বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব - ১০১
গাঁদাফুল
ভাস্করব্রত পতি
'হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল
এনে দে এনে দে নৈলে রাঁধব না, বাঁধব না চুল।
কুস্মী রঙ শাড়ি, চুড়ি বেলোয়ারি
কিনে দে হাট থেকে, এনে দে মাঠ থেকে
গাঁদা ফুলের দৌলতে Valley of Flowers শিরোনামে ভূষিত কংসাবতীর বুকের দোকাণ্ডা গ্রাম
গাঁদাকে সংস্কৃতে কন্দুক, হিন্দিতে গোঁদা, গেণ্ডক, ওড়িয়াতে গেণ্ডু, পারসীতে গুলজফবি, ইংরেজিতে French Marygold, African Marygold, Calendula বলে। এর সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম হল 'মেরিগোল্ড'। যা কিনা ভার্জিন মেরির সম্মানে Mary's Gold থেকে দেওয়া। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের অভিমত, গাঁদার আদিনিবাস মেক্সিকোর গেন্ডামেরিতে। তাই হয়তো এর ইংরাজী নাম মেরীগোল্ড (সোনার মত রঙের জন্য হয়তো 'গোল্ড' হয়েছে)। অনেকে বলেন, 'গোণ্ডা' শব্দ থেকেই কি 'গাঁদা'র উৎপত্তি? যাইহোক, বাংলায় গাঁদা শব্দের উৎপত্তি এভাবে হয়েছে বলে মনে করা হয় -
গন্ধা> গেন্ধা> গেনদা> গাঁদা
এটি একটি গুল্মজাতীয় গাছ। মোটামুটি তিন ফুট পর্যন্ত উঁচ্চতা হয়। সারাবছরই চাষ হয়। চাষীদের কাছে এটি অন্যতম অর্থকরী ফুল। এদের পাতা বহুখণ্ডিত। প্রতিটি খণ্ডের প্রান্তদেশ করাতের মত। গাছে ও পাতায় সুক্ষন রোঁয়ার দেখা মেলে। ফুলের বীজ থেকে নতুন চারাগাছ জন্মায়। আবার এই গাছের কাণ্ডের পর্ব থেকে এবং মোটা ডাল থেকেও ছোট ছোট শিকড় গজাতে দেখা যায়। তখন ঐ ডাল কেটে জমিতে রোপণ করলে নতুন চারা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
গাঁদাফুল তোলার কাজ চলছে
বিভিন্ন ধরনের গাঁদাফুলের চাষ করতে দেখা যায় চাষীদের। দেশী গাঁদা, রক্ত গাঁদা, বড় গাঁদা, বাসন্তী গাঁদা, বিলাতি গাঁদা, হলুদ গাঁদা ইত্যাদি। গাঁদার কয়েকটি হাইব্রিড প্রজাতি হল গোল্ডস্মিথ, গিনি গোল্ড, হারমনি, ইনকা, ইয়েলা, মেরিয়েটা, লিজিয়ন অব অনার, ম্যান ইন দি মুন, সুপ্রিম ইত্যাদি। এই গাঁদা ফুলের পাঁপড়ির মধ্যে মেলে Quercetagetin, Quercetagetin 7 Glucoside এবং Carotenoids। আর সারা গাছে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের উপকারী তেল D-Limonene, Ocimene, 1-Linalyl Acetate, 1-Linalool, Tagetone এবং Nonanal (০.০৬%)।
গাঁদার ক্ষেত
Asteraceae পরিবারের অন্তর্গত গাঁদাগাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম Tagetes patula। এছাড়াও আরও যেসব প্রজাতির দেখা মেলে, তাদের মধ্যে অন্যতম হল -
Tagetes irecta (African Marigold, Aztec Marigold)
Tagetes lucida (Texas Tarragon এবং Mexican mint Marigold নামেও পরিচিত)
Tagetes filifolia
Tagetes tenuifolia
Tagetes minuta
Tagetes lacera
সারা পৃথিবীতে এই পরিবারের মোট কুড়িটি প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে ভারতেই মেলে পাঁচটি প্রজাতি।
মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন এলাকায় এর অবাধ বেড়ে ওঠা। মেক্সিকো হল গাঁদার পিতৃভূমি। মূলতঃ প্রাচীন অ্যাজটেক সভ্যতার মানুষজনের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল গাঁদা। চিকিৎসা, ধর্মীয় ভাবাবেগ এবং গৃহসজ্জার জন্য গাঁদার ব্যবহার ছিল বেশ। বিশেষ করে মৃতদেহ সৎকারের সময় এর গুরুত্ব বেড়ে যেত। ১৬ শতকে স্প্যানিশ ব্যবসায়ীরা এখন থেকে গাঁদার বিপণন শুরু করে ইউরোপে। তবে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা এই ফুলের আকর্ষণীয় রঙ, ব্যবহার এবং আকারের জন্য একে দ্রুত রপ্তানি শুরু করে বিভিন্ন দেশে। আর ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এর উজ্জ্বল হলুদ এবং গোলাপী রঙের গাঁদা ফুলের সাথে হিন্দু সংস্কৃতির মিল পায়। ফলে তাঁরা নিজেদের উৎসবের সাথে অচিরেই সম্পৃক্ত করে নেয়। বিশেষ করে দেওয়ালির সময় তা প্রথমে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। যদিও এর অনেক আগে থেকেই ভারতে Jhandu নামে একই রকম একপ্রকার ফুলের ব্যবহার বেশ প্রচলিত ছিল ভারতের বুকে।
প্রাচীন ভারতে সুশ্রুতের সূত্রস্থানের ৪১ তম অধ্যায়ে রয়েছে গাঁদার কথা-
'গেন্দুকং জন্দুগা প্রোস্তা তবকৈঃ পুষ্পগুফিতা।
স্ত্রীপুংকেশর সংযুক্তা গেন্দাখ্যাতা দেশান্তরে।
হরিৎপত্রযুতা রক্তস্তম্ভনে ব্যবহারিকা।
গুণৈঃ শীত কষায়াহি বিশদা পিচ্ছিলামতা।।'
অর্থাৎ সর্বত্র এই ফুলের নাম গেন্দা বা গাঁদা। শুদ্ধ ভাষায় এটি গেন্দুক এবং জন্দুগা নামে পরিচিত। এর সবুজ পাতার রস রক্তস্তম্ভনে ব্যবহৃত হয়। এটি শীতকষায়ধর্মী এবং বিশদ ও পিচ্ছিলধর্মী।
ইদানিং বিয়েবাড়ি, মন্দির, সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চ সহ যেকোনো অনুষ্ঠানের সাজসজ্জায় গাঁদা ফুলের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা গিয়েছে। উল্লেখ্য অযোধ্যার রামমন্দির উদ্বোধনের সময় পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া থেকে প্রচুর পরিমাণে গাঁদার মালা সরবরাহ করেছিল ফুল ব্যবসায়ীরা। যা এতদঞ্চলের গাঁদার চাষের এবং গাঁদার গুনমানকে প্রতিষ্ঠিত করে। মেক্সিকোতে কবরের ওপরে গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে সাজানো সেখানকার রীতিনীতি।
রাশি রাশি গাঁদা ফুলের বাগান
কেটে যাওয়া স্থানে গাঁদা গাছের রস লাগালে তৎক্ষণাৎ ঐ ক্ষতস্থান থেকে রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এখনও এই প্রাচীন প্রথাটি অনুসৃত হয় গ্রামাঞ্চলে। গাঁদাফুল চোখের বিবিধ রোগে, দুষ্টক্ষতে, রক্তের দোষ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। গাঁদাপাতার রস কিডনির রোগে, পেশীর ব্যথায় ও কানের ব্যথার উপশমে, চোখের বিভিন্ন রোগের নিরাময়ে এবং ফোঁড়া ও কারবাঙ্কলের যন্ত্রনা থেকে রেহাই পেতে কার্যকরী। রক্তপিত্ত (Haemoptysis), রক্ত আমাশয়, যক্ষা, নতুন ও পুরাতন পাঁচড়া, চোখ লাল ইত্যাদি রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও গাঁদা পাতার রস ভালোই সুফল দেয়।
অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় ক্রিকেটার ডেভিড ওয়ার্নার জনপ্রিয় হিন্দি গান 'গেন্দা ফুল' নিয়ে একটি টিকটক ভিডিও বানিয়েছিলেন একসময়। দারুন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই ভিডিও। যে বাংলা গানটি থেকে অন্যভাবে গাওয়ার পর বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল তা লিখেছিলেন জনপ্রিয় লোকশিল্পী রতন কাহার। গাঁদাফুল নিয়ে লেখা এই অসাধারণ লোকগানটি হল --
'বড়লোকের বেটি লো লম্বা লম্বা চুল
এমন মাথায় বেঁধে দেবো লাল গেন্দা ফুল
এমন মাথায় বেধে দেব লাল গেন্দা ফুল।'
0 Comments