জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে(একাদশ পর্ব) /মলয় সরকার

প্লাজার সামনের দিকের শিল্পকর্ম

মার্কেজের খোঁজে
(একাদশ পর্ব)

মলয় সরকার


এই সান পেদ্রো ক্ল্যাভার চার্চের সামনের প্লাজাটির নাম সান পেদ্রো ক্ল্যাভার প্লাজা।
এই প্লাজাতে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে আর একটি সুন্দর জিনিস রয়েছে। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, ভাবছিলাম মানে, এদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে করতে ভাবছিলাম, দেশের দারিদ্র্য আমাদের অসৌন্দর্য বা দুর্গতির কারণ নয়। আসল কারণ, আমাদের দেশের নেতারা চাইছেন না, দেশের উন্নতি হোক, বরং দেশের দারিদ্র্য আর অশিক্ষাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন। তাই এই দুর্দশা। নাহলে এরাও আমাদের মতই গরীব দেশ, তবু এদের প্রতিটি পদে এত পরিচ্ছন্নতা, সৌন্দর্য্য বোধ, সংস্কৃতিকে এরা ধরে রাখে কি করে! এই কলম্বিয়া তো আজও ড্রাগ মাফিয়াদের আড্ডা, তবু সাধারণ মানুষের সৌন্দর্য্য বোধকে তা নষ্ট করে নি।

প্লাজাতে সুন্দর ভাবে সাজানো রয়েছে, বেশ কিছু শিল্পকর্ম। মানুষের বসার বা বিশ্রাম করার চেয়ার ছেড়ে বাকী জায়গাতে সাজানো রয়েছে লোহার টুকরো বা পাত দিয়ে তৈরী মানুষের চলমান দৈনন্দিন জীবনের নানা ছবি। কোথাও মানুষ সেলাই মেসিনে সেলাই করছে, কোথাও এই সব মেয়েরা ফল বেচছে, কোনটি মানুষের আড্ডা দেওয়া, দাবা খেলা, কলের গান শোনা ইত্যাদি নানা ধরণের মন ভাল করে দেওয়া মূর্তি। সুন্দর পরিচ্ছন্ন ছোট ছোট বেদীর উপর সাজানো রয়েছে। সেগুলোর জন্য আলাদা রক্ষণ ব্যবস্থা দেখি নি। তবে সব ক’টিই একেবারে সুন্দর ভাবে রয়েছে।বুঝলাম, নিশ্চয়ই যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা আছে।
প্লাজায় শিল্পকর্ম সমৃদ্ধ আর এক দিকে

এখানে শান্ত হাওয়ায় একটু বিশ্রাম নিয়ে ভাবলাম, আজই তো চলে যাব, যাই একবার দেখে আসি এখানকার সাহিত্যসম্রাটের শেষ আশ্রয়।
হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছালাম সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, যেখানে ভিতরে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রাখা রয়েছে তাঁর শেষ চিহ্ন।
তিনি মেক্সিকো শহরে ১৭ই এপ্রিল ২০১৪ তে প্রয়াত হওয়ার পর এই Cloister of La Merced এ ২৩এ মে ২০১৬ তে তাঁকে সমাহিত করা হয়।কারণ এই শহরে জড়িয়ে আছে তাঁর অনেক স্মৃতি, যদিও জন্মেছিলেন, এখান থেকে কিছুটা দূরে আরাকাটাকা শহরে। সেই জন্মের শহরে ত্যাগ করেছিলেন মাত্র ৯ বছর বয়সেই। সেখানের বিশেষ কোন ঘটনা তাঁর লেখায় পাওয়া যায় না, যদিও অনেকে বলেন , তাঁর One Hundred Years of Solitude এর কল্পিত শহর মাকোন্দো , এরই ছায়ায় তৈরী। আসলে তাঁর জন্মস্থান তাঁকে খুব ভাল বাসে নি, বরং তিনি কিছু বিরক্তই ছিলেন এর উপর হয়ত কোন ঘটনায়। আবার এর অধিবাসীদের ক্ষোভ, তিনি এখানের জন্য কিছুই করেন নি।

এনার মৃত্যুর পর ব্রিটিশ শিল্পী  Katie Murray তাঁর মূর্তিটি তৈরী করেন, যেটি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। মূর্তিটি উন্মোচন করেন তাঁর পুত্র Gonzalo Garcia Barcha।এই কার্তাহেনাতেই তিনি তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করা ছাড়াও, সাহিত্যের নানা উপাদান সংগ্রহ করেছেন এখানকার মাটি থেকেই।এখানেই তাঁর শিক্ষাজীবনের শেষ ও কর্মজীবনের শুরু। তাই তাঁর শেষ শয্যা হিসাবে পরিবারের ইচ্ছানুযায়ী ,এখানেই স্থির করা হয়। আমরা আর এর ভিতরে যেতে পাই নি তাই বাইরের দেওয়ালেই হাত রেখে আত্মার পরিতৃপ্তি করলাম। 

এ ছাড়াও এই কার্তাহেনাতে তিনি কিনেছিলেন, জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাবেন বলে, একটি বাড়ি। সে বাড়িটিও আজ আর তাঁর পরিবারের বা দেশের সম্পত্তি নয়। সেটি একটি অন্য কোন ব্যক্তিগত মালিকানায় রয়েছে। লাল বিশাল সবুজ লতায় ছাওয়া বাড়িটি আজ দেওয়ালে তাঁর একটি মুখের ছবি আর কিছু বিবর্ণ হয়ে যাওয়া স্মৃতি  আঁকড়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে, নির্জন বাঁধানো রাস্তার ধারে।কাজেই সেখানেও আমাদের প্রবেশাধিকার নেই।
আমাদের কার্তাহেনায় থাকার সময় শেষ। এবার পা বাড়াতে হবে এই কলম্বিয়ার রাজধানীর দিকে, নিতে হবে তারই প্রস্তুতি।
আজ রাত দশটায় প্লেন। আমরা যাব কলম্বিয়ার রাজধানীতে।বোগোটায়।

🍂
ad

অত মালপত্র নামাব কি করে তিন তলা থেকে, চিন্তা ছিল। লম্বা স্বাস্থ্যবান ছেলে , এই সময়ের কেয়ারটেকার জোনাথনকে বললাম। ছেলেটি বেশ ভদ্র, বুদ্ধিমান, এবং বিনয়ী। তাকে বলতেই, বলল, কোন চিন্তা করবেন না, আমি আছি। সত্যিই, গাড়ির ড্রাইভার যখন ঠিক সন্ধ্যা সাত টায় এল, সে সব মালপত্র নীচে নামিয়ে গাড়িতে তুলে দিল। এই দু’ দিনেই ওরা সব যেন কেমন নিজের লোকের মত হয়ে গিয়েছিল। কিছু অসুবিধা সত্বেও, ওদের সাধ্যমত যথেষ্ট সাহায্য করেছে ওরা। ছেড়ে আসতে মনটা খারাপ লাগছিল।
আমাদের গন্তব্য আবার সেই Rafael Nunez International Airport. আমাদের ড্রাইভার চলে এল ঠিক সন্ধ্যা ৭.০০ টায়। নামার সময়। ড্রাইভারই সাহায্য করে সব নামিয়ে দিল। পিছন ফিরে চলে আসছি, ড্রাইভার ছেলেটি, একেবারে তরুণ, আমার হাতে তুলে দিল আমার মোবাইল ফোন। বলল, ওটা সিটে পড়ে গিয়েছিল। আমি তাকে ধন্যবাদ বা ভালবাসা জানানোর ভাষা পেলাম না। চোখে জল এসে গেল। 
ভাবছিলাম, যদি এটা হারিয়ে যেত, আমি খুব বিপদে পড়তাম। এতেই তো আমার সব কিছু যোগাযোগ, দরকারী ডকুমেন্ট সব আছে। কাজেই মানুষ আজও অনেক ভাল আছে পৃথিবীতে, এই উপলব্ধি আমার মনের গভীরে আরও দৃঢ় হল। 
মার্কেজের প্রিয় শহরকে ছেড়ে আসতে মনটা যেন এক অব্যক্ত ব্যথায় ভরে যাচ্ছিল। আবার ভালো লাগছিল যে, এরকম একটা জায়গায় , পবিত্র তীর্থে অন্ততঃ একবার আসতে পেরেছি বলে।
 
বোগোটা পর্ব-

আমাদের টিকিটে সব করাই ছিল। কিন্তু রাফায়েল নুনেয এয়ারপোর্টে ঢুকতেই বাধা এল।সমস্যা হল, এয়ারপোর্টে ওদের স্ক্যানারে আমাদের টিকিট কাজ করল না। ওরা তাই আমাদের ঢুকতেই দিল না। অগত্যা বাইরে ( এয়ারপোর্টের ভিতরেই) বসে থাকতে হল, যতক্ষণ না আমাদের Latam Airlines এর টিকিট কাউন্টার খোলে।বেশ অনেকক্ষণ বসে থাকার পর যখন কাউন্টার খুলল, ওরা সব দেখে, সঠিক টিকিট নিশ্চিত হয়ে আবার অন্য টিকিট বদল করে দিল । তখন  আমাদের ওরা একেবারে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে চলে গেল বোর্ডিং গেটের কাছে কারণ অনেকটা দেরী হয়ে গেছে।

সেখানে ওরা আমাদের টিকিট দেখে বলল, নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকুন, আমাদের দায়িত্ব, আমরা ঠিক সময়ে আপনাদের স্পেশাল কেয়ার নিয়ে তুলে দেব।ওদের দায়িত্ব দেখে আমরা আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
বোর্ডিং শুরু হল। চোখের সামনে দিয়ে সবাই উঠে গেল এক এক করে। আমরা পাশে বসেই রয়েছি। সাধারণতঃ সমস্ত প্লেনে, হুইল চেয়ারকে আগে উঠতে দেয়। এখানে তার কোন লক্ষণই দেখলাম না। আমরা ভাবলাম, ওরা কি ভুলে গেল নাকি আমাদের কথা।
শেষে দেখি, গেটে দাঁড়ানো মেয়ে দুটি যারা টিকিট চেক কররছিল,ওরা নিজেরাই আমাদের দুজনকে ঠেলতে ঠেলতে সোজা প্লেনের কাছে নিয়ে গিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে ধরে ধরে তুলে একেবারে জায়গায়, মালপত্র রেখে বসিয়ে দিল। আমরা তো এত আতিথ্য, আর যত্ন পেয়ে অভিভূত।মেয়ে দুটি আবার জিজ্ঞাসা করছে, আপনারা কত দূর থেকে এসেছেন আমাদের দেশে, কেমন লাগল, আমাদের? উত্তর দিতে আবেগে গলা বন্ধ, বাক রূদ্ধ হয়ে চোখে জল এসে গেল। ওদের ছোঁয়ায় নিজের মেয়ের অনুভূতি পেলাম। ভুলব না কার্তাহেনাকে।
এটিই সান পেদ্রো ক্ল্যাভার চার্চ বা মিউজিয়াম

বোগোটাতে এল ডোরাডো এয়ারপোর্টে এলাম যখন, রাত বারোটা বাজে। প্লেনের গেট থেকে দুটি সুন্দরী মেয়ে আমাদের তুলে নিল যত্ন করে, সেখান থেকে গিয়ে ব্যাগেজ কাউন্টার থেকে আমাদের মাল নিয়ে, সোজা বাইরে ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে হাজির হল। এ মেয়ে দুটির ব্যবহারও খুবই ভাল।
এখানে দেখি আমাদের নাম লেখা বোর্ড নিয়ে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে।আমাদের হুইল চেয়ার থেকে উদ্ধার করে তুলে নিয়ে ছেলেটি চলল, তার গতিপথ ধরে।অনেক পাহাড়ী পথে অন্ধকারের বুক চিরে রাস্তায় সাপের মত এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি অত রাত্রে।একটা স্বপ্নের মত নীল অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে চলেছি। শহরটার সম্বন্ধে খুব ধারণা করতে পারছি না। তবে পাহাড়ি পথের একপাশে জঙ্গল আর একপাশে খাদের মধ্যে দিয়ে যে চলেছি বুঝতে পারি।

 শেষে গাড়ি পৌঁছাল একটি রাস্তায়।বৃষ্টি তখন আর নেই। এলাকাটায় মনুষ্যবসতি রয়েছে বুঝতে পারি। কিন্তু চারিদিক অত রাত্রে নিঃশব্দ খাঁ খাঁ। রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোও নেই। নতুন শহরে এই আলো আঁধারী অচেনা জায়গায় একটিও লোক নেই ধারে কাছে , একমাত্র এই ড্রাইভার ছাড়া।গা ছমছম করছে।
একসময় প্রায় চোরের মত নামলাম একটি ঘরের সামনে, দরজা খুলে দেওয়ার জন্য বা আতিথ্য করার মতও কেউ নেই, এমন কি চিৎকার করার মত রাতজাগা কুকুরও নেই। শুধু রাস্তার অল্প আলোয় বন্ধ বাড়ির দরজাগুলো মড়ার মত দাঁড়িয়ে আছে।

এর পরের অবস্থা আরও করুণ আমাদের জন্য। শোনার জন্য বন্ধুদের অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও একটি সপ্তাহ।

ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments