জ্বলদর্চি

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি ( দ্বিতীয় পর্ব)/চিত্রা ভট্টাচার্য্য

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি  ( দ্বিতীয় পর্ব)
       চিত্রা ভট্টাচার্য্য

''  আমি সন্ন্যাসী ,সুর সৈনিক 

                        আমি যুবরাজ ,মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক  

                       আমি বেদুইন ,আমি চেঙ্গিস ,

                               আমি আপনারে ছাড়া করি না 

                                           কাহারে কুর্নিশ !'

 দূর থেকে কিশোরের উদাত্ত কণ্ঠে গঙ্গাপাড়ের আকাশ বাতাসে ঝড় বইয়ে প্রতিধ্বনিত্ব হচ্ছে রক্তে সাড়া জাগানো কবি কাজী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার আবৃত্তি ! সেই অবিস্মরণীয় শব্দরাশি তে প্রলয়ের ঝঙ্কার। ১১ই জৈষ্ঠ্য চলে গেলেও, আজ ভাগীরথীনদীর তীরে বিদ্রোহী কবি নজরুলের ১২৬ তম জন্মদিন স্মরণে উদ্বেলিত এক মনোরম সাংস্কৃতিক সান্ধ্য অনুষ্ঠান যাপিত হচ্ছে।  নজরুলগীতি , নৃত্য নাট্য আবৃত্তিতে গল্পে আলোচনায় সাজানো স্মৃতি তর্পন। সেই সুমধুর স্মরণ সভায় চলার পথে অজস্র পথিকের মত আমিও কান পেতেছি। জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৩০ টি বছর সম্পূর্ণ স্তব্ধতার মোড়োকে ঢাকা হয়ে কবি  নীরব থাকলেও , তাঁর অসামান্য সৃষ্টির মাঝে এই জেট যুগে ও সে সমান সোচ্চার তেমনি প্রাসঙ্গিক।  হয়তো  আগামীতে আরো শতশত বছর পরেও কবির জন্মদিন এমনই সান্ধ্যপরিবেশে এমনি করেই উদযাপিত হবে এই বঙ্গভূমিতে বাঙালির অফুরন্ত হৃদয়াবেগে।   

 বিদ্রোহী কবির আত্মপ্রকাশ ;---

   ধূমকেতুর মত উদয় হলেন কবি ঝঞ্ঝা বিধ্বস্ত আকাশে। বিপ্লবের ভাষায় মুখরিত তাঁর কলম আঘাতে আঘাত করে বারবার জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল অত্যাচারিত ভারতবাসীর অপমানে নতশির ,বেঁকে যাওয়া মেরুদন্ড, ঝিমিয়ে পড়া সুপ্ত চেতনাকে। তাঁর দৃপ্ত হুঙ্কার ছড়িয়ে পড়লো দিকেদিকে। কবি ধূমকেতু ও লাঙ্গল নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করে দেশপ্রেম ও মানবতার আদর্শ প্রচার করেছিলেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভবঘুরে কবি কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে রচনা করেছিলেন তাঁর বহু আলোচিত সর্বাধিক জনপ্রিয় দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্য কর্মের সৃষ্টি '' বিদ্রোহী কবিতা ''ও ''ভাঙ্গার গান ''। যা বাংলা কাব্যসাহিত্যে ও  গানের ধারাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল।  তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, দোলনচাঁপা, সিন্ধু-হিল্লোল, ছায়ানট, বুলবুল প্রভৃতি। 

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দাবানলে পৃথিবী জুড়ে চলছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম,সর্বত্র জ্বলছে হিংসার আগুন। ব্রিটিশ শাসনে ও শোষণে ক্ষত বিক্ষত ভারতীয় উপমহাদেশের সেনাবাহিনীর এক তেজোদীপ্ত সৈনিক নজরুল কুচকাওয়াজের সঙ্গে শত্রুনিধনের  প্রশিক্ষণে ব্যস্ত  বীরযোদ্ধা, অসম-সাহস ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক।  অন্যায়ের প্রতিবাদে ঘোর বিদ্রোহের বীজ বপন হয়েছিল তাঁর যৌবনের মসনদে। আত্মসচেতন কবির মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল অদম্য সাহস।  সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতায় তাঁর অন্তরাত্মার  অব্যক্ত ধ্বনি তাঁকে আলোড়িত করেছিল। নিপীড়িত-নির্যাতিত, শোষিত-উপেক্ষিত বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ালেন  এক ব্যথা-বেদনামুক্ত নির্মল সমাজ প্রতিষ্ঠার দাবিতে। 

