জ্বলদর্চি

অদৃশ্য আলো | বাপন দেব লাড়ু


অদৃশ্য আলো | বাপন দেব লাড়ু 


পাড়ার গেট দিয়ে ঢুকলেই বাঁদিকে যে পুরোনো দোতলা বাড়িটা, সেখানেই থাকে মেঘলা আর তিথির পরিবার। মা বলেন, “এই বাড়িটার মতোই তোর দিদিকে লাগছে রে, একটু মলিন, একটু চুপচাপ... কিন্তু ভিতরে ভিতরে কত ইতিহাস, কত কথা!”

তিথি হাসে, “আর আমি বুঝি নতুন বাড়ি?”

মা আদুরে গলায় বলেন, “তুই তো আলোর মতো, ঘর আলোকিত করে রাখিস।”

তিথি ফর্সা, মসৃণ গায়ের রং, চিকচিকে চুল, চোখে ঝিলিক। আর মেঘলা, তার গায়ের রং শিউলি পাতার মতো গাঢ়, চোখে স্থিরতা, মুখে কম আলো। তবু কেমন যেন দৃষ্টিতে টানে। কিন্তু তা কেই বা আর দেখে?

ছোটোবেলা থেকেই তুলনাটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। স্কুলে একবার এক দিদিমণি বলেছিলেন, “তোর বোনটা কত সুন্দর, তুই এতো কালো কেনো রে?"

এরপরেও পাড়ার কিছু...

এরপরে থেকে আস্তে আস্তে মেঘলার আয়নার সামনে দাঁড়াতে কেমন লাগতো। এমনকি নতুন জামাকাপড়েও আগ্রহ ছিল না তার।
🍂


বাড়িতে যখনই কোনও সম্বন্ধ আসে, মা-বাবা নাম বলেন “বড় মেয়ের” কিন্তু পাত্রপক্ষ এসে তিথিকেই দেখে নেয়। মা হেসে বলেন, “তিথিকে না দেখলে মন ভরে না বাপু।”
মেঘলা টেবিলের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকে, ট্রে হাতে, মুখে হালকা হাসি, এখন এটা একটা অভ্যাসের পরিণত হাসি।

তিথি এসব বুঝে, কিন্তু তেমন পাত্তা দেয় না। সেও জানে, তার রূপ তাকে সুবিধা দেয়, প্রশংসা এনে দেয়। সে এভাবেই বাঁচতে শিখেছে।

একটা দিন, একটা বিকেল, হয়তো বদলে দেয় অনেক কিছুই। 

সেইদিন তিথির জন্য এক পাত্র আসে, বিদেশে থাকে। মায়ের উৎসাহ তুঙ্গে। কিন্তু পাত্র এসে অনেকটা সময় মেঘলার সঙ্গে কথা বলে। তার চোখে ছিল না কৌতূহল, ছিল মনোযোগ। পাত্র চলে যাওয়ার পর, ঘটক ফোন করে জানায়, পাত্র বলেছে “আমি ভুল করে তিথির জন্য এসেছিলাম বটে, কিন্তু মনে হচ্ছে মেঘলাই আমার সঙ্গী হোক।”

বাড়িতে যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে। মা স্তব্ধ, বাবা চুপ। ঠিক এই প্রথম অহংকার ভেঙে যাওয়ায় তিথির চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে যায়। সে বলল, “তুই কি আমার সম্বন্ধ ভেঙে দিলি? তুই এতদিন চুপ ছিলি কেন?”
মেঘলা সেদিন কোনও উত্তর দেয় না। শুধু নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়।

রাতে বাবার ডাক আসে। “তুই যদি চাস, আমি তোকে ঠেকাব না। কিন্তু তোর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, তুই চুপচাপ থাকলেও তোর ভিতর অনেক কিছুই চলে।”

মেঘলা ধীরে বলে, “বাবা, আমি ভাবতে পারি, বুঝি, কিন্তু আমি চাই না কেউ আমাকে করুণার চোখে দেখে বিয়ে করুক। আমি নিজেকে আগে নিজের মতো তৈরি করব। বাকি জীবন পরে ভাবা যাবে।”

সেই রাতে সে জানালায় বসে চাঁদ দেখে। চাঁদটা আজ বেশ অদ্ভুত লাগে তার কাছে, যেন নিজেই নিজের আলো তৈরি করে রেখেছে। হয়তো অন্ধকারের ভেতরেই তার আলো লুকিয়ে।

পরের দিন সকালে সিদ্ধান্ত নেয় মেঘলা বিয়ে না করার। 

এরপর কয়েক বছর কেটে যায়।

তিথির এখন বিয়ে হয়ে গেছে, মেয়ে হয়, সুখী সংসারের চাবিকাঠি। সে মাঝেমাঝে ফোনে বলে, “দিদি, তুই থাকলে বুঝতিস, সংসার চালানো কত কঠিন!”
মেঘলা হেসে বলে, “সব যুদ্ধ শুধু বাইরে হয় না, তিথি। অনেক সময় ভিতরেও যুদ্ধ চলতে থাকে অনেক।”

মেঘলা এখন এক স্বনির্ভর সংস্থার CEO। মেয়েদের আর্থিক ও মানসিক আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার কাজ করে সে। তার সংস্থা রূপের চেয়ে গুণ ও দক্ষতা নিয়ে কাজ করে। সে বলে, “আমরা মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের শত্রু হই কখনো কখনো, যখন অন্যকে দেখে নিজেদের ছোটো ভাবি। রঙ, গড়ন, উচ্চতা এসব বাইরের খোলস, ভিতরের আলো না থাকলে সবই ফাঁপা।”

একদিন জলদর্চি পত্রিকার এক প্রতিবেদক আসে তার সাক্ষাৎ নিতে।

প্রশ্ন করে, “আপনার জীবনে সবচেয়ে বড় বাধা কী ছিল?”

মেঘলা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
“আমার সবচেয়ে বড় বাধা ছিল আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে আপন করে নেওয়া। আমি বিশ্বাস করি, মেয়েদের সবচেয়ে বড় জয় তখনই হয়, যখন তারা নিজেকে নিজের চোখে ভালোবাসতে শেখে। আর তখনই সমাজেও সেই আলো ছড়ায়।”

Post a Comment

0 Comments