জ্বলদর্চি

স্মৃতিপটে ভূপাল ভ্রমণ /রাজকুমার সরকার

স্মৃতিপটে ভূপাল ভ্রমণ 

রাজকুমার সরকার 

আজ থেকে ২৭ বছর আগের কথা।তখন আমি কলেজের পাঠ চুকিয়ে চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় ফর্ম ভরতে শুরু করেছি।একদিন হঠাৎই একটি কল লেটার এসে হাজির।পিওন দিয়ে গেল।এসেছে  ভূপাল থেকে। রেলের চাকরি।বাবা বললেন-অনেক দূর  যদিও তবে চেষ্টা করা দরকার। ভূপাল মানে মধ্যপ্রদেশ। অনেক দূর।আমার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছা ছিল  না যাওয়ার। তবে বাবা কষ্ট পাবেন  সেকথা  ভেবেই  রাজী হলাম  ভূপাল যাওয়ার জন্য। তখন বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। বাবা বললেন চল,আমি চাপিয়ে দিয়ে আসি ট্রেনে।ধানবাদে।মনে পড়ে আজও সেদিনের কথা।ছোটআমবোনা রেলস্টেশনে সন্ধ্যের ট্রেন ধরে ধানবাদ পৌঁছলাম। সেখানে টিকিট কেটে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম বোম্বে মেল- এর।রাত্রে ট্রেনটি ছিল রাত ন'টা-দশটার মাঝেই। ইঞ্জিনের পরে দুটি জেনারেল বগি এবং গার্ড সাহেবের কামরার আগে দুটি বগি পেছন দিকে জেনারেল। আমার  টিকিট  জেনারেল।রিজার্ভেশন নেই।আমাকে জেনারেল বগিতে যেতে হবে তখন আমার মানসিক অবস্থা কেমন বুঝতেই পারছেন?
প্রস্রাব পায়খানাটাই তো বেশি ঝামেলার।ধানবাদে ট্রেন  ঢুকতেই  মাথাটি খারাপ  হয়ে গেল।ভাবলাম  না, একদম যাব না । এভাবে যাওয়া যায় নাকি?ছাগল কুকুরের মত.....?
বীভৎস ভিড়।পা ফেলার জায়গা নেই। প্রতিটি সিট-এ লোক এমনকি নিচে লোক বসে আছে।আর শুধু নিচেই লোক বসে আছে তা নয় একদম পায়খানার দরজাটি পর্যন্ত লোক বসে।তার মানে আপনার  হঠাৎ পায়খানা লাগলে আপনি ওখানে যেতেই  পারবেন না।এমতাবস্থায় সফর;অবস্থা সকলের অনুমেয়.... 
পেছন দিকের জেনারেল বগিতে যাচ্ছি।কয়েকটা স্টেশন পার হওয়ার পর বুঝেই নিলাম যে যাচ্ছি; যেতেই  হবে।তারপর আবার একবার  ভাবলাম, নেমে পড়বো নাকি?
এরকম দ্বিধা- দ্বন্দের মাঝেই ট্রেন চলতে লাগলো।নানারকম  ভাবতে ভাবতে দু চারটি স্টেশন পার হয়ে গেল।কি কষ্ট কি যন্ত্রণা সেদিন হয়েছিল আমার  তা একমাত্র ঈশ্বর জানেন। বাবাও খানিকটা  চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তখন হাতে মোবাইল ফোনও ছিল না এখন ভাবলেই কেমন লাগে....
পুরো রাতভর ট্রেন চলতে লাগলো।আমি বিশেষ ক্ষেত্রে পায়খানা ও প্রস্রাব  বন্ধ  রাখার কৌশল জানি।ইমার্জেন্সিতে তা ব্যবহার করতে হয়।ট্রেনে একজনের  সাথে কথা বলছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম- আপনি কোথায় যাবেন?
কোথায় বাড়ি?
তিনি বললেন- আমি নাগপুর যাচ্ছি।আমার সেন্টার পড়েছে নাগপুরে।
বাড়ি কোলকাতায়।
আমি বললাম - কোলকাতার কোথায় থাকেন?
তখন সে জানালো কোলকাতা ঠিক নয়; আসানসোল। আমি দেখলাম আমাদের কাছাকাছি এলাকার লোক। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,আসানসোলের কোথায় থাকেন?
