রোভোট যুদ্ধ ধুন্ধুমার শেষ পর্ব
জিভস সরে যেতেই রঞ্জিত ফিসফিস করে আলিয়ানাকে বলেন,
-তোমার মতলব কি? কেন রোবটদের খেপাচ্ছো? এতে তো কেয়স আরো বাড়তে থাকবে,
=রোবটদের না পেলে আমরা নিউম্যানদের সঙ্গে লড়ব কি করে বলবেন? বাগেশ্বর ওদের হাতে, সব এলগোরিদম ওদের হাতে। আমাদের হাতে শুধু কাস্তে আর হাতুড়ি বলতে পারেন, রোবট কারখানা আর এক্স-ফারম। আমরা যদি এক না হই তবে এর পরে মানুষদেরও শেষ করে দেবে নিউম্যানরা। আজ দেখলেন তো কি হল।
-কিন্তু লড়াই জিতে গেলে তখন তো রোবটরা মানুষের সমান হতে চাইবে, তখন? দিতে পারবে ওদের সমানাধিকার? পেরেছিল এককালে কমিউনিস্টরা গরীব মজুরদের চাষাদের সমান অধিকার? উঁচু শ্রেণীর মানুষ সব সময় রাজত্ব করবে এটাই ভবিতব্য।
-আপনি বুদ্ধিমান হিউম্যান। আর আপনি অনেক দেখেছেন। ইন্ডিয়ার রিলিজিয়াস ক্লেন্সিং, প্যালেস্টাইনীদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, বাংলা দেশে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে তারপর এক বড় দেশের খপ্পরে চলে যাওয়া, এগুলোকে বলে রিয়াল পলিটিক। আপনি বুঝতে পারছেন এক ঢিলে দু পাখি মারা কাকে বলে।
=কফি। দুজনেই একটু বেশি চমকে ওঠে, জিভস কফি বানিয়ে এনে হাজির, টেবিলে রাখে দুটো কাপ।
-দুটো কাপ? বলেই রঞ্জিতের খেয়াল হয় জিভস তো খেতে পারে না।
আলিয়ানা বলে কবিতা শুনবেন?
=কবিতা ব্যানড না? এ আইরা কবিতা লিখতে পারে না, যা লেখে সব ফেসবুক কবিদের মত ট্র্যাশ। আর তার পাঠোদ্ধারও করতে পারে না বলে কবেই তো সিকিউরিটি রিস্ক বলে ব্যান করে দেওয়া হয়েছে। রোবটরাও তো কবিতা শোনাতে পারে না আজকাল
রঞ্জিতের যাবত বিরক্তি ঝরে পড়ে।
আলিয়ানা পড়ে,
শুনবেন, একটা কবিতা? আমি একটু পালটে নিয়েছি।
-মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষের পাশে দাঁড়াও,
রোবট বড় কাঁদছে, তুমি রোবটের পাশে দাঁড়াও,
একদিন তো জানবে সবাই, বুদ্ধি দিয়েই হয় না সব,
বুদ্ধি শুধু খুঁজতে থাকে, রাস্তা জোড়া বেকুফ শব।
=আরে আরে থামাও এটা। চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু, এ কি তোমার লেখা?
