কাঠুরিয়ার জ্ঞানী মেয়ে
সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস
কথক- বিশ্বনাথ দাস, গ্ৰাম- ডুমুরিয়া, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম
অনেকদিন আগের কথা। কোনো এক রাজ্যে ছিল এক বিশাল জঙ্গল। সেই জঙ্গলের ভেতর একটি কুঁড়েঘরে বাস করত এক কাঠুরিয়া এবং তার একমাত্র মেয়ে মেঘনা। মেঘনা ছিল যেমন রূপবতী তেমনি বুদ্ধিমতী। কাঠুরিয়া জঙ্গলের কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাত। কাঠুরিয়ার বউ না থাকার জন্য তার মেয়েকে একা হাতে ঘরের সব কাজ করতে হত। কিন্তু ঘরের সব কাজ একা করলেও তার মেয়ে কোনো বিরক্তি প্রকাশ করত না।
কাঠুরিয়া তার মেয়েকে এত কাজ করতে দেখে বলত-“মা রে, তোর মা মারা যাওয়ার পর তোকে ঘরের সব কাজ করতে হয়। আমি জানি তোর অনেক কষ্ট হয়।”
তখন তার মেয়ে বলে-“না বাবা, আমার কোনো কষ্ট হয় না, কষ্ট তো হয় তোমার। সারাদিন জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কাঠ কেটে সেগুলো মাথায় করে বাজারে যেতে হয় বিক্রি করতে। আমি জানি তা যে ঘরের কাজ থেকে অনেক কষ্টের কাজ।”
🍂
কাঠুরিয়া বলে-“কিন্তু মা, এইসব কাজ তো মেয়েরা তার শ্বশুর বাড়িতে করে, বাপের বাড়িতে নয়। কিন্তু আমি এমনই এক পিতা যে তার মেয়েকে ঠিকমতো খাওয়াতে-পরাতেই পারে না। একটা ভালো ছেলে দেখে তোর বিয়ে দিতে পারলেই আমার শান্তি।”
তখন মেঘনা বলে-“না বাবা, আমার কোনো কষ্ট হয় না। আর হ্যাঁ আমি বিয়ে করব না। তোমাকে একা রেখে আমি কোথাও যাব না।”
কাঠুরিয়া বলে-“তা হয় না মা। মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছিস যখন শ্বশুর বাড়ি তো যেতেই হবে।”
তখন মেঘনা বলে-“আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে সে পরে দেখা যাবে।”
এইভাবে ভালো-মন্দ দু’ই মিশিয়ে কাঠুরিয়া ও তার মেয়ের দিন কাটতে থাকে।
একদিন কাঠুরিয়া প্রতিদিনের মতো কাঠ কাটতে জঙ্গলে যায়। জঙ্গলে কাঠ খুঁজতে খুঁজতে একটি মরা কাঠ পড়ে থাকতে দেখে সেই কাঠটি কাটতে থাকে। কিন্তু কাঠ কাটতে কাটতে কখন যে সূর্য ডুবে গেছে তা কাঠুরিয়া বুঝতে পারেনি।
কাঠ কাটার পর কাঠুরিয়া ভাবে-“আজ অনেক দেরি হয়ে গেল। কাঠ কাটতে কাটতে কখন যে সূর্য ডুবে গেছে বুঝতে পারিনি। জঙ্গলের চারিদিকে হিংস্র পশুর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে আস্ত বাড়ি ফিরে যেতে পারব না।”
এইসব ভেবে কাঠুরিয়া ভগবানকে ডাকতে থাকে। আর বলে-“ভগবান আজ যাতে ঠিকমতো বাড়ি ফিরে যেতে পারি। ওদিকে আমার মেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
এইভাবে কাঠুরিয়া একমনে ভগবানকে ডাকতে ডাকতে বাড়ির পথে রওনা হয়। রাস্তায় হঠাৎ তার সামনে বাঘ বেরিয়ে পড়ে। বাঘকে দেখে কাঠুরিয়া রীতিমতো ভয় পেয়ে যায়। কোনোমতে বাঘের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে। আর এদিকে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় সে বাড়ির রাস্তা হারিয়ে ফেলে।
তখন কাঠুরিয়া ভাবতে থাকে এখন সে কোথায় যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কাঠুরিয়া জঙ্গল থেকে একটু দূরে আলো দেখতে পায়।
সে বলে-“ওই তো দূরে আলো দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ওখানে কেউ আছে। আমি ওইখানেই যাই, আজকের রাতটা যদি ওখানে ঠাঁই পাই তাহলে আর কোনো ভয় নেই।” এই বলে কাঠুরিয়া এগিয়ে যায় ওই আলোর দিকে।
আর এদিকে কাঠুরিয়ার মেয়ে মেঘনা ভাবতে থাকে-“অনেক রাত হয়ে গেল, এখনো তো বাবা এল না। বাবা তো কোনো দিন এত রাত করে না! তাহলে বাবার কী কোনো বিপদ হলো? বাবার যদি কিছু হয় তাহলে আমার কী হবে, এই জঙ্গলে আমি একা থাকব কী করে?”