পরাধীন ভারতবর্ষে তখন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে সমাজে শক্ত আসন গেড়েছে অন্যায়-অত্যাচার ও বৈষম্য। সমাজের বুকে জাঁকিয়ে বসা এই বৈষম্য ও অচলায়তনকে ভাঙতে চেয়েছিলেন কবি। সেই লক্ষ্যেই  স্থিরথেকে তিনি উচ্চারণ করেন এমন বিদ্রোহের হুঙ্কার । তাঁর এই দ্রোহ কোনো নির্দিষ্ট গতির ধারায় আবদ্ধ নয়। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তিনি বিধ্বংসী রূপ নিয়ে আবির্ভূত হলেন। বিদ্রোহী চেতনার ধার হিসেবে অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে তাঁর এই নিরন্তর বিদ্রোহের বিষয়টি ব্যক্ত করেছেন।কবি নিজেকে বিশ্ব-বিধাতার বিদ্রোহী-সুত বলেছেন।  বিদ্রোহী'কবিতাটি তে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সরবে ধ্বনিত হয়েছে এক আত্মজাগরণের কাহিনি। 
🍂
ad

     বিশ্বকবিতার ইতিহাসে শতবর্ষের ও আগে রচিত কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এক অনন্যসাধারণ, বিস্ময়কর সৃষ্টি । অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সর্বাধিক জনপ্রিয়তা আজো অর্জন করে আছেন। যে কবিতার প্রতিটি শব্দ প্রতিটি পংক্তি আজো সমান ভাবে রক্তপ্রবাহে উন্মাদনা জাগায়। মাত্র বাইশ বছর বয়সে নজরুলের লেখা প্রায় দেড়শো পঙ্ক্তির ভুবনজয়ী কবিতা  বিদ্রোহী 'এখনো সমান আলোচিত। এখোনো অব্যাহতভাবে ভয়েভীত দুর্বল ভীরু কাপুরুষ জাতির মনে শক্তি ও সাহসের সাথে রক্তে বীররসের সঞ্চার করে এবং এ কবিতার প্রতিটি শব্দ শরীরের প্রতিটি রোমকূপে আলোড়ন তোলে ।  নজরুলের  রোমান্টিক অনুভবে  মানবতার সপক্ষে তিনি উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহের বাণী। সত্য সুন্দর মঙ্গল ও শান্তির বাসনায়  বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন যাবতীয় অপশক্তির বিরুদ্ধে, ধর্মীয় শোষণ এবং জীর্ণ-সনাতন মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। 

পরাধীনতার গ্লানিতে নজরুলচিত্ত দীর্ণ হয়েছে এবং এই গ্লানি থেকে মুক্তির অভিলাষে তিনি হয়েছেন বিদ্রোহী। নজরুল অসামান্য ভাষা ও শব্দের নির্মাণ-কুশলতায় কবি নিজেকেই বলেছেন  বিদ্রোহী,  বিস্ময় জাগে যখন দেখি ,একটি কবিতার শিরোনাম একজন কবির নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে।  নজরুলের  রোমান্টিক অনুভবে  মানবতার সপক্ষে তিনি উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহের বাণী। সত্য সুন্দর মঙ্গল ও শান্তির বাসনা ও প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে যাবতীয় অপশক্তি, ধর্মীয় শোষণ এবং জীর্ণ-সনাতন মূল্যবোধের বিরুদ্ধে।  

তাঁর বিদ্রোহ ছিল পরাধীনতার বিরুদ্ধে উচ্চকিত, সকল আইনকানুনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ, ইতিহাস নিন্দিত চেঙ্গিসের মতো উন্মত্ত নিষ্ঠুরতার জয়গানে মুখর, ভৃগুর মতো ভগবানের বুকে পদাঘাত --উদ্যত, মানবধর্ম প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়সংকল্প, ধ্বংসের আবাহনে উচ্ছ্বসিত, সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় উদ্বেলিত। 

সৃষ্টিশীল পুরাণচেতনা ও ঐতিহ্যভাবনা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।  মানবতার জয়ের জন্য ,স্বাধীনতার অধিকার , সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিদ্রোহের সপক্ষে শক্তির সন্ধান করা। কবি লিখলেন '--

'' মহা -বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত /

আমি সেই দিন হব শান্ত ,

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল 

আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না 

অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ 

ভীম রণ ভূমে রণিবে না 

বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত। ''

  ১৯২২ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থ টি বাংলা কাব্যের জগতে নতুনত্ব সৃষ্টিকরে বিশেষ পালাবদল ঘটিয়েছিল। এই কাব্যগ্রন্থের মোট বারোটি কবিতা আছে । সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতা "প্রলয়োল্লাস, আগমনী,ধূমকেতু  খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্‌-আরব, বিদ্রোহী , কামাল পাশা।  আজ ও বাঙালি মননে বাংলা কবিতার ধারায় অগোচরে আলোড়ন তোলে। এছাড়া গ্রন্থটির সর্বাগ্রে বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ-কে উৎসর্গ করে লেখা একটি উৎসর্গ কবিতাও আছে। “বাঙলার অগ্নিযুগের আদি পুরোহিত সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু”। নিচে লেখা আছে “তোমার অগ্নি-পূজারী -হে- মহিমাম্বিত শিষ্য-কাজী নজরুল ইসলাম”। ‘অগ্নি-বীণা’ প্রচ্ছদপটের পরিকল্পনা করেছিলেন  অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এঁকেছিলেন তরুণ চিত্রশিল্পী বীরেশ্বর সেন। সেযুগে স্বাধীনতার পূজারী -ঋষি  অরবিন্দ ঘোষের ভ্রাতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষ বাংলা তথা ভারতের বিপ্লববাদী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ছিলেন। বিপ্লবে বিশ্বাসী নজরুল তাই নিজেকে বারীন্দ্রকুমারের ‘-হে-মহিমান্বিত শিষ্য’ বলে উল্লেখ করে তাকেই তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ টি  উৎসর্গ করেছিলেন।
 কথিত আছে '' নজরুল একরাতেই তার বিখ্যাত 'বিদ্রোহী' কবিতা লিখে শেষ করেছিলেন! অনেকেই বলেন ওয়াল্ট হুইটম্যানের 'সং অফ মাইসেলফ' কবিতা থেকেই তিনি এই কবিতা লেখার অনুপ্রেরনা পেয়েছিলেন। অনেকে আবার মনে করেন প্রথম  বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ-ইন্ডিয়ান আর্মির ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের কোয়ার্টারমাস্টার হাবিলদার হিসেবে চাকুরীর সুবাদে দেশি বিদেশি সৈন্যদের সাথে মেলামেশার প্রেক্ষিতেই গ্রীক আর ইন্ডিয়ান মিথের প্রতি তার গভীর অনুরাগ গড়ে ওঠে।এই কবিতার ছত্রে ছত্রে পৌরানিক রুপকের ব্যবহার এতোটাই যথার্থ যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। রূপকের প্রয়োগ দেখে যে কেউ আঁচ করতে পারবেন, গ্রীক আর ইন্ডিয়ান মিথের ওপর কবির কতোটা দখল ছিল। '' 
  বিদ্রোহী কবিতায় তার বিদ্রোহকে সঙ্গত কারণেই ‘আমি’ প্রতীকে ব্যঞ্জনাময় করেছেন এবং নিজেকে অজেয় বলে উপলব্ধি করেছেন। তাইতাে’ বিদ্রোহী আত্মশক্তিকে উদ্বোধিত করার লক্ষ্যে প্রথমেই কবির সরব ঘােষণা: ''‘বল বীর চির উন্নত মম শির !'' নজরুল এই কবিতার প্রথম স্তবকেই প্রসঙ্গত উত্থাপন করেছেন মহাবিশ্ব, মহাকাশ, চন্দ্রসূর্য, গ্রহতারা, ভূলােক দ্যুলােক, খােদার আসন, বিশ্ববিধাত্রী, চির বিস্ময়, রাজটীকা, রুদ্র ভগবান আর দীপ্ত জয়শ্রীর কথা।  ভারতীয় উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশ শাসনে ও শোষণে ক্ষতবিক্ষত।  মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। এমন একটি সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাসের জয়গান  কবিতাটির প্রতিটি চরণে ও স্তবকে স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়েছে । আত্মমুক্তির মাধ্যমে জগৎ ও জীবনকে স্বাধীনতার স্বাদ উপলব্ধি করানো যায়। কবিতাটিতে ১২১ বার 'আমি' শব্দ ব্যবহার করে কবি একটি কথারই প্রতিধ্বনি করতে চেয়েছেন যে, মানুষ অসম শক্তির অধিকারী। সাধনা ও সংগ্রামে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বপ্নের স্বাধীন দেশ নির্মাণ মানুষের পক্ষেই সম্ভব। 