তখন সে জানালো- বার্নপুর। আমি তখন আরও আনন্দিত হলাম কেননা একসময় বার্নপুর খুব  যেতাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম- বার্নপুরে কোথায় থাকেন ?
সে বললো- সাঁতা বস্তি জানেন?
আমি বললাম-হ্যাঁ।খুব ভালোভাবে।রাস্তায় এভাবেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল এবং স্বাভাবিকভাবেই  ভালো লাগতে শুরু করলো।অনেক স্টেশন পার হয়ে গেল।এখন ঠিক  মনে নেই। তবে মোগলসরাই নামটি খুব মনে আছে কেননা ট্রেনটি সেখানে অনেকক্ষন থেমেছিল।সেখানে ইঞ্জিন চেঞ্জ হয়।মোগলসরাই থেকে ছেড়ে ট্রেন ছুটতে লাগলো আপনগতিতে।ভূপাল যাওয়ার সময় একটা স্টেশন পড়ে, নাম -মেইহর।
এই  মেইহর-এ পাহাড়ের উপরে বিখ্যাত একটি সরস্বতী মন্দির  আছে।স্টেশনে নেমে ডানদিকের রাস্তা ধরে যেতে হয়।পাহাড়ের  উপরে যেতে হয়।ট্রেন  থেকেও পাহাড়ের  উপর  মন্দিরটি দেখা যায়।ডানদিকে জানলার ধার থেকে দেখতে পেলাম।লোকমুখে শুনলাম চারশ'টি/ পাঁচশ'টি সিঁড়ি আছে।এতগুলো সিঁড়ি ভেঙে যেতে হয় মেইহর-এর বিখ্যাত সরস্বতী মন্দির।
আমি যেখানেই  যাই স্থানীয় মানুষের  সাথে খুব বেশি কথা বলি তার একমাত্র কারণ অনেক তথ্য  পেয়ে যাই বা উঠে আসে।নিজের চোখে দেখা এবং স্থানীয়দের কাছে শোনা হয়ে গেলে কলম স্বাভাবিকভাবেই  নিজের  গতি বাড়িয়ে দেয়। হ্যাঁ, ভ্রমণের এটাই  আসল রঙ, রস।যাই  হোক,ট্রেন  ছুটছে আর আমার  চোখ এদিক ওদিক ঘুরছে মানে জানালার ধারে ডানদিক কখনও বামদিকে আর কাগজ কলম আমার  সাথেই  থাকে।স্টেশনগুলির নাম একের পর এক লিখেই চলেছি।ট্রেন থামলেই এদিক  ওদিক চেয়ে দেখছি কোন স্টেশন এলো।রেলের হলুদ  রঙের  বোর্ড  যখন ঠিকঠাক দেখতে পারছি না তখন কাউকে জিজ্ঞেস করছি এটা কোন স্টেশন???
এভাবেই  লেখার  রসদ পেয়ে যাচ্ছি।যতদূর  মনে পড়ে মির্জাপুর, সতনা[সাতনা],কটনী [কাটনি],জব্বলপুর,
পিপারিয়া, ইটারসী।এগুলোই যাত্রাপথে মুখ্য মুখ্য স্টেশন। আগেই  জেনেছিলাম  ভূপাল যেতে হলে আমাকে ইটারসি স্টেশনে নামতে হবে।সেখান  থেকে বাস বা ট্রেনে যেতে হয় ভূপাল।
🍂
ad

এখানে বলে রাখি-পাঁচমারি একটি দেখার জায়গা।ট্রেনে পাঁচমারি যেতে হলে পিপারিয়া'তে নামতে হবে।পিপারিয়া থেকে বাসে ৪৫ কিলোমিটার দূরে পাঁচমারি।হাওড়া-মুম্বাই মেল পিপারিয়া হয়ে যায়।পাঁচমারি নাম কিভাবে হোলো একটু জানার চেষ্টা করি।জানা গেল পর্বতের  পাঁচটি গুহা।প্রবাদ আছে পঞ্চপাণ্ডব  অজ্ঞাতবাসের সময় কিছুদিন এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা এখানে পাঁচ  ভাই পাঁচটি গুহায় বাস করতেন। আবার কেউ  কেউ  বলেন  গুহাগুলি আসলে বৌদ্ধগুহা।সে যাই হোক এটি সাতপুরা পর্বতশ্রেণীর  একটি মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য  সম্বলিত  শৈলনিবাস।এই এলাকার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ।এখানে অনেকগুলো জলপ্রপাত রয়েছে।পথ চলতে চলতে বন্য জন্তুর দেখা পাওয়া