এইসব ভাবতে ভাবতে সে ভগবানকে ডাকতে থাকে তার বাবাকে রক্ষা করার জন্য।
এদিকে কাঠুরিয়া ওই আলোর কাছে পৌঁছে যায়। পৌঁছে দেখে সেখানে একটি পরিত্যক্ত রাজপ্রাসাদ। এই রাজপ্রাসাদ থেকেই আলো দেখা যাচ্ছিল।
কাঠুরিয়া বলে-“এ তো পরিত্যক্ত রাজপ্রাসাদ। তা যাই হোক প্রাণ বাঁচাতে হলে আজকের রাতটা এখানেই থাকতে হবে।”
এই বলে সে দরজা ধাক্কা দেয়। হঠাৎ দরজাটি আপনা আপনি খুলে যায়। কাঠুরিয়া ভাবে-“কাউকে তো এখানে দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে কী দরজাটি খোলাই ছিল? ভেতর থেকে তো আলো দেখতে পাচ্ছি, তাহলে নিশ্চয়ই কেউ আছে।”
এই ভেবে সে ভিতরে যায়। ভেতরে গিয়ে দেখে এক সাধুবাবা সেখানে বসে আছেন।
কাঠুরিয়া বলে-“এই পরিত্যক্ত রাজপ্রাসাদে কী শুধুই সাধুবাবা থাকেন? কারণ সাধুবাবা ছাড়া তো আর কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না।”
তখন সাধুবাবা বলেন-“হ্যাঁ বাছা, এখানে কেবল আমি থাকি।”
কাঠুরিয়া সাধুবাবাকে প্রণাম করে। সাধুবাবা বলেন-“তুমি কে বাছা, এত রাতে এখানে কী করছ?”
কাঠুরিয়া তখন সাধুবাবাকে সব কথা খুলে বলে। সব শুনে সাধুবাবা বলেন-“ঠিক আছে তাহলে আজকের রাতটা তুমি এখানে থাকতে পারো, কিন্তু একটা শর্তে।”
তখন কাঠুরিয়া বলে-“কী শর্ত সাধুবাবা?”
সাধু বলেন-“কাল সকালে এখান থেকে বাড়ি গিয়ে তুমি তোমার বাড়ির সামনে প্রথমেই যে জিনিসটা দেখবে সেটা আমাকে দিয়ে যাবে।”
তখন কাঠুরিয়া ভাবে-“বাড়ি গিয়ে আর কী দেখব। আমার ওই ভাঙা কুঁড়েঘর, নাহলে কিছু কাঠ, পাথর- আর কী।”
এই ভেবে সে সাধুবাবাকে বলে-“ঠিক আছে সাধুবাবা। আপনার শর্তে আমি রাজি।”
তখন সাধুবাবা বলেন-“ঠিক আছে, আজকের রাতটা তুমি এখানেই থাকো।”
এর পরের দিন সকালে কাঠুরিয়া রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়। বাড়িতে এসে বাড়ির দিকে তাকাতেই বাড়ির সামনে প্রথমেই সে তার মেয়েকে দেখতে পায়। মেঘনাকে দেখে কাঠুরিয়া কাঁদতে থাকে।
বাবাকে এভাবে কাঁদতে দেখে মেঘনা বলে-“কী হয়েছে বাবা, তুমি এভাবে কাঁদছ কেন?”
তখন কাঠুরিয়া তার মেয়েকে রাতে তার সঙ্গে যা যা ঘটেছে সব কথা বলে।
সব শুনে মেঘনা বলে-“বাবা তুমি যখন সাধুবাবাকে কথা দিয়েছ, তখন আমি তোমার কথার মর্যাদা রাখব। চল, এখুনি তুমি সাধুর কাছে চল।”
কাঠুরিয়া বলে-“কিন্তু মা…..।”
মেঘনা বলে-“কোনো কিন্তু নয় বাবা। তুমি আমাকে হারানোর ভয় করছ। ভয় পেও না বাবা। তিনি যদি সত্যি সাধু হয়ে থাকেন, তাহলে কোনোদিন তিনি আমার ক্ষতি করবেন না।”
কাঠুরিয়া তখন আর কিছু না বলে তার মেয়েকে নিয়ে সাধুর কাছে যায়।
সাধু তাদের দেখে বলেন-“তাহলে তুমি এসেছ।”
তখন কাঠুরিয়া বলে-“এসেছি বাবা। কিন্তু আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি। আপনার কথামতো বাড়ি গিয়ে প্রথমেই আমি যা দেখব তা আপনাকে দিতে হবে। আর আমি প্রথমেই আমার মেয়েকে দেখেছি। কিন্তু কোনোমতে আমি আমার একমাত্র মেয়েকে দিতে রাজি নই। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।”
তখন সাধুবাবা বলেন-“তা তো হয় না। তুমি আমাকে কথা দিয়েছ। যদি কথা না রাখ তাহলে তোমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। হয়তো তুমি তোমার মেয়েকে চিরতরে হারিয়েও ফেলতে পারো।”
তখন মেঘনা বলে-“না সাধুবাবা না, আমার বাবা যখন আপনাকে কথা দিয়েছে তখন আমি তাঁর কথা রাখব। আপনি বলুন আমাকে কী করতে হবে?”