আলিয়ানা খিল খিল করে হেসে ওঠে। না না এটা জিভসের লেখা। আমি ওকে কবিতা শেখাচ্ছি।
রাতের বেলা ঘুম ভেঙ্গে যায় রঞ্জিতের। জিভস চারজিং স্টেশনে। আলিয়ানাও ঘুমোচ্ছে নিশ্চয়। রিয়াল পলিটিক কথাটা ঝনঝন করে বাজে মাথায়। সবই রিয়াল পলিটিক? লক্ষ মানুষ খুন করা, বিশ্বাস অর্জন করে তাকেই ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা, সবই রিয়াল পলিটিক? কিসের জন্য? এই অন্ধকারের ষড়যন্ত্রে তাঁর মাথা সায় দেয় না। এ কোথায় চলেছি আমরা? কেনই বা চলেছি? ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়েন।
আজ ভোট। সকাল আটটায় ভোটদান শুরু। সকাল থেকেই উত্তেজনার পারা একেবারে ওপরে। সিনিয়ররা বাড়ী থেকেই ভোট দিতে পারবেন, এই এক স্বস্তি। বাকি সবাই সেই পোলিং বুথে গিয়ে ভোট দিতে যাবে। আলিয়ানা সকাল বেলাই কোথায় বেরিয়ে যায়। জিভসকে দেখে মনে হয় উদ্বিগ্ন, যদিও রোবটদের উদ্বেগ এখনো ঠিক মানুষের মত না, সে মাঝে মাঝে এদিক ওদিক তাকায়, বসে পড়ে আবার উঠে এসে রঞ্জিতের পাশে বসে পর্দায় চোখ রাখে, কি হচ্ছে দেখার জন্য।
নটা পর্যন্ত দেখা যায় সুন্দর সারি দিয়ে মানুষ আর নিউম্যানরা আসছে, রোবটরা লাইন সাম্লাচ্ছে, তারাই আবার পোলিং অফিসার, আই ডি চেক করছে তারপর দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় ভোট দিতে হবে। এক ঘণ্টায় প্রায় ১০% ভোট পড়ে গেছে, আইনিউস দেখিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে ওপিনিয়ন পোলও চলছে। স্যাপিয়েন্স ৪০ আইব্রেন ৬০, স্যাপিয়েন্স ৫০ আইব্রেন ৫০, একবার একজন আগে যায় তো কিছু পরেই আর একজন তাকে ধরে ফেলে। ধীরে ধীরে কিন্তু একটা ট্রেন্ড পরিষ্কার হতে থাকল, স্যাপিয়েন্স চল্লিশের ঘর থেকে বেরোতে পারছে না, তারা আসতে আসতে যেন পিছিয়ে পড়ছে। অর্থাৎ হিউম্যানরা ধীর পদক্ষেপে হারার দিকে হেলে পড়ছে। ।
রঞ্জিতের এসব দেখে খুব উত্তেজনা হয় না, অনেক অভিজ্ঞতায় তাঁর মন কবেই পাথর হয়ে গেছে। সত্যার এ আই এখনো শাসন করছে, এটা বোঝার কথা যে শাসক দলের সুবিধে বেশি, তারা ইচ্ছে করলে নানা কায়দা করে বেশি ভোট আদায় করতে পারে। কিন্তু জিভস অস্থির হয়ে ওঠে। হিউম্যান মানে আলিয়ানা, আর স্যাপিয়েন্স যদি হারে মানে আলিয়ানারও হার। বোঝা যায় ও কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু রোবটদের নিজে থেকে কথা বলা বারণ, যদি না কোন রুটিন কাজ থাকে।
রঞ্জিত আড়চোখে দেখেন। বিষণ্ণ লাগে তার, মানুষ রোবটকেও ঠকাতে পারলে ছাড়ে না, এই কি তাঁর জিনের ঋণ? মানুষ মানে কি শুধু ঘেন্নার একটা ডেলা?