 সাম্য, সত্য, সততা, অসাম্প্রদায়িকতা ও ন্যায়নির্ভর সমাজ প্রতিষ্ঠায় এ কবিতার অবদান বিশ্ববিশ্রুত। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে 'বিদ্রোহী' কবিতার শত বছরপূর্তি। কবিতাটি সৃষ্টির পর থেকে ১০০ বছর সমভাবে জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক থাকাটা রীতিমতো বিস্ময়কর! বাংলা ভাষার কবিতা হিসেবে আমরা গর্বিত যে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষায় রচিত কবিতাটি বিশ্বদরবারে সাংস্কৃতিক বিবেচনায় আজো বিশেষ ভাবে আজো সমধিক বিশেষ ভাবে আলোচনার দাবি রাখে।  

আত্মসচেতনতা সম্পন্ন কবির মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল অদম্য সাহস।  নিপীড়িত-নির্যাতিত, শোষিত-উপেক্ষিত বঞ্চিত মানুষের ব্যথা-বেদনামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার দাবিতে তিনি জেহাদ তোলেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। মানব সমাজের মঙ্গলে প্রতি দায়বদ্ধতায় তাঁর অন্তরাত্মার  অব্যক্ত ধ্বনি তাঁকে আলোড়িত করেছিল।  তাঁরই অগ্নিঝরা লেখনী ও জাতিকে জাগিয়ে তোলার চেতনার মধ্য দিয়ে তাঁর নামের সাথে বিদ্রোহী উপাধি যদিও যুক্ত হয়েছিল আদতে  তিনি ছিলেন প্রেমের পূজারী এক প্রেমিক কবি।  

১৯২২সালে ' তাঁর লেখা ' আনন্দময়ীর আগমন ' কবিতায়  রাজদ্রোহের স্পষ্ট  অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করে  ইংরেজ সরকার  তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে। তাঁর ওপর নির্মম অত্যাচার  চালাতে ও কুন্ঠিত হয় নি । এবং আলিপুর সেন্ট্রালজেলে তাঁকে সশ্রমকারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছিল।
 পরে হুগলি জেলে স্থানান্তরিত  করার পর বন্দিদের ওপর  অকথ্য  নির্মম অত্যাচার শুরু হলে আদালতে লিখিত রাজবন্দীর জবানবন্দী দিয়ে তিনি প্রায় একটানা চল্লিশ দিন  ও অনশন শুরু করে ইংরেজ সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। এর সমর্থনে নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ''বসন্ত ' গীতিকাব্য গ্রন্থ টি অনুজ প্রতিম কবি নজরুল কে উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা জানিয়ে ছিলেন।   