সাধুবাবা বলেন-“তুমি অপরূপ সুন্দরী। কোনো রাজকুমার যদি তোমাকে দেখেন তাহলে তিনি তাঁর রাজ্যের বিনিময়ে হলেও তোমাকে বিয়ে করবেন। এখন তোমাকে তোমার রূপের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধির পরীক্ষাও দিতে হবে। তুমি যদি আমার তিনটি প্রশ্নের সঠিক জবাব দাও, তাহলে আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব। আর যদি না পারো তাহলে তোমাকে সারাজীবন আমার সেবিকা হয়ে থাকতে হবে।”
তখন কাঠুরিয়া বলে-“না সাধুবাবা আপনি আমার এই ছোটো মেয়েকে এভাবে শাস্তি দেবেন না।”
মেঘনা বলে-“না সাধুবাবা, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আপনি আমাকে প্রশ্ন করুন, আমি তার যথাযথ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।”
তখন সাধুবাবা বলেন-“আমার প্রথম প্রশ্ন- এই বিশাল পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কী?”
মেঘনা বলে-“সময়। সময় হল সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। যা একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না।”
সাধুবাবা বলেন-“বাঃ! অতি উত্তম। তোমার উত্তরটি সঠিক হয়েছে। এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন- সবচেয়ে শক্তিশালী জিনিস কোনটি?”
তখন মেঘনা বলে-“ভালোবাসা। কারণ ভালোবাসা ঘৃণা আর বিদ্বেষকে জয় করতে পারে।”
সাধুবাবা বলেন-“ বা বা বা। সঠিক উত্তর দিয়েছ তুমি। এবার শেষ প্রশ্ন-“কোন জিনিস মানুষকে সুখ ও তৃপ্তি দেয়?”
মেঘনা বলে-“অন্যের মুখে হাসি ফোটানো। কারণ অন্যের মুখে হাসি ফুটিয়ে যে সুখ আর তৃপ্তি পাওয়া যায় তার আর কোনো কিছুতেই পাওয়া যায় না।”
তিনটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার পরই সেই পরিত্যক্ত রাজপ্রাসাদ এক উজ্জ্বল সুন্দর রাজপ্রাসাদে পরিণত হয়। আর সাধুবাবা পরিণত হন রাজকুমারে।
এইসব দেখে কাঠুরিয়া ও তার মেয়ে মেঘনা অবাক হয়ে যায়। তারা কিছুই বুঝতে পারে না।
মেঘনা বলে-“এ কী, এইসব কী হচ্ছে? আপনি কী তাহলে সাধুবাবা নন?”
তখন রাজকুমার বলেন-“না আমি কোনো সাধুবাবা নই। আমি এ রাজ্যের রাজকুমার। এতদিন এক জাদুকরের জাদুর জন্য আমি সাধু হয়েছিলাম আর আমার রাজ্যের প্রজারা সব অদৃশ্য হয়ে ছিল। তোমাকে জিজ্ঞাসা করা তিনটি প্রশ্নের সঠিক উত্তরের জন্য আমরা জাদুকরের জাদু থেকে মুক্তি পেলাম। আমার রাজ্য থেকে সব খারাপ শক্তি দূর হয়ে গেছে। তুমি প্রমাণ করে দিয়েছে যে তুমি শুধু রূপবতী নও তার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিমতীও। তুমি চাইলে আমার রাণী হয়ে থাকতে পারো।”
কিন্তু কাঠুরিয়া বলে-“তা হয় না রাজকুমার। আপনি হলেন এ রাজ্যের রাজকুমার। আর আমার মেয়ে হল এক সামান্য কাঠুরিয়ার মেয়ে। আপনার সাথে আমাদের কী যায়?”
তখন রাজকুমার বলেন-“এ কী বলছেন আপনি। আপনার মেয়ের মধ্যে যা গুণ আছে তা হয়তো অনেক রাজকুমারীর মধ্যেও নেই। আর আমার কাছে কোনো ধনী গরীবের ভেদাভেদ নেই। তাছাড়া আপনার মেয়ের জন্য আমরা মুক্ত হতে পেরেছি, তাই আমি চাই আপনার মেয়ে এই রাজ্যের রাণী হয়ে থাকুক।”
0 Comments