জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে(সপ্তদশ পর্ব) /মলয় সরকার

মার্কেজের খোঁজে
(সপ্তদশ পর্ব)

মলয় সরকার
খনিতে ঢোকার প্রবেশপথ

আমরা এগোলাম গুটিগুটি পায়ে, একটা টানেলের আকৃতি পথ দিয়ে। প্রথমে খানিকটা পথ আমরা এগোলাম বেশ ভয়ে ভয়ে। ভয়ের কারণটা আর কিছুই নয়, একটা সঙ্গীহীন অবস্থায় গা ছমছমে অল্প আলোয় একটা অপরিচিত প্রায় জনশূন্য অবস্থার পরিবেশে হঠাৎ ঢুকলে যেমন হয় আর কি! সুড়ঙ্গের ভিতর জনসমাগমও খুব কম। কাজেই,কোনদিকে যাব, কত দূর যাব ইত্যাদি জানানোর লোকও খুব কম।তবু সাহস করে এগোলাম। ভিতরে রাস্তা বেশ চওড়া তবে মাথার উপরে ছাদ খুব নীচু।প্রথম দিকে মাথার উপর ছাদে ধাতব পাত দিয়ে মোড়া থাকলেও , একটু পরে আর তা দেখা গেল না। সেখানে শুধুই পাথর কাটা ছাদ ,মাঝে কোন স্তম্ভ বা কোন সাপোর্ট ছাড়াই। আর ক্রমশঃ একটা ঝাঁঝালো বিট লবণ বা রকসল্টের গন্ধ তীব্র হতে লাগল। হ্যাঁ , ঢোকার মুখেই একটা অডিও গাইড দিয়ে দিয়েছিল।আমরা দেখলাম, পায়ের নীচে জমির স্বাভাবিকতা ঢেকে তাকে বাঁধিয়ে ফেলা হয় নি। শুধু সুন্দর করে ঘষে, তার মোটামুটি (খুব বেশি নয়) মসৃণতা রাখা হয়েছে।
কিছু দূরে দূরে জ্বলছে, নীলাভ বা লালচে রঙের রহস্যময় কম ঊজ্বলতার আলো । তা পরিবেশটাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। কিছু দূর গিয়েই দেখলাম, রাস্তা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। কোনদিকে যাব , ধাঁধায় পড়লাম।তখন মনে পড়ল গলায় ঝুলছে আমাদের অডিও গাইড, যা এখানে ঢোকার সময়েই দেওয়া হয়েছিল। 
খনির ভিতরে ছোট একটি স্টেশনের চার্চ

এবার বলি, এখানকার কিছু কথা।
খ্রীঃ পূঃ পঞ্চম শতাব্দীতেই এখানে এই লবণ তোলার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং এটাই ছিল সেই সময়ের মানুষদের বা তখনকার মুইস্কাদের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। তখনকার দিনে স্পেন, সুইজারল্যাণ্ড, পোল্যাণ্ড ইত্যাদি লবণ উৎপাদনকারী দেশগুলির চেয়েও এখানে লবণ উৎপাদন অনেক বেশি হত ।মাটির ৬৬০ ফুট নীচে এই সমস্ত বিশাল কর্মকাণ্ড দারুণ এক চমকপ্রদ ব্যাপার।১৮০১ সালে আলেক্সাণ্ডার ভন হামবোল্ড এটি লক্ষ্য করে এর কথা লিখেছিলেন। এর ভিতরে রয়েছে, বেশ কয়েকটি চার্চ বা উপাসনাস্থল।সেগুলিকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা আছে অর্থাৎ যীশুর জন্ম,  জীবন ও মৃত্যু এই তিনটি ভাগে। এই চার্চগুলি রোমান ক্যাথলিক চার্চ। 
🍂


আসলে যে সমস্ত শ্রমিকরা এখানে কাজ করত, তাদের এখানে থাকতে হত। তাই তারা নিজেদের প্রয়োজনেই এখানে চার্চ বানিয়ে নিয়েছিল, কাজের মাঝেই উপাসনা করার জন্য।তা ছাড়া তারা তাদের সম্ভাব্য খনিজাত বিপদ, যেমন ধ্বসে পড়া, বিষাক্ত গ্যাস বেরোনো ইত্যাদির থেকেও পরিত্রাণের জন্য তারা ঈশ্বরের আরাধনা করত।
খনির ভিতরে লবণের দেওয়াল