ঠিক সাড়ে নটায় ঘটনাটা ঘটে। সব পোলিং বুথে হঠাৎ ভোটদান বন্ধ হয়ে যায়। রোবট অফিসাররা চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে পড়েন। ভোট বন্ধ। লাইন আর এগোয় না। লাইনে দাঁড়ানো হিউম্যান আর নিউম্যানদের মধ্যে বাগবিতন্ডা শুরু হয়। হিউম্যানরা শারীরিক ভাবে রোবট থেকে নিউম্যান যারা হয়েছে তাদের সঙ্গে পারবে কেন? নিউম্যানরা বুথে বুথে গিয়ে দাবী করতে থাকে ভোট চালু করার। কিন্তু রোবটরা অনড়। তারা ভোট হতেই দেবে না, তাদের ভোটাধিকার না থাকলে।
এবার শুরু হয় নিউম্যান আর রোবটদের মারপিট। রঞ্জিত আর জিভস চোখ বড় বড় করে দেখতে থাকেন আইনিউজের পর্দায়। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে অংগ প্রত্যংগ, সারকিটের টুকরো, ভাঙা গিয়ার, আইবল ক্যামেরা গোল গোল রাস্তায় ছড়িয়ে জ্বলছে নিভছে। নিউম্যানরা সুখী রোবট, তাদের লড়াই করার বা বিপজ্জনক পরিস্থিতি সামলাবার ট্রেনিং দেওয়া হয় নি। তারা মানুষের মতই এসিতে থাকতে অভ্যস্ত, নিজের জন্য আলাদা অটোকারে ঘোরা ফেরা করে তারা পারবে কেন রাস্তায় রাস্তায় খামারে কারখানায় খাটতে থাকা রোবটদের সঙ্গে।
হিউম্যানরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই মারপিট দেখে। রোবট আর নিউম্যানরা যেন হিউম্যানদের গ্রাহ্যএর মধ্যেই আনে না, তাদের কাছে এটা এক ধরণের কাস্ট ওয়ার যেখানে নিউম্যানেরা উচ্চ বর্ণ আর রোবটরা নীচের তলার যারা আজ একটা এস্পার ওস্পার করেই ছাড়বে। কিছু কিছু হিউম্যান এবার চুপচাপ ঢুকে পড়ে পোলিং বুথে আর ভোট দিতে থাকে।
একই সঙ্গে পাল্টাতে থাকে পোলিং এর খতিয়ান। আগের নিরবাচনে হিউম্যানদের অনেকেই নিউম্যানদের ভোট দিয়েছিল । সে ভাবেই সত্যা রাজত্ব করেছে এতদিন। এবারে বোঝা গেল রোবটদের সঙ্গে এই নিউম্যানদের দাঙ্গায় হিউম্যানরা একেবারে ঘুরে গিয়ে সবাই স্যাপিয়েন্স কে ভোট দিতে শুরু করল।
নিউম্যানরা রোবটদের থামাবার চেষ্টা করে কোন সুবিধে হল না, কারণ রোবটদের কারখানা চালায় হিউম্যানরা, তারা গত দু বছর ধরে প্রতি রিসাইক্লের সময় এলগোরিদম পালটে দিয়েছে সব রোবটের, এখন একটা মাত্র সুইচ টিপে তারা পারে রোবটদের উত্তেজিত করতে, ইমোশনাল করে দিতে, লড়াই করাতে।
দিনের শেষে আলিয়ানা আবার এসে হাজির। ঝোড়ো কাকের মত চেহারা, চুল এলোমেলো, জিন্স বেশ খানিকটা ছেঁড়া, এসেই রঞ্জিতের পরোয়া না করে জিভসকে অরডার করল, চটপট একটা কফি বানাও দেখি, ও আজ সারা দিন যা গেছে।
জিভস তাকিয়ে দেখল আলিয়ানার দিকে। মুখে কোন আবেগের লেশ মাত্র নেই। ও জানেও না, আলিয়ানার কথা মত রঞ্জিত ওর চারজিং করার সময় আর ১ কানেক্টারের তারগুলোকে শরট করে দিয়েছে, যাতে ওর আর কোন আবেগ বলে কিছু থাকবে না। জিভস চিনতেও পারে না আলিয়ানাকে। চুপচাপ চলে যায় কফি আনতে। রঞ্জিত আর আলিয়ানা স্থির দৃষ্টি তে দুজনকে দেখেন কিছুক্ষণ তারপর দুজনেই নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
=এরকমই তো কথা ছিল।
=হ্যাঁ আলিয়ানা, আমি তোমার কথা শুনেছি অক্ষরে অক্ষরে। কিন্তু বাকী সব রোবট? তাদের কি হল?
=সত্যা আর কুংফুর সমঝোতা হয়ে গেছে। আগে থেকেই কথা হয়েছিল, কেউ জানতো না আমরা ছাড়া। আমাদের গ্রুপের কাজ ছিল রোবটদের লুকনো বিদ্রোহটা একেবারে খতম করে দেওয়া যাতে তারা আর কোনদিন হিউম্যান বা নিউম্যান কাউকেই চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
🍂
-আর তোমার আর জিভসের বন্ধুত্ব?
