জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন /পর্ব -৫১/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব -৫১
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

|| এখানে পিঞ্জর ||
                   
      
কবে যেন ছোড়দা ফোন করে বলল রাস্তা পার হওয়ার সময় গড়িয়াহাটার মোড়ে ধুতি পাঞ্জাবি পরা দিশেহারা এক বুড়ো মানুষকে দেখে ওর বাপির মুখ মনে পড়ছিল,সে চুপ করে ছিল। বলতে পারত গত সপ্তার ছ' নাম্বার বেডের পেশেন্টের কথা। রেনাল ফেলিওরের একেবারে শেষ পর্যায়ে ভর্তি বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ব্লাডের সোডিয়াম পটাশিয়াম ঘেঁটে ভুল বকছিলেন। শ্বাস কষ্টের জন্য অক্সিজেন চলছিল। রাউন্ডে তাকে দেখেই হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন সকালে আসো নাই ক্যান? আমি মরলে তুমি কপাল থাপড়াবা।বুঝবা ত্যাখোন। আমি কে বলুন তো। বুকে স্টেথো বসাতে বসাতে জিজ্ঞেস করলে বললেন কেডা আবার! আমার মেইয়ে ভারু। দুপুরেই তাকে ভেন্টিলেশনে দিতে হলো আর পরদিন সকালে ডিউটিতে গিয়ে ছ' নাম্বার বেডে অন্য রুগি  দেখে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে বাপির কথা ভাবলেও তাদের বাবা যে অন্য কোথাও আছে বিশ্বাসই করে না। নানা বিষয়ে তুমি হলেও এটাই করতে ;আবার আমায় বলো কী জাতীয়  তর্ক চালায় বিড়বিড় করে বাবার সঙ্গে, যেন এটাই দস্তুর।
            পাঁচ বছরের শালিখও এখন দিব্যি স্কুলবাসে চেপে সবার সাথে ইস্কুলে যায়। দিল্লির এন আই সি ডি তে পলাশ গেছে মাস্টার্স করতে গেছে। তবে মুশকিলটা হলো মাস ছয়েকের জন্য  তার  পোস্টিং হলো বালুরঘাট সংশোধনাগারে।
          এমনিতে সমস্যা নেই,পরে পরে শালিখকে বুড়ো ধাড়ি মেয়ে কাঁদিস কেন বললে‌ সে লজ্জাও পায়। কিন্তু রোজ  দুজন বন্দুকধারী গার্ডের সঙ্গে মাকে জিপে চড়তে দেখলেই শালিখ আকাশ পাতাল হাঁ করে বুথ সাহেবের ছানা হয়ে যায়।
           ফার্স্ট গেটে গার্ডদের কাছে পরিচয় দিয়ে প্রথম যেদিন সে ঢুকল, কেমন এক অস্বস্তি খচখচ করছিল যেন ইচ্ছে হলেই বেরোতে পারবে না উঁচু পাঁচিলটার বাইরে। গার্ডরাই পৌঁছে দিয়ে গেল সেকেন্ড গেটে।
          নমস্কার ম্যাডাম,আমার নাম তিনু। সেকেন্ড গেট  পেরিয়ে অফিসের সামনে পৌঁছলে সাতাশ-আঠাশ বছরের নীল টিশার্ট আর জিনসপরা যুবক এগিয়ে আসে। আমি লাইফটার্ম কনভিক্ট। এখানে মেডিক্যাল ওয়ার্ডে কাজ করি। আসুন, এই ঘরে সুপারিনটেনডেন্ট স্যার আছেন।
        জয়েনিং ইত্যাদি ফর্মালিটি মিটলে আগে পিছে গার্ড নিয়ে থার্ড গেট পেরিয়ে ডেপুটেশান পিরিয়ড পার করতে পারবে কিনা এই আশঙ্কা মন থেকে তাড়াতে তাড়াতে ফুলে ফুলে সাজানো আরো বড়ো একটা কম্পাউন্ডের পথে সে হাঁটছিল ।
      পাম,ঝাউ আর পাতাবাহারে সাজানো ভারি সুন্দর রাস্তা।রঙনে গোলাপে আলো হয়ে আছে বাগান। বকুল ঝরে আছে কোথাও। মৌমাছিরাও এসে গেছে। পাখি প্রজাপতিদের তো আটকানো যায় না। মৌমাছিরাও অনায়াসে  ডিঙিয়ে যায় জেলখানার আকাশ।
         ফোর্থ গেটের ওপারে মেডিক্যাল ওয়ার্ড এবং আউটডোর।ট্রাইবাল বেল্টের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আর বালুরঘাট হসপিটালে  কাজ করা তার কান এত গুডমর্নিং, নমস্কার,স্যালুটে অভ্যস্ত ছিল না।তার ওপর আউটডোরে যখন প্রতিটি পেশেন্টকেই তফাৎ যাও মার্কা হাতের ধাক্কায় সরিয়ে দিতে লাগলো গার্ড, সে অবাক।হাত সরান,কাছে না এলে রোগী দেখবো কী করে? গার্ড সরলে জড়োসড়ো এক একজন সামনে এসে দাঁড়ায়,অবিকল তার হসপিটালের পেশেন্টদের মতোই মুখ!
       কিছুক্ষণ পরেই ঘন্টা বেজে উঠলো এবং মাইকে অস্পষ্ট কী একটা ঘোষণা শোনা গেল।তিনু এগিয়ে এল।গুনতির ঘন্টা বেজে গেছে ম্যাডাম, ওদের একটু ছেড়ে দিতে হবে।জালে ঘেরা দোতলার বারান্দা থেকে সে দেখল লাইন দিয়ে নিচের বাগানে উবু হয়ে বসলো সবাই। দিনের মধ্যে চারবার করে গুনে দেখা হয় কয়েদিদের সংখ্যা। গুনতি শেষ হলে যে যেখানের কাজে গেল। আউটডোরেও ফিরে এল রোগীরা।
       পেশেন্ট দেখা শেষ হলে ইনডোরের অবজারভেশন ওয়ার্ডে নিয়ে গেল আকাশ।
         উনিশ বছরের ফুটফুটে ছেলেটির মুখ নিস্পাপ উত্তীয়ের মত। বাংলাদেশ থেকে বিনা পাসপোর্টে এদেশে আসায় চারবছর সাজার দুবছর কেটে গেছে তার।বাবা-মা নাই ম্যাডাম।ক্লাস টেনে পড়তাম এক কুটুম বাড়ি লজিং থেকে। ওরা বগুড়া চলে গেল তো ভাবলাম ইন্ডিয়া যাই। লজিং থাকা মানে থাকাখাওয়ার পয়সা লাগে না বিনিময়ে সে বাড়ির ছেলেপুলেদের পড়াতে হয়।আকাশও মেডিক্যাল ওয়ার্ডে কাজ করে।
          ইনডোরে দশটি বেডে আপাতত ন'জন আছে। এছাড়াও ফিমেল ওয়ার্ড রয়েছে।দিনের ডিউটি ছাড়াও চব্বিশ ঘণ্টাই অন -কল থাকতে হবে। নিজের বাড়িতে থাকতে পারবে কিন্তু স্টেশন লিভ করা যাবে না। একেবারে অন্তরীণ অবস্থা যাকে বলে। ছুটি নিতে হলে প্রথমে জেল সুপার,তারপর জেলার চিফ মেডিক্যাল অফিসারকে জানানো, তারপর পুলিশ হসপিটালের ডাক্তারকে চার্জ হ্যান্ডওভার এই সবকটা ইকোয়েশান মিললে তবেই ছুটি।
      এত বাধ্যবাধকতার মধ্যে কাজ করতে পারবে কিনা এই ভাবনা মাথায় টিকটিক করে। শালিখটা বড্ডই ছোট। পলাশের দিল্লির ঠিকানাও পাকাপাকি তিন বছর।সব মিলিয়ে যাকে বলে ঘোরালো পরিস্থিতি। ভারি তো ছ'মাস। নিজেকেই সে সান্ত্বনা দেয়।
             ফার্মাসিস্ট সুতনুবাবুও খুবই ডেডিকেটেড। দুজন মেল নার্সের সঙ্গে তিনু, আকাশের মত লেখাপড়া জানা কজন কয়েদিকে শিখিয়ে পড়িয়ে ওয়ার্ড সামলে দেন তবে কিনা ওনারও ট্রান্সফার অর্ডার হয়ে গেছে। কেলেঙ্কারি আর কি!
        ইনডোরের বেডে শুয়ে বিরাশি বছরের নিতাই বর্মণ রামায়ন পড়ছেন। আকাশের মতই পার্সপোর্টবিহীন বাংলাদেশী নাগরিক। কোন কান্ড পড়ছেন? বুকে স্টেথো বসাতে বসাতে জিজ্ঞেস করে সে। 
          অরন্য কান্ড।  ইসিজি এক্সরে বলছে হার্টের সমস্যা আছে। বেড টিকেটে কার্ডিওমেগালি নিয়ে জেলা হাসপাতালে বার দুই ভর্তির হিস্ট্রিও আছে।রাতে ঘুম হচ্ছে না? ডায়াস্টোলিক প্রেসারটা বেশ বেশি।বিটা ব্লকার, স্ট্যটিন সব চলুক।লো ডোজ ক্লোনাজিপাম আ্যড করে সে।
 আমারও ডাক্তারবাবু ঘুম মোটোও আসিচ্ছে না। পাশের বেডে থেকে আব্বাস বলে ওঠে। তার ডানহাত উড়ে গেছে বোমায়।জেলে কেটেও গেছে সাত বছর। হাইপারটেনশনের পেশেন্ট বলেই এই ওয়ার্ডে ভর্তি।
           নৃপেন হাঁসদার পায়ের বুলেটের ক্ষত আটমাসেও শুকোয়নি।উন্ড কালচারের রিপোর্ট দেখে ওষুধ লেখে সে।সুতনুবাবু ড্রেসিং করেন ধরনীদাকে নিয়ে।
         কাজ সেরে বেরোলে আকাশ এগিয়ে আসে ছাতা খুলে, পাশে  সেই গার্ডদুজন। এরকম রক্ষীবাহিনী সমেত ছত্রপতি  হওয়ার অস্বস্তি এড়াতে খুব দ্রুত প্রায় দৌড়ে সে রাস্তা  শেষ করতে থাকে।থার্ড গেট পেরিয়ে গার্ডদের স্যালুট আর হ্যাভ এ গুড ডে ম্যাম শুনে টুনে গাড়িতে উঠে দেখে গেটের ফাঁকে তাকিয়ে আছে অপলক উনিশ বছর।আসি আকাশ?  সে হাত নাড়লে আকাশের হাতদুটি জোড় হয়ে নমস্কার করে। বাড়ি ফেরার পথে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে যেন।প্রত্যেকদিনই জেল কম্পাউন্ডের গেট থেকে বেরিয়ে ফেরার পথ ধরলেই মনে হয় এখনকার মত বাঁচা গেল। নিজের ইচ্ছে মতো চলাফেরার স্বাধীনতা যে এত বড় আগে কোনদিন খেয়াল করেনি সে।
            পরদিন প্রথমেই গেল ফিমেল ওয়ার্ডে। জেলখানার ভেতরে একদম আলাদা আর‌ একটা জেল আর কি। বাইরের তালা খুলে মেল গার্ড হাঁক দিলে ফিমেল গার্ড ভেতরের তালা খুলে নমস্কার ম্যাডাম বলে  সরে দাঁড়ায়। ফিমেল ওয়ার্ডের চারদিক ঘিরেই ঘর, আলাদা সেল, মাঝখানে বাগান। মেয়েরা যে যার জন্য ঠিক করে দেওয়া কাজে ব্যস্ত।কেউ ঝুড়ি বুনছে,চাল ঝাড়ছে,পাপোষ তৈরি করছে।
        রমা নামের যে গর্ভবতী মেয়েটিকে চেকআপ করে ওষুধ লিখছিল,বন্ধুর সঙ্গে প্ল্যান করে সে ঠান্ডা মাথায় স্বামীকে খুন করেছে।শান্তভাবে চুপ করে তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে।অন্য কয়েদী সালেহার আটমাসের মেয়ে রিমি হামা টানতে টানতে করিডোরে এসে দেওয়াল ধরে দাঁড়ালো আর তৎক্ষণাৎ থপ করে পড়েই কান্না জুড়লো। সালেহা তরকারি কাটছিল দূরে কিচেনের বারান্দায় তার হাতজোড়া। দূর থেকেই বললো হইছে কী?রমা দৌড়ে তাকে বুকে নিয়ে কাঁদে না মা এইতো সোনা বলে দোলাতে লাগলো।স্নেহমাখা তার মুখ দেখে কে বলবে সে এমন কাজ করতে পারে!
