে সময় খেয়ে যাবে সব
রাগ অভিমান মান অপমান
সব সয়ে ধীর পায়ে পেরিয়ে যাব তোমার উঠোন
সেদিন তোমার গামলায় ফুটবে পদ্ম
তোমাকে ছুঁয়ে থাকবে আমার সব প্রার্থনা
সেদিনও দুপরের রোদ ঢেকে
দাঁড়িয়ে থাকবে বড় বিল্ডিং
ছায়ার শীতলতা তোমার হলুদ শার্টে
তোমার প্রতিশ্রুতির হাসি ঝরবে
পুরোনো গোলাপের পাঁপড়িতে
আমার ছায়া হয়ত দূরে অজানা প্রান্তরে হেঁটে যাবে আমার সাথে
পায়ে লেগে থাকবে তোমার চুম্বনের
দাগ।
তখন তোমার চোখ খুঁজবে পুরোনো নীলাকাশ—
আর আমি হয়ে উঠব শরতের ক্লান্ত বিকেল,
যেখানে আলো থামে, অথচ নিঃশব্দে ঝরে পড়ে রোদ।
আমি জানি, তুমিও ভালোবেসেছিলে আমায়,
রেখেছিলে তোমার হৃদয়ের কোনো ছায়াঘেরা বারান্দায়।
না হয় সেখানেই অলক্ষে রেখো আমায়।
আছো তো?
প্রতিদিন দ্বন্দ্বের মধ্যে আবিষ্কার করি এক নতুন আমিকে
ঠিক সন্ধ্যামালতির মত,
দিনের দৌরাত্ম্য সামলে
ফুটি সন্ধ্যা সাজাতে—
সন্ধ্যায় যদি এলে,
ধ্রুব তারায় কেনো খোঁজো ফেরার ঠিকানা?
তুমি সন্ধ্যাতারার মত আমার আকাশে উজ্জ্বল—
রাতের শেষে, আমার বুকে শুকতারার ছায়া এঁকে যাও।
তোমাকে চাওয়ার এখন হিড়িক লেগেছে আমার,
দিনের আলোতেও পথ হারিয়ে যায়।
তবুও, আমি লিখতে বসি।
তুমি দূরে, আমি এখানে—
দুজনার মাঝখানে কেবল দূরত্ব নয়,
আছে না-পারাপারের এক দীর্ঘশ্বাস।
সকালবেলা চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালেই
তোমার স্পর্শ পাই
মনে হয়, তুমি যেন আমার ঠোঁটে একটুখানি চুমু রেখে গেছো
ঘুম ভাঙার ঠিক আগে।
দূরের ছোট বিরতিতে,
যখন তুমি খাবার সাজাও প্লেটে
তোমার চোখে আমাকে খোঁজার আর্তি আমিও অনুভব করি
হয়তো আমার নাম আস্তে করে উচ্চারণ করো,
জানতে চাও আমি খেয়েছি কিনা
আর আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে।
সন্ধ্যায় দু’কাপ চা বানাও রোজ
এক কাপ আমার জন্য,
সে অনুভব আমি আমার নিঃসঙ্গতার পাশে রাখি।
যেই গোপন নামে ডাক দিই,
শুধু নিস্তব্ধতা ফিরে আসে।
তবুও জানি— ঠিক সেই মুহূর্তে,
তুমিও উদ্ভ্রান্ত হয়ে আমায় খুঁজছো।
তোমার বুকের ভিতরও জ্বলে ওঠে বিরহের আগুন।
রাত গভীর হলে,
আমি লেখা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি।
ঠিক তখনই, তুমি চুপিচুপি চলে আসো—
আমার কপালে একটা চুমু রেখে যাও
যার স্পর্শে আমি জানি,
ভালোবাসা সব দূরত্ব পেরোয়।
আমার আত্মা ছুটে যায় তোমার কাছে
রাতের গভীর নীরবতা ভেঙে
তোমার বুকের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
কারণ তুমি দূরে থেকেও,
আমার প্রতিটি অনুভবে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছো
আছো তো?
0 Comments