 
তাঁর ফরিয়াদ" কবিতায়

মানব প্রেমিক কবির জোরালো অভিযোগ  ও প্রতিবাদ গর্জে ওঠে  তাঁর ক্ষুরধার কলমের কালির আঁচড়ের দৃপ্ত ভঙ্গির লেখনীতে। বারেবারেই  তাঁর ফরিয়াদ" কবিতায়  ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ, শোষক-শোষিতের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক বৈষম্য তুলে ধরেছেন । কঠোর আঘাত করেছেন সমাজের  বৈষম্যমূলক কাঠামোতে । সমাজের বিভিন্ন অন্যায়, অবিচার, ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কবির অভিযোগ ও প্রতিবাদ স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে । এই কবিতায় তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা,অভাব-অভিযোগ তুলে ধরেছেন এবং তাদের প্রতি ঈশ্বরের সহানুভূতি ও সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন.। বিধাতার সৃষ্টি সুন্দর এই জগতে মানুষের কদর্য নিষ্ঠুরতা  হিংসা, লোভ স্বার্থপরতা পৃথিবীকে অসুন্দর করে তুলছে। বিভিন্ন স্তরের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অভিযোগ ফরিয়াদ কবিতার মূল সুর।ঈশ্বরের দরবারে  প্রতিকার  চেয়েছেন মরমী কবি। ঈশ্বরের এই মহাসৃষ্টিতে সকলের সমান অধিকার। কবি তাঁর হৃদয়ের আবেগ, আনন্দ, দুঃখ সব অনুভূতি দিয়ে সমাজের দুর্বল ও শোষিত মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সাহায্যের জন্য পরম পিতার কাছে নিবেদন করেছেন। তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্য ও ঈশ্বরের সৃষ্টিতে তাঁর গভীর ভালবাসার কথা বলেছেন।

 তিনি লিখলেন 
''এই ধরণীর ধূলি মাখা তব অসহায় সন্তান                                                                                             মাগে প্রতিকার ,উত্তর দাও ,আদি পিতা ভগবান !'' 
 আমার আঁখির দুখ -দীপ নিয়া  
বেড়াই তোমার সৃষ্টি ব্যাপিয়া ,    
যত টুকু হেরি বিস্ময়ে মরি,ভরে ওঠে সারা প্রাণ ! ''   

কবির "মানুষ" কবিতাটি ;----
                                 কবি তাঁর  "মানুষ" কবিতাটি তে বললেন  ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলের মধ্যে এক মানবীয় সত্তা বিদ্যমান।  সাম্যবাদী চেতনা এবং মানবপ্রেমের উপর ভিত্তি করে লেখা কবিতাটিতে কবি সচেতন করলেন , ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা:ধর্মের প্রতি মানুষের আবেগ ও বিশ্বাস থাকতে পারে, কিন্তু তা যেন অন্যদের প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণার সৃষ্টি না করে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলের মধ্যে এক মানবীয় সত্তা বিদ্যমান। কবিতাটি সেই সময়কার হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছিল। সকল মানুষকে কবি এক ও অভিন্ন মানব জাতি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলের প্রতি ভালবাসার কথা বলেছেন।  সকলের মধ্যে এক মানবীয় সত্তা বিদ্যমান, যা তাদেরকে একত্রিত করে.। কবি মনে করেন, সকল ধর্মের মানুষ যদি একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তবে সমাজে শান্তি ও ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হবে।  
    
''মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই ,নহে কিছু মহীয়ান !

 নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।–-
‘পূজারী, দুয়ার খোল,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো! "  

                                                                  ক্রমশঃ
(তথ্য সূত্র :-- ড : রফিকুল ইসলাম। (কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও কবিতা )
ড : করুণাময় গোস্বামী  (বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত নজরুল জীবনী )
অধ্যাপক আব্দুল মান্নান সৈয়দ (নজরুল জীবনী ) 
লেখক বিশ্বজিৎ ঘোষ (কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা। )

Post a Comment

0 Comments