               প্রথম বাচ্চাটা শ্বশুরবাড়িতেই রেখে এসেছে। হয়তো  না দেখতে পাওয়া সেই সন্তানের জন্য কিছুটা উতলা হয়ে আছে। কিংবা নিজের গর্ভে বেড়ে উঠছে যে ,সেই অনাগত শিশুই তার মাতৃত্বকে দ্রবীভূত করেছে এমন। কোনো কোনো প্রেম  মানুষকে এমন  আত্মসর্বস্ব উন্মাদ করে তোলে যে নিজের চাওয়া বাঁধা পেলেই সে ফণা তোলে।তীক্ষ্ম দাঁতে ঢেলে দেয় সবটুকু বিষের থলি।
       কিন্তু মাতৃত্ব হয়তো নিজেকেও পেরিয়ে যায়। সেখানে সে হয়তো মমতায় ভরপুর স্রেফ একজন মা!কত আলাদা কুঠুরি আছে মনের?
          এই যেমন  ফিমেল ওয়ার্ডের সব চাইতে পুরনো কয়েদি তহমিনাদির চোদ্দ বছর সাজা খাটা হয়ে গেছে।সোমার মতোই একই অপরাধ তার।লেখাপড়ায় গ্ৰাজুয়েশন করা, লম্বা চওড়া দশাসই চেহারা তাকে বেশ ব্যক্তিত্ব দিয়েছে। অন্য মেয়েরা তাকে মেনেও চলে। মেয়েদের সবার ওষুধপত্র তার কাছে থাকে। তহমিনাদিই নিয়ম করে খাওয়ায়।
                ফিমেল পেশেন্ট দেখার ঘরে কালী ঠাকুরের
ছবির নিচে অজস্র টাটকা জবাফুল সাজানো থাকে রোজ।কে সাজায় ফুল? আল্লাহ্তো গাছেই সাজায় ম্যাডাম, আমি শুধু মায়ের পায়ে এনে দিই।রোজদিন এও একটা কাজ ধরে ন্যান। ফজরের নামাজ পড়েই বাগানে দৌড় দিই।
             ফর্সা কমনীয় মুখের দিক তাকায় সে।এতদিন পর তহমিনদির মনে পড়ে প্রেমিকের মুখ? নিহত স্বামীর মুখ?চোদ্দবছর পরেও কি দাগ লেগে আছে হাতে? লাল জবায় যা ঢেকে দিতে চায় মন।কোন প্রেমে ধর্মের সীমারেখা পেরিয়ে ঠাকুরের ছবিতে ফুল সাজায় তহমিনাদি সে বুঝতে পারে না।  
      ডিম এসে গেছে ডিম। ঝুমা,নুর,বেবী,কুরবানরা হইহই করে উঠলো।অঙ্গনওয়াড়ি দিদি খাবার এনেছেন আন্ডার ফাইভদের জন্য। বাচ্চারা হাসছিল,চেঁচাচ্ছিল ঠেলছিল খাবার ডেকচি ঘিরে।আ্যই সরসর,খিচুড়িতে পড়লে পুড়ে সেদ্ধ হয়ে যাবি যে ।লাইনে দাঁড়া, দাঁত মেজেছিস?নখ কেটেছিস?ছড়া মুকস্থ হয়েছে?সেসব শোনা দিকি আগে।আর হ্যাঁ-আ্য-আ্য -আ্য বলে সুর ওঠে যে কোনো অঙ্গন ওয়াড়ি সেন্টারের সামনেই যেমনটা হয় , অন্নের ঘ্রাণে,উত্তাপে, বাচ্চাদের আহ্লাদে এক্কেবারে নতুন কোনো ঘটনার  মতোই ভরপুর হয়ে ওঠে জেলখানার  ফিমেল ওয়ার্ডের সকাল।
         সেবার শীতে মরশুমি ফুলের বেডগুলো উপচে পড়ছিল। ঠাণ্ডাতেও বকুল গাছটার ফুল ফোটানোর বিরাম নেই। বকুল বিছোনো রাস্তাটাতে একা হাঁটতে ইচ্ছে করে তার কিন্তু নিয়ম নেই।গার্ড আর ছাতা ছুটে আসবেই। এখানে ফুল কে সাজালো?সুতনুবাবূর কথায় তাকিয়ে দেখে আউটডোরের গেটে ফুলের তোড়া আটকানো।ঘাস ছাঁটা থামিয়ে স্বপন বললো আমরা।সুতনুবাবু দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। সে রোগী দেখতে আউটডোরে  বসে গেল।
         পরদিন ডিউটির পর দেখে ছুটতে ছুটতে আসছে স্বপন হাতে কালকের চাইতেও দ্বিগুণ বড় তোড়া।কী হয়েছে? না মানে আপনার নাকি কাল ভালো লেগেছিল ফুল। তাই ওরা বানালো। আমাকে বললো ওরা..তাই মানে.. আপনি নেবেন ম্যাডাম? নিশ্চয়ই। ওদের বোলো খুব ভালো লেগেছে আমার ফুল তবে রোজ যেন না ছেঁড়ে। পলিথিনের চটে কম্বল পেতে ওরা শোয়, সেই পলিথিনের সুতো খুলে তোড়া বানিয়েছে বলল স্বপন। কত ফুল বলেন।এই ফুল সব আমরা ফোটাই ম্যাডাম। ফুল নিতে হাত বাড়ালে খুশিতে ঝলমলে স্বপনের মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে বন্ধুকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করেছিল এই ছেলে ? খুনের সময় কেমন ছিল ওর চোখ ?