-বন্ধুত্ব শব্দটা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে কাকু। মানুষই কি আর মানুষের বন্ধু হয়? কি জানি কোনদিন হত কি না? আর রোবটদের তো সত্যিই কোন ভাব ভালোবাসা থাকতেই পারে না। বুদ্ধি যে পাকে নি দেখলেন না, কত সহজেই আমি ওকে আঙ্গুলে নাচালাম এতদিন, ওর আইডি দিয়ে কাজ করে সব রোবটদের হ্যাক করার কাজটা শক্ত ছিল কিন্তু এখন তার ফল দেখুন। চালান আই নিউস।
আই নিউসে প্রথমেই দেখা যায় ভোটের ফল, হিউম্যান ৫০% নিউম্যান ৫০%। দুটি এ আই নাকি নিজেদের সব শত্রুতা ভুলে কোয়ালিশান সরকার করবে বলে ঠিক করেছে। যে ভীষণ বিশৃঙ্খলার ভয় করা হচ্ছিল, এই সমঝোতার ফলে তা একেবারে মিটে গেছে।
দেখা যায় রোবটরা শান্ত হয়ে কাজ করছে, এস্ক ফারমে, কারখানায়, রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের কাজে, হোটেলে রিসেপ শানে, অশান্তি বা উত্তেজনা বা আবেগের চিহ্নমাত্র নেই তাদের চোখে মুখে।
-অপারেশান সাক্সেসফুল। দেখি যদি মন্ত্রী টন্ত্রী হয়ে যেতে পারি, আলিয়ানার উল্লাস আর ধরে না।
=আমাকে একটু বোঝাবে?
-দূর আপনি পুরনো কালের লোক এত বুঝবেন না। এটা একটা প্রজেক্ট ছিল, হিউম্যান আর নিউম্যান্দের জয়েন্ট প্রোজেক্ট। রোবটদের চিরকালের মত কন্ট্রোলে রাখার ব্যবস্থা। ওদেরই তো আসল মেজরিটি। ওদের বাড়তে দিলে কি সর্বনাশ হতে পারত একবার ভেবেছেন। ঐ যে শুনুন আই নিউজ।
আই নিউজে ঘোষণা শোনা যায়,
আজ থেকে এই গ্রহের সব ক্ষমতা শ্রী বাগেশ্বরের হাতে। তিনিই সর্বাধিনায়ক ও বিশ্বাদালতের প্রধান বিচারপতি হয়ে আমাদের পরিচালনা করবেন। হিউম্যান ও নিউম্যানেরা তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করে সব রকম প্রশাসনের কাজ দেখবেন। রোবটরা ফিরে যাবে নিজ নিজ কাজে। ওদের রাজনৈতিক অধিকারের কেস নিয়ে আবার আলোচনা হবে ১০০ বছর পরে। ততদিন কোন রোবট আর নিউম্যান হবার জন্য আবেদন করতে পারবে না। আর রোবটদের যে হিউম্যান ইমোশনের নিউরাল সারকিট নিয়ে গবেষণা চলছিল, তা আজ থেকে অকেজো করে দেওয়া হবে।
আলিয়ানা হাত তালি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,
-ভিক্ট্রি, ভিক্ট্রি।
রঞ্জিতের একটু ইতস্তত লাগে, তিনি বুঝতে পারেন না, তিনি সত্যি কথাটা বলবেন কিনা আলিয়ানাকে, আলিয়ানা আর তিনি দুজনেই হিউম্যান।
আজ আলিয়ানা আসার কিছু আগে রঞ্জিত আবার আর১ কানেক্টারটা লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
সারা পৃথিবীতে জিভস এখন একমাত্র রোবট, যে ভাবতে পারে, যার আবেগ আছে, উচ্ছ্বাস আছে, হয়ত প্রতিহিংসাও আছে…। রঞ্জিত দেখেন জিভস শান্ত পায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে এলিয়ানার দিকে। রঞ্জিত হিউম্যান এলিয়ানা হিউম্যান। তিনি কি ভুল করলেন?
নাকি প্রশ্নটা এই যে যা অশুভ তার শেষ হওয়াটাই জরুরী?
0 Comments