প্রথমে , অর্থাৎ  ১৯৩২ সালে একটি ছোট চার্চ এই খনির ভিতর তৈরী হয়। ১৯৫০ সাল নাগাদ এটি আবার সংস্কার করে নতুন ভাবে বড় চার্চ করার ব্যবস্থা হয়। ১৯৯৫ সালে এটির আরও সংস্কার হয়। খনিকে কাজে লাগিয়ে এক নতুন ধরনের চার্চ তৈরী করার পরিকল্পনাটা সম্পূর্ণ নতুন।এর ভিতর থেকে মোট প্রায় ২৫০ হাজার টন রকসল্ট নিষ্কাশন করা হয়।এটিই সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ রকসল্টের জমায়েত।
এখানে “লস ৩৩” নামে(LOS 33) ২০১৫ সালে একটি ইংরাজী চলচ্চিত্রের শুটিং চলেছিল বেশ কিছুদিন, যাতে ৩৩ জন চিলির খনিশ্রমিকের ৬৯ দিন একটি সোনা ও তামার খনির ভিতরে , ধ্বসের ফলে আটকা পড়ে যাওয়ার কাহিনী ছিল।এটি আসলে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে চিলির একটি প্রকৃত খনি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল, যাতে উদ্ধারকারী দল ৬৯ দিন কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের উদ্ধার করে তাই চিত্রায়িত হয়েছিল।
এখানে ১৯৩২ এ যে ক্যাথেড্রালটি তৈরী হয়,সেটি প্রায় ৬০ বছর চালু ছিল। পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয় নিরাপত্তার কারণে।এর পর ১৯৯৫ তে যে চ্যাপেলটি নির্মিত হয়, তা- ই এখনও চলছে।
এই যে ক্যাথেড্রালের কথা বলছি, সবই যে, সাধারণতঃ আমরা যেমন দেখে থাকি, সেরকম কিছু নয়। এগুলি, ওই লবণের খনির ভিতরে লবণের দেওয়াল কেটে একটা উঁচু বেদীর উপর একটি বড় ক্রস করা আছে।ব্যস এটিই চার্চ।এই চার্চগুলি হল রোমান ক্যাথলিক চার্চ। সেগুলি সব লবণের দেওয়াল কাটা। তবে দু’ একটি রয়েছে, বেশ লম্বা উঁচু গুহা মত তৈরী করা হয়েছে। তার সামনেটাতে , ফাঁকা জায়গায়, অনেক বেঞ্চ পাতা রয়েছে, এছাড়া ছাদের সিলিং বা সামনে  ওই দেওয়াল কেটেই কিছু মূর্তি বা নক্সা কারুকাজ করা রয়েছে। এটুকুই।
খনির ভিতরে একটি বড় চার্চ

দুটি চ্যাপেল তো বেশ বড়, ও আকর্ষণীয়।সারা রাস্তায় দেওয়ালেও অনেক জায়গায় বেশ কিছু কারুকাজ রয়েছে।মাটিতেও অনেক জায়গায় খোদাই করা বেশ কিছু শিল্পকর্ম রয়েছে। সবটাই হাতে কাটা। একজায়গায় মাইকেল এঞ্জেলোর ‘দ্য ক্রিয়েশন অফ এডাম’ এর অনুকরণে একটি শিল্প দেখলাম যা কার্লোস এনরিক রড্রিগেজ এর করা। 
সারা রাস্তা ক্রমশঃ চলার পথে ধাপে ধাপে ধীরে ধীরে নামতে নামতে প্রায় ৬৪০ ফুট নেমে গেছে।
এক জায়গায় দেখলাম, ওরই মধ্যে একটা জায়গা প্রশস্ত করা ,সেখানে চা স্ন্যাক্সের দোকান ও রয়েছে।

এই জায়গাটিকে হেরিটেজ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।এই জায়গাটা যেহেতু মাটির অনেক নীচে, তাই বেশ ঠাণ্ডা।তবে এই যে একটা হালকা নীল লাল বেগুনী কম উজ্বল আলো দেওয়া আছে, তাতে জায়গাটার আকর্ষণ ও রহস্যময়তা বেশি হয়েছে। 