       ফিরতে ফিরতে চারটে বেজে যায় বলে মিনা রোজ জল,বিস্কিট আর আপেল দিয়ে দেয়। বেশিরভাগ দিনই অবশ্য বাড়িতে সে সব ফেরত আসে আর হ্যাঁ দিদি, আবার তুই খাসনি বলে মিনার বকুনি খায়। বিধবা ওঁরাও মেয়েটি কি মমতায় যে আগলে রাখে তার সংসার।
       লাঞ্চ আওয়ারের আগে অবিশ্যি জেলের খাবার টেস্ট করে দেখতেই হয়!খাবারের মান খুব যাতে নেমে না যায় তাই রোজ তাকে আর জেল সুপারকে তা চেখে দেখতে হয়!এমনটাই দস্তুর। একটা প্লেটে বাটি বাটি করে ডাল-তরকারি আর মাঝে চুড়োমতো করে ভাত সাজিয়ে এনে নমস্কার বলে দাঁড়ান রাঁধুনী হরেন মাহাতো। হ্যাঁ,দেখান বললেই প্লেটের ঢাকা সরিয়ে নেন।চামচে করে আলগোছে মুখে ফেলে ঠিক আছে বললেই,ঢাকা এঁটে রওনা দেন সুপারসাহেবের ঘরের দিকে। 
       লাঞ্চের ঘন্টা বেজে ওঠে।হরেনবাবুও লাইফটার্ম কনভিক্ট। রান্নার কাজই করতেন আগে। যে যে কাজ পারে, সেই ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়।সেই অনুযায়ী এরা রান্না করে,কুটনো কোটে, জল তোলে, বাগান কোপায়।ধান বোনে,সব্জি ফলায়, ঝুড়ি বোনে।
        আসলে এরাতো এই পৃথিবীরই।জানা ছিল না বলেই ভিন গ্রহের মনে হত। আজন্ম অপরাধী খুব তো কেউ হয় না। অপরাধ প্রবণতা,কিলার ইনস্টিংক্ট মানুষের মধ্যে অল্পবিস্তর থাকেই। পরিবর্তিত পরিবেশে তা মাথা চাড়া দেয়। নির্বিবাদী সাধারণ মানুষের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে সম্পূর্ণ আলাদা এক মানুষ। প্রতিকূল পরিস্থিতিও অনেকসময় এমন এক জায়গায় পৌঁছে দেয়, মরিয়া হয়ে কেউ  ঘটিয়ে ফেলে চূড়ান্ত অপরাধ।
      ইদানিং সে ভাবে জেলের বাইরেও কতজন কত বেশি বিকৃতি গোপন করে,কত আপরাধের প্রমান লোপাট করে দিব্যি ঘুরছে  চারপাশে,তাদের অন্য মুখ চেনা যায়  না। ক্ষমতালোভীদের যখন মালা পরায় জনতা, দেখতে পায়না তাদের হাতেও কত  অপরাধের দাগ,কত বেশী রক্ত লেগে আছে। আগে অবশ্য এভাবে ভাবে চিন্তা করেনি কখনও ।
             কল বুক খেয়ে রাতে-দিনে প্রায়ই ছুটতে হয়। মুশকিল হয় রাতে। মাঝরাতে ফোন বাজলেই কী এক আতঙ্কে  যাবে না তুমি যাবে না মাম্মা বলেই শালিখ কান্না শুরু করে। তার জড়ানো হাত ছাড়িয়ে মিনাদিদির কাছে থাকো এক্ষুণি ফিরবো বলে  বেরোয় সে।
        তাদের পাড়ার ঝুলন মাসি আগে ফিজিক্স পড়াতেন। রিটায়ার করে জীবে প্রেম এমন বেড়েছে,গলির মোড়ে মাসি বারোটা কুকুরকে দুবেলা পাত পেড়ে খাওয়ান।আর্লি ডিনার সেরে তারা  শুয়ে থাকে গলিতেই।কাজে কাজেই রাতে কেউ এলে ব্যাপক ধামাকা শুরু হয়। তবে কুকুররা মনে হয় বন্দুক চেনে।গার্ডদের কেন জানিনা বিশেষ পুঁছতাছ না করেই ছেড়ে দেয়।
               মাঝ রাত্তিরে ঘুমন্ত শহর পেরিয়ে,ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের আরন্যক পেরিয়ে জেলখানার জিপ তাকে পেটে পুরে নিঝুম দৈত্যপুরীতে ঢুকে যায়।
     রাত তিনটেয় একদিন দেখে ভুলু পাল নামে বয়স্ক একজন অজ্ঞান হয়ে গেছেন।বি পি খুব বেশি।শ্বাসকষ্টও আছে।সেন্স ফিরেছে তবে ওরিয়েন্টেশন নেই।
        তিনু অক্সিজেন খোলো শিগগিরই। ডানদিকে ঠোঁট বেঁকে ফেসিয়াল পালসি  হচ্ছে। ডান হাতও নাড়তে পারছে না সেভাবে।কনভালসন হচ্ছে।মেল নার্স ধরণীদাকে ডেকে বলে চ্যানেল করুন, ম্যানিটল দিতে হবে। সুতনুবাবু এপটয়েন লোডিং ডোজ রেডি করুন।আগে একটা আ্যম্পুল সর্টে দিন। চেষ্ট তো ক্রেপস ভর্তি।ল্যাসিক্সও দিতে হবে।
          আকাশ আ্যম্বুলেন্সে ফোন করো,আমি পেপার রেডি করছি। সি ভি এ হয়েছে ওনার। নানা জীবনদায়ী ওষুধ দিয়ে বিপিটা  একটু হাতের মধ্যে এনে নোট লিখে জেলা হসপিটালে পাঠিয়ে ফিরছে যখন ভোরের আলো ফুটছে।     
       ব্যাক সিটে হেলান দিয়ে ভাবে আঠেরো বছর আগে এই লোকটা খুন করেছিল?কারো বেঁচে থাকা অথবা মরে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করেছিল সে আর আজ মৃত্যুর কাছে নিজে শুয়ে আছে অসহায়।
               দীর্ঘদিন বন্ধ কপাটের আড়াল সহ্য হয়না অনেকের।ডিপ্রেশন সাইকোসিসের অন্ধকারে তলিয়ে যায় ।আ্যন্টিসাইকোটিক মেডিসিনের ঘোরে চেতনাটি মুড়েসুড়ে দিনরাতের কোনো রঙ না বুঝেই  আলাদা সেলে বেঁচে থাকে বছরের পর বছর।সেই ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে গিয়ে  সে জিজ্ঞেস করে কেমন আছো আলি? 
       সবাই ডাইনিং হলেই খায় শুধু এই ওয়ার্ডেই খাবার আসে।আলির খিদে বেশি পায় বলে সকালের চিড়ে গুড়ের পরিবর্তে অনেকখানি ভাত আর অল্প গুড় দেওয়া হয়েছে। শুধু ভাত!শুধু ভাত!শুধু ভাত!আলি তার দিকে তাকিয়ে থালা ঠুকে ঠুকে নালিশ জানায়। তিনু ছুটতে ছুটতে আসে,ম্যাডাম শিগগিরই আসুন, একটা বাচ্চার মাথা ফেটে গেছে ফিমেল ওয়ার্ডে।দ্রুত সেদিকে যেতে যেতেও দূর থেকে শুনতে পায় থালা ঠুকে আলির নালিশ তখনও শেষ হয়নি।
         আট বছরের কুরবান আম্মা‌ আব্বার সঙ্গে এদেশে এসেছিল পাসপোর্ট ছাড়াই।আব্বা আছেন বহরমপুর জেলে। গতকাল সকালেই সুপার রাউন্ডে এসে বলে গেছেন কুরবানের আটবছর  পূর্ণ হয়ে গেছে।তাই এবার তাকে হোমেই যেতে হবে। শোনার পর থেকে সে দীর্ঘমেয়াদী কান্নাকাটি শুরু করেছে,খায়ওনি কাল থেকে।আজ মাথা ঘুরে পড়ে গেছে তাই। 
        খুব কিছু  হয়নি। একটা লিনিয়ার কাট ইনজুরি আর ছোট্ট হেমাটোমা। কিন্তু ভেতরে?চারজন মিলে নিজের দেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ অজানা একটা দেশে এসেই জেলে বন্দী। আব্বাকে দেখেনি দুবছর।আম্মা আর ভাইকেও যদি ছাড়তে হয় তাহলে কতটা রক্তপাত হয় ভেতরে?
         তোমাকে এখানেই রাখা হবে। আমি কথা দিচ্ছি। কিন্তু একটা শর্ত আছে।কন।যে দিদিমনি রোজ তোমাদের পড়া শেখাতে আসেন, খুব ভালো করে পড়তে হবে তার কাছে,রাজি?হ,রাজি। তবে আর কেঁদো না। ঠিক করে খেয়ে নাও।তিনু আমি লিখে দিচ্ছি, তুমি ফার্মেসিবাবুর কাজ থেকে ওষুধ নিয়ে এস।আর টক্সয়েডটা দিতে বলো ধরণীদাকে। সুপারের ঘরে গিয়ে সে অনুরোধ করে কুরবানের জন্য।মিঃ সুব্বা রাজি হন ওকে দুবছর রাখতে। ততদিনে ওদের সাজা শেষ হয়ে যাবে ভেবে ভালো লাগে তার।
         খুব হৈ চৈ একদিন।গাড়ি থেকে নামতেই চার-পাঁচজন গার্ড তাকে ঘিরে ভেতরে নিয়ে গেল। জানা গেল রাতে একজন গার্ড মত্ত অবস্থায় এক কনভিক্টকে বাপ মা তুলে গাল দিয়েছে।প্রতিবাদে সমস্ত বন্দীরাই হাঙ্গার স্ট্রাইক করেছে।কেউ নাস্তা ছোঁবে না।
মিটমাট করতে সবাইকেই ডেকে পাঠানো হয় সকালে। সেই কনভিক্ট আবার জেলার বাবুর ডাকা শান্তি মিটিংএই গার্ডকে চড় মেরে বসেছে। ফলে তাদের আলাদা সেলে ঢুকিয়ে শান্তি মিটিং আপাতত মুলতুবি রাখা হয়েছে। বন্দীরা স্ট্রাইক কন্টিনিউ করছে। 
           জেলার বাবু কাঁচুমাচু,দেখুন দেখি কী বিপত্তি!  সুপার সাহেবও ছুটিতে। গার্ডরাও তো ছেড়ে কথা বলেনি।সেলে ঢোকাবার আগে দিয়েছে আচ্ছা মতন। এখন স্ট্রাইক না ভাঙলে তো মুশকিল।সেলের ওই ভুট্টো আর উকিল যদি না খায় তো বাকিরাও...। এর মধ্যে সাংবাদিকরা খবর পেলে তো সোনায় একেবারে  সোহাগা।
        আপনি গার্ডদের সাথে কথা বলুন আমি দেখছি কতটা জখম হলো এরা দুজন।
       সাবধান ম্যাডাম! খুব বড় ডাকাতির আসামি এরা।হেন খারাপ কাজ নেই যা এরা করেনি,নির্জন সেলে ঢোকার আগে তিনু নিচু গলায়  বলল।ফর্সা ছিপছিপে চশমা পরা তিনুর দিকে তাকালো সে।মেডিক্যাল ওয়ার্ডে সবচেয়ে চটপটে,খাতাপত্রের কাজ থেকে ইনট্রামাসকুলার ইঞ্জেকশন পর্যন্ত দিয়ে দেয় ধরনীদার সাথে।কে বলবে এই ঝকঝকে নিতান্ত বাধ্য ছেলেটা আসলে ড্রাগ পেডলার। এখনো জেলের ভেতরেও নাকি  নেশার জোগান দেয়। শিগগিরই ওকে প্রেসিডেন্সি জেলে মুভ করা হবে শুনেছে।হয়ত সেখানে আরও বড় চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। বুদ্ধিদীপ্ত চৌখস তিনুকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই।
           সকালের নাস্তা পড়েই আছে।লাঠির দাগ ফুটে উঠেছে হাত পায়, কেটেকুটেও গেছে।গুম হয়ে বসে আছে ভুট্টো দেবনাথ। তিনু ধরণীদাকে বলো ড্রেসিংসেট আর টক্সয়েড নিয়ে আসতে।
         খাননি কেন? আপনি জানেন না ম্যাডাম, সেলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডদের দেখিয়ে সে চেঁচিয়ে ওঠে, ওরা শুধু একটা উর্দি পরে আছে,নাইলে আমাদের চাইতে অনেক বেশি ক্রিমিনাল ওরা।
           অনেকক্ষন ধরে চুপ করে শুনল তার ক্ষোভের কারণ। থামলে পর বলল,আমি তো শুনলাম আপনার কথা। সুপার সাহেব ফিরলে আমি কথা বলব। এবার আপনি আমার কথা শুনুন। খাবারটা খেয়ে নিন। না খেলে ওষুধ কী করে দেব বলুন?আর অন্যের ওপরে রাগ করে নিজেকে কষ্ট দেবেনই বা কেন?
