পর্ব-৪
মৌসুমী ভট্টাচার্য
আজ অনীক ভীষণ ভাল মুডে। বিগত কয়েক বছরে এমন খোশমেজাজে তাকে দেখা যায় নি। রনি ও খুব খুশী,এমন একটি আবহাওয়া সে সবসময় চায়। আজ আবার মা একটু বেশিই চুপচাপ, কেনো কে জানে !এ বাড়ি টা সবসময় গুমোট বাতাবরণে মুড়ে থাকে ।সে আড়চোখে তৃষাকে দেখে সিঙারাতে কামড় দেয়। “ আচ্ছা, আমি যদি কিছুদিন বাইরে থাকি,তোমরা পারবে তো থাকতে? না,তোমার মা-বাবাকে বলি…এখানে এসে থাকতে!”,আচমকা তৃষাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় অনীক। “কোথায় যাবে বাবা?” রনি শুধোল । অনীক হাসিমুখে ছেলেকে বলল, “ ভাল করে পড়াশুনা করো বাবা। মাকে দেখে রেখ’’।
সন্ধ্যা থেকে অনীকের আচরণ ,এত ভাল ব্যবহারের হেতু কিছুটা আন্দাজ করল তৃষা। তার মেজাজ খারাপই ছিল,এখন বিদ্রুপে ঠোঁটের কোণা বেঁকে যায়,বলে, “ সে কি কোথায় যাচ্ছ,আর কতদিনের জন্য? কি করে থাকব? তুমি সবকিছু সামলে নাও, তাই আমি তো কিছুই জানি না”। রণি কিছুটা ত্রস্ত ,কিছুটা বিরক্ত। এই পরিবেশ ঘোরালো হচ্ছে বুঝি। কিন্তু তাকে ভুল প্রতিপন্ন করে খুব মিষ্টি হেসে অনীক বলল, “মাসখানেকের জন্য জার্মানী যাচ্ছি। আজই কনফার্ম হল”, তৃষার ব্যঙ্গোক্তি অগ্রাহ্য করে এবং রাগ না করে বলে অনীক। “ ওহ,বাবা,দ্যাটস গ্রেট’,রণি উচ্ছ্বসিত। তৃষাও হাসল,…গৌরবের,আনন্দের হাসি। অনেকদিন পর এক মনোরম আনন্দময় সন্ধ্যা কাটল। একসাথে ডিনার খাওয়া হল। অনীক ছেলের সাথে ভিডিও কলের ব্যবস্থা করার আলোচনা করছে। তৃষার স্মার্ট ফোন নেই। বেশ কয়েক বছর আগে ,তখনো স্মার্ট ফোনের রমারমা হয় নি, অনীক এক ক্যামেরা কিনেছিল,ডেস্কটপের সাথে অ্যাটাচড্ করে ভিডিও কনফারেন্স করা যায়। এখন ঐ ক্যামেরা দিয়ে চলবে। অত্যাধুনিক টেকনোলোজি-র পেছনে দৌড়নো তৃষার স্বভাব নয়। সাদামাটা নোকিয়া সেট টি তার জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। “ দেখি ,তোমার জন্যে এক মোবাইল নিয়ে আসব। তোমার মা-র কি লাগবে?”, অনীক তখনো রনির সাথে কথায় মত্ত। তৃষা আড়চোখে এই পারিবারিক সুখের টুকরো ছবি দেখল। ডিনারের পরও তার কিচেনে অনেক কাজ থাকে।
রনি পড়ার টেবিলে ফিরে গেছে। অনীক কিচেনে গিয়ে তৃষাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ,ঘাড়ে মুখ ঘসে ,কানের লতিতে কুটুস করে কামড়ে বলল, “ আজ একটু ড্রিংক নেব। তুমি কি নেবে? ওয়াইন না স্কচ অন রকস্?” তৃষা এই অনীককে চেনে। প্রেমিক অনীক।বছরে দু’একবার প্রকাশিত হয়,বাকি সময় হাইবারনেসনে থাকে। শুধু ড্রিংকস নয়, এরপর অন্য চাহিদাও থাকবে। তৃষা জানে, এই সুখের মুহূর্ত গুলো ভীষণ ক্ষণস্থায়ী,ভঙ্গুর। এক্ষুণি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়তে পারে। এই মুহূর্তকে ধরে রাখতে হলে,তৃষাকে অনীকের প্রস্তাবে রাজী হতে হবে। শুধু রাজী নয়,আগ্রহ দেখাতে হবে। রেড ওয়াইন বা স্কচের গ্লাসে তার গ্লাস ঠেকিয়ে ‘চিয়ার্স’ বলতে হবে।
তার ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোনদিনই প্রাধান্য পায় নি। আজ তার ইচ্ছে করছিল না সাড়া দিতে,কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ করতেও ইচ্ছে করছে না। তাই ডিপ্লোমেটিকেলি ঈষৎ উষ্ণ সুরে বলল, “ আরে, কি করছ !রনি দেখে ফেলবে’।
“দেখুক না,ওর মাকেই আদর করছি। আজ কোনো ‘না’ শুনব না কিন্তু’’।
মদ্যপান নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি প্রেজুডিস নেই তৃষার। অনীকও অকেশন্যালী নেয়,আর কখনো মাত্রা ছাড়ায় না। এই গুণটি আছে। রনি-র সামনে এর আগে কখনো খায় নি সেভাবে। ঘরে কিশোর ছেলে থাকলে অনেক কিছু ভাবতে হয়। রনিকে বোঝাতে হবে,বছরে দু-একদিন সেলিব্রেট করাই যায়,ঘরে করাই শ্রেয়। বেশি প্রটেক্টেড হয়ে বড় হলে,পরে হোস্টেল লাইফে অসুবিধা হয়। রনি আর দু’বছরের মধ্যেই বৃহত্তর জীবনে প্রবেশ করবে। তাকে শেখাতে হবে মদ্যপান খারাপ নয়,মদ যেন মানুষকে না খায়। কে কতটা ভাল থাকবে, তা নিজের উপর। ভাল কোয়ালিটির মদ,ভাল কোয়ালিটির সঙ্গ,এ দুটো বজায় রাখতে হয়। কাবার্ড থেকে দামী কাচের গ্লাস বের করে, ট্রে-তে আইস,ডালমুট,কাজু সব সাজাতে সাজাতে তৃষা ভেবে নেয়,রনিকে কি বোঝাবে। পারিবারিক মূল্যবোধ আর আধুনিকতার সংজ্ঞার ব্যাখ্যার এক লেকচার মনে মনে ঝালিয়ে নিতে নিতে তৈরী হল,অনীকের আহ্বানে সাড়া দিতে।তার সুখটুকুও যে এই স্কচ আর সোডার বুদবুদের মত। বুরবুরি কেটেই মিলিয়ে যায়।অন্তত আজকের রাতটা ভাল কাটুক। আয়নার সামনে চুলে চিরুনী বুলিয়ে,একটু ডিও স্প্রে করে নিল। এমন আলুথালু বেশ অনীকের রোমান্টিক মুড নষ্ট করতে পারে। একটা খুনী হাসি হেসে ভাবে সুখের এই মুহূর্তটা ফুটুস করে দিলে কেমন হয়!অনীক এমন বহু সুখের মুহূর্ত খারাপ করেছে। কিন্তু না,আজ নয়। আজ সব অভিযোগ,প্রতিশোধস্পৃহা …সব তোলা থাক। তৃষা মুখে জোর করে হাসি আনে….আক্রমণের দাঁত,নখ গুলো লুকিয়ে ফেলে….সেলিব্রেশনে গা ভাসাতে তৈরী হয়।
(সমাপ্ত)..
🍂
0 Comments