এই রকম একট গন্ধময় পরিবেশে ঘুরতে ঘুরতে আমরা খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। ধীরে ধীরে দেখতে দেখতে চলেছি। বেশ কয়েকদল ছাত্রছাত্রীকে দেখলাম, তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে এসেছে শিক্ষামূলক ভ্রমণে। শিক্ষকরা তাদের সমস্ত বুঝিয়ে দিচ্ছেন। খুব ভাল লাগল এটা দেখে। এই দৃশ্য আমরা অনেক জায়গায় দেখেছি।রাস্তা চলেছে খনির ভিতর ঘুরে ঘুরে, ক্রমশঃ নীচের দিকে।আসলে যেমন খনির লবণ কাটা হয়েছে, তেমনই আজকের রাস্তা। 
এখানে জায়গাটার ধর্মীয় গুরুত্ব তো আছেই, তার থেকেও বড় কথা এর ভাবনা ও কারিগরী। এত বড় লম্বা টানেল, যা মাটির এত নীচে রয়েছে, তার জন্য কোনও স্টীল রড, সিমেন্ট কিছুই ব্যবহার হয় নি। সম্পুর্ণই হিসাব করে কাটার উপরেই এটি রয়েছে।এখানে প্রতিদিন বহু মানুষ আসেন এটি দেখতে। রবিবারে তো প্রায় ৩-৪০০০ মানুষ এখানে আসেন।হিসাব বলছে, প্রতিমাসে প্রায় ৪০-৫০ হাজার দেশী ও বিদেশী পর্যটক এখানে আসেন।
এখানে মাঝে মাঝেই এক একটা থামার বা দেখার জায়গাকে বলা হয়েছে এক একটি স্টেশন।মোট আছে বাইশটি স্টেশন।সেখানে দর্শনার্থীকে থামতে বলা হয়েছে। এখানে মোট হাঁটার পথ প্রায় এক হাজার ফুট।
ধীরে ধীরে আমরা ২২ নম্বর স্টেশনে বা শেষ স্টেশনে এসে পৌঁছালাম।এখানে ফেরত দিতে হল আমাদের অডিও গাইডটি। অডিও গাইডটি অবশ্য রাস্তায় সাহায্য করেছিল, প্রত্যেক জায়গায় দর্শনীয় জিনিস সম্বন্ধে জানতে ও রাস্তার পরিচিতিতে। 
এখানে দেখলাম, একটা দোকান রয়েছে এবং অনেক মেমেন্টো বিক্রী হচ্ছে।তবে কিছুই কেনার ইচ্ছা হল না। সামনেই দেখি দাঁড়িয়ে রয়ে দু’ কামরার একটি মজাদার গাড়ি অনেকটা এমিউজমেন্ট পার্কে বাচ্চাদের টয় ট্রেন বা গাড়ির মত। নানা রঙ করা আর চিত্রবিচিত্র ভাবে আঁকা।সেই গাড়ি, যে দর্শকরা দর্শন শেষ করবেন, তাঁদের উপরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। একটি যাচ্ছে আবার একটি আসছে। আমরা পরের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ফিরলাম একটু পরেই, আবার বাইরে এলাম সেই ঊজ্বল জগতে। দূরে নীচে দেখা যাচ্ছে শহর, চারিদিকে গাছপালা-দূরের পাহাড় বড় সুন্দর লাগল।
এই জিপাকুরাতে গাব্রিয়েল মার্কেজ যদিও বহুদিন থাকেন নি, তবু এখানেই তৈরী হয়েছিল তাঁর ভবিষ্যতের ভিত্তি।তাঁর লেখকসত্ত্বা এখানেই প্রথম আত্মপ্রকাশ করে।এখানে তিনি শেষ করেছিলেন তাঁর উচ্চতর বিদ্যালয়ের শিক্ষা, যেটাকে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায় বলে বলা হয়েছে।এখানে তিনি একটি বৃত্তি পান Liceo Nacional de Varones নামে এবং এখানে তিনি তাঁর গ্র্যাজুয়েট হওয়া (১৯৪৬) পর্যন্ত কাটিয়েছিলেন। এখানেই তাঁর সাহিত্যের ভিত্তি তৈরী হয়েছিল।যে স্কুলে তিনি পড়েছিলেন, সেই স্কুল আজও চলছে।এই স্কুলে প্রায় ১৬০০র বেশি ছাত্র রয়েছে। এখানেই তৈরী হয়েছে একটি মিউজিয়াম। এখানে একটি সাংস্কৃতিক  কেন্দ্র আছে, যার নামকরণ করা হয়েছে, গাব্রিয়েল গার্সিয়ার মার্কেজের নামে।দেখা যায় সেই সব জায়গা, যেখানে তিনি হেঁটে চলে বেড়িয়েছেন, খেলা করেছেন, এমন কি ঘুমিয়েছেনও।তাঁর একটি মুর্তিও করা আছে, যেন তিনি ডেস্কে বসে আছেন।
আমাদের এই স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠে নি।
এই সেই খেলনা ট্রেন

এখানেই অপেক্ষা করছিল উইলিয়াম। আমাদের নিয়ে ওর গাড়ি এগিয়ে চলল, খনি এলাকা ছাড়িয়ে। ছেড়ে এলাম বটে তবে স্মৃতিতে ঊজ্বল করে গেঁথে নিয়ে এলাম সেই সব সুন্দর দৃশ্য ও খনির অভিজ্ঞতা।খনি দেখিনি তা নয়, লোহা, কয়লা, তামার খনি মাটির উপরে বা নীচে সবই দেখার অভিজ্ঞতা আছে, তবে এ অভিজ্ঞতার স্বাদ সম্পূর্ণই অন্য এবং আলাদা।
ক্রমশঃ-

বন্ধুরা, চলতে চলতে কখন যেন অনেক দূরেই এসে পড়েছি। তবে দেখার তো শেষ নেই।চলতে থাকি তাই পথের টানে। চলুন , সবার সাহায্য পেলে গল্পের টানে যাওয়া যায় অনেক দূর.. ।

Post a Comment

0 Comments