       হাতটা দেখি,ধরণীদাকে থামিয়ে নিজেই টক্সয়েডটা পুশ করে হাতটা একটু ধরে থাকে সে।কী খাবেন তো? ভুট্টো আস্তে মাথা নাড়ে।
         ছ'মাস এভাবেই কেটে গেছে কী করে যে ।হ্যালো স্রোতস্বিনী ,তোমাকে আবার ডিস্ট্রিক্ট হসপিটালে নিয়ে নিচ্ছি,ডাঃ পালকে পাঠাচ্ছি ওখানে। আপাতত তুমি অফিসে এসে তোমার অর্ডার কালেক্ট করবে আর নেক্সট উইকে চার্জ হ্যান্ডওভার দেবে পালকে।থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। অন্যমনস্ক ফোন অফ করতেই কোনো খারাপ খবর ম্যাডাম? না ভালো খবর। তোমাদের নতুন ডাক্তারবাবু আসবেন।
ঘাড় বাঁকিয়ে সুমিত বলে, এটাতো খারাপ খবরই।
      স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা  জেলা হাসপাতালের  অন্য পেশেন্টদের মতোই কখন সে মিশে গেছে ওদের সুখদুঃখের সঙ্গে।রাখীর দিন কত লাল সুতো বেঁধেছে ওরা। খুলবেন না ম্যাডাম। না খুলবো না তো, সারাদিন আজ পরে থাকবো। সামান্য ক্যান্ডির বিনিময়ে খুশি ঝলমল করে মুখে।
         চলে আসার আগের দিন রাউন্ড দিচ্ছিল সে।নিতাইবাবু, কোন কান্ড পড়ছেন? উত্তরা কান্ড মা?উনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা বইই পড়েন।
        কাল থেকে আমি আর আসবো না। নতুন ডাক্তারবাবু আপনাদের দেখবেন। দিনের মধ্যে একবারো আসবে না মাগো? কাঁদতে বসেন বুড়ো নিতাইবাবু।ভালা মানষিরা ক্যাব্বলি চলি যায় বলতে বলতে কেঁদে ফ্যালে খুনের আসামী সেই ভুলু পাল। মেজর একটা সেরিব্রাল আ্যটাকের পর মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছে সে। কাঁদবেন না। দুজনেরই প্রেশার বেড়ে যাবে কিন্তু।ডান হাত উড়ে যাওয়া আব্বাস বাঁ হাতটা কপালে ঠেকায়।আদাব মেডাম।আদাব আব্বাস।
       নতুন ডাক্তার বাবু নিশ্চয়ই আপনাদের যত্ন করে দেখবেন।আর ধরনীদা এগুলো সবাইকে ভাগ করে দেবেন, কিছু বিস্কিট আর ফলের বড় একটা ঝোলা টেবিলে রাখতে রাখতে বলে সে।
          আমার পা,ডাক্তারবাবু, আমার পা টা।ক্রাচ নিয়ে পিছু পিছু আসে নৃপেন হাঁসদা।গুলির ক্ষত থেকে পায়ের হাড়ে ছড়িয়ে গেছে ইনফেকশন।অস্টিওমাইলাইটিস বীভৎস রূপ নিয়েছে। জেলা হসপিটাল ফেরত দিয়ে দিয়েছে।সব রিপোর্টসমেত নিয়মমাফিক  চিঠি করেছে সে বার তিনেক। এতদিন তার উত্তর মিলেছে। তাকে বলে শিগগিরই পি জি হসপিটালে নিয়ে যাবে আপনাকে।     
      অনুপ,পুলক,তিনু,বাবুদা এগুলো তোমাদের।চাবির রিং,পেন আর চকোলেট বারের ছোট ছোট গিফট প্যাক। ওরা এতদিন মেডিক্যাল ওয়ার্ডে তার সঙ্গে কাজ করেছে।সুমিত, মিষ্টিগুলো তোমরা ভাগ করে খেয়ো।
       বলো আকাশ কী খাবে তুমি? কিচ্ছু না,কেন যাবেন আপনি?চোখভর্তি জল দৌড়ে বেরিয়ে যায় আকাশ।
      ওর গিফট প্যাকেটটা কী করবে ভাবতে ভাবতে আস্তে আস্তে হাঁটে সেই বাগান ঘেরা রাস্তায়।থার্ড গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার কাছে গিয়ে বলে, তোমাদের কথা আমার মনে থাকবে আকাশ। মাটির দিকে তাকিয়ে সে বলে, আপনার কথা আমার সব সময় মনে থাকে। তার হাতে গিফট প্যাকটা গুঁজে দেয় সে।আসি আকাশ?
     সে হাত নাড়লে আকাশ হাতজোড় করে। গাড়িতে উঠে দেখে অপলক তাকিয়ে আছে উনিশ বছর।এই প্রথম জেল থেকে ফিরে আসতে তার কষ্ট হলো। 
        হঠাৎ করে  দিদুনকে মনে পড়লো তার। ছোটবেলায় দেখেছে চোখে চশমা এঁটে  দিদুন কাঁথা সিলাইতে বসতো।লাল নীল সবুজ সুতোর পাড় বসাতো।জমিনে তুলতো আশ্চর্য নকশা। এখন  মনে হলো নিরক্ষর তার দিদুন আসলে  টুকরো একটা কাপড়ে মন দিয়ে নিজের জীবন সেলাই করত । কেউ তারা খেয়াল করেনি নীল সুতোয় কোন বেদনা লিখছে দিদুন।লাল সুতোয় গেঁথে রাখছে চকচকে কোন প্রতিবাদ। ভালবাসা আঁকছে সবুজ ফোঁড় তুলে তুলে, ধারে গোলাপি অভিমান।আর মাঝমধ্যিখানে রোদ্দুরে ভেজা হালকা সুখ শান্তির সব ছায়ামাখা দিন দিদুন রেখে দিচ্ছে যত্নে।
         গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে ভাবে ঠিক যেভাবে লিলি ফুলদের ছিঁড়ে এনে  সুতো ছাড়াই সে গেঁথে রাখতো  মালা। একটু পরেই অবশ্য খুলে খুলে যেত।বিনি সুতোর রঙিন ঘাসফুল ছড়িয়ে রেখে ছুটত অন্য কোনও খেলায়। কিন্তু কোথাও তো রয়ে গেছে ফুলেরা। তাহলে কিছুই  ঠিক হারিয়ে যায় না বিড়বিড় করল সে।হাসল আপনমনে। ভালবাসার সঙ্গেই দুঃখ অপমানের ঝড়ঝাপটা আর  দুঃস্বপ্নর বিকট মুখওতো পেরিয়ে যেতে হয় কাঁপতে কাঁপতে।এক জন্মেই পেরোতে হয় কত জন্ম-জীবন। লম্বা শ্বাস নিতে নিতে ভাবল সে,সমস্ত ঘটনার সংঘাত সুখদুঃখের বাগান থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে সুতো ছাড়া রেইন লিলিদের মতো গেঁথে তোলাই আসলে বেঁচে থাকা  সময় যা বিনিসুতোয় গেঁথে রাখে ।খানিক আলগা হয়ে ঝরে যায় আবার কোনও কোনও দাগ ঝুরো রঙের আবছা হয়ে থেকেও যায়।সবটাই দিদুনের বোনা ওই কাঁথার মত।পাড়ের রঙিন সুতোয় যার লেগে থাকে  কারুবাসনাটুকু।
🍂
ad

         আত্রেয়ীর কাছে এসে সে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ল। অনেক দিন পর নদীর ধারে এসে মনে হলো ইচ্ছামতীর জীবলি গাছ আর সাঁই বাবলার ধারে হু হু করা জোছনা থেকে গঙ্গার আলো অন্ধকার পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে কি আচমকাই বেলা এগারোটার
এই  ক্ষীণ তোয়া পৌরাণিক নদীটির ধারে এসে পড়েছে ? এই অসংখ্য আয়না ভরা দিনের সাথে সাথে প্রতিবিম্বের মনও তো পাল্টে গেছে তাহলে।ভাঙা আয়নার সামনে উপুড় হলে অসংখ্য প্রতিচ্ছবি যেমন,আয়নার ভেতর ভেতর রাস্তার যতটুকু দেখা যায় ততটুকুই চেনা। বাকিটুকু সম্পূর্ণ আলাদা। কতবার যে দেখেছে আয়নার ওধারে একেবারে আলাদা এক পথ উঁচু হয়ে ওঠে।
         তাদের বসিরহাটে ধানকুঁড়ের গায়েন রাজবাড়ি গিয়েছিল একবার। বৃটিশ দুর্গের আদলে গড়া প্রাসাদের বাগানে বসেছিল।রোদ আর ধুলো মাখা ডানা ভাঙা পরীর শুকনো ফোয়ারা চুপ করে ছিল যেমন সব প্রাচীন প্রাসাদের আগাছাময় বাগানে থাকে।অথচ সে টের পাচ্ছিল পাথরের পরীর ডানার তলায়  জল বয়ে যাওয়ার শব্দ।গলে যাওয়া ঘড়ির ভিতরে প্রতি সন্ধেয় যেভাবে দৌড়ে মিশে যায় মানুষ।পাশের বাড়ি আলো জ্বলে ওঠে আর মেয়েরা হেসে ওঠে একসাথে।ঘুমোনোর আগে হাসতে হাসতে কপালের টিপ সেঁটে রাখে আয়নায় যদিও তারা জানে, ঘুমোলে আয়নার টিপ থেকে গড়িয়ে পড়বে জল। তাইই স্বাভাবিক।বিম্ব থেকে প্রত্যেকবার মুছে দিতে হয় জল।
            ব্যাগের ভেতর জয়েনিং লেটারটা খামচে ধরে সে।জেলা হাসপাতালের অফিসে আজই এটা জমা দিতে হবে। হসপিটালের খোলা গেট দিয়ে ঢুকে আউটডোর পেরিয়ে অফিসের দিকে হাঁটে।
       বুকের ভেতর  কী একটা খচখচ করে। পায়ের তলায় ভাঙা কাচের মতো বিঁধে যাওয়া মন নিয়ে ভাবে কোথায় যেন যাওয়ার ছিল, অনেক মানুষের জন্য কী তার বলার ছিল, অনেক সব কথা মনে পড়ি পড়ি করেও সে ভুলে যাচ্ছে; মায়ের ভুলে যাওয়া অসুখটাই কি ধরলো  তাকে?  সে তাই ফের ঝোলা থেকে বার করে আরশির ভাঙা টুকরো।ভাঙা আয়নায় মুখ দেখলে নাকি সাত বচ্ছর দুর্ভাগ্য থাকে। অথচ জলজমা ধান খেতে উপুড় হলে তো হাওয়া এসে শত খণ্ড হয়ে যায়  মুখ আর অতল হয়ে ওঠে আকাশ।
       সেই আকাশেই ডানার তলায় তলায় শালিখকে উড়তে শেখাতে হবে।তাছাড়া বাঁধানো ছবি হাতে করে  কবে থেকে বারান্দায় মা একলা বসে আছে। হারানো রাস্তায় চশমা পরে বাবা বলছে, ঝিনুক মা  কিছু একটা করো, আগুনপাখির মতন উড়ে উড়ে থাকা যায় নাকি? আর মা-বাবা ছাড়াও আরও কে যেন খুব হাত ধরে ছিল, বলেছিল সবাই মিলে কিছু একটা করতে হবে...  আগুন আর ছায়ার সে কথা  সে কি ভুলে গেছে জন্মের শোধ ?ভূতগ্ৰস্ত সময়ের মতন কে তাকে পাল্টে দিল ? মশাল নেই,গান নেই বেতমিজ আরশির ভেতর কেবল দপদপ করে সরু এক আধপোড়া মোম। মনে পড়ে না কেন কে ছিল সে ? সমস্ত বেনিয়মের প্রতিরোধে যে ডেকেছিল তাকে।এতকাল পরেও এই ঘর গেরস্থালির মায়ার ভেতরেও যে ডাক কেবলই ইকো হচ্ছে,ভাঙছে , ভেঙে যাচ্ছে তবু শেষ হচ্ছে না।
      যেন ওপার বাংলায়  ঠাকুদ্দার বুড়ো বাবার পোঁতা দেড়শো বছর আগেকার সেই জেদি তেঁতুল গাছ রাখাল জেঠার মত কাটা পড়ে মরেছে কবেই তবু ছায়া দিচ্ছে।
      পাথরে বাঁধানো মায়া দর্পণ ফিসফিস করে তাকে সেই ছায়া জন্মের কথা বলে। বলে যতই বেদম লাগুক,বাঁধানো শিমুল আর বকুলের ডালপালা গাঁথা এই হসপিটাল মোড় অবধিই খোলা থাকে আকাশ‌ যেখানে ফোলা পেট নিয়ে ফ‍্যাকাশে সব গর্ভবতী মেয়েরা যাচ্ছে প্রসূতিসদনের দিকে।থকথকে রক্তের পুরু  মোটা ফুল আর জল ভাঙার আঁশটে গন্ধে ভরা লেবার রুম উজ্জ্বল হয়ে আছে সদ‍্যজাত কান্না আর তরুণী মায়েদের ক্লান্ত হাসিতে।
      থুতু,পেচ্ছাপ,পানের পিক আর বীজানুনাশকের শাদা গন্ধে ধোওয়া কমপাউন্ড হেঁটে এসে চেনা  গেট পেরিয়ে দ্যাখো একই রকম সার সার সব ওষুধের দোকান,ঘিঞ্জি ক্লিনিক আর সেলুন কেমন একসাথে রুগ্ন আপেল ও কোলগেট (ছোট) সাজানো থাকথাক মুড়ির প‍্যাকেট নিয়ে বসে আছে বাঁচবার ইচ্ছে নিয়ে। আসছে শীতেও আগুন পোয়াবার সুখ সাধ কিংবা নিছক হেসে উঠবার ওম নিয়ে জলের বোতলের  পাশাপাশি শুয়ে বসে আছে।
    নখের ছিলকার মতো ছালবাকল নিয়ে পড়ে আছে ফুটপাথ,ঘন আকাশ আর কাঠের বাক্সে সাজানো সীসে ও তামার আংটি।মাজাব‍্যথার তেল,গর্ভপাতের শেকড় আর সাত ধান্দার সামনে উবু হয়ে বসে  দোকানী ও খরিদ্দার নাক টেনে গাঢ় সৈরভ নেয় ।
          অন্নপূর্ণা ভাতের হোটেলের ডাল সম্বরার গন্ধ।মলিন কিশোর এগিয়ে দেয় ভাতের থাল।ধোঁয়া ওড়ানো গরমভাতের থালা গোল হয়ে আসে আদ্দেক চাঁদের তলায়।রোগীদের আত্মীয় স্বজন কাঁচা মরিচ চেয়ে নিয়ে উষ্ণ জোছনা ভাতের গরাস তোলে আর জিভের ওপর নোনা স্বাদে ভরে উঠে আশ্চর্য জীবন হেঁকে বলে কপাট খোলো হে!
        জয়েনিং নিয়ে নিলেন অফিসের বড়বাবু।কাজ মিটিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এল সে।নি নি করছে দুপুর। খোলা রাস্তায় বাড়ির পথ ধরল সে।পথ চলতি মা  মানুষজনের সাথে চলতে চলতে আকাশের দিকে তাকালো সে। পাকা রাস্তার ধারেই সজনে গাছ থেকে ঝুরঝুর করে ফুল ঝরছে।
     এখানে আকাশ নীল...নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল...আনমনে বিড়বিড় করে সে।জন্মান্তর থাকলে  আবারও সে মেয়ে হয়ে জন্মাবে। নিশ্চল দুই পাড়ে বয়ে যেতে যেতে ধাক্কা লাগাবে ভাঙনের। হয়ত তারই বুকের চরে জেগে উঠবে  ঘুমিয়ে পড়া সভ্যতা। মুঠোভর গম হাতে  লুপ্ত বন্দর হেঁটে যাবে  নয়া পত্তনির দিকে।

সমাপ্ত 

(একবছরের বেশী সময় ধরে এই ধারাবাহিক লেখাটির পাঠক ছিল কম। তবু যারা ছিলেন প্রথম থেকেই সঙ্গে ছিলেন। মাঝে একমাস বন্ধ থাকলেও তারা আবার খুঁজে নিয়েছেন।তাদের নিখাদ আন্তরিকতা আমার সঙ্গে সঙ্গে এতদূর এল।আজ আমি আঙুল থেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছি এই লেখার হাত। এখন থেকে পাঠকের বুকের ভেতর একলাই হাঁটতে হবে ঝিনিকে।চলতে হবে নিজের মতো করে। যেমন করে  শেকড় চলে মাটির অলিগলি ধরে।
ভালবাসা ছাড়া এই লেখা কিচ্ছু শেখেনি। প্রিয় পাঠক, ভালবাসা নেবেন।)
      

Post a Comment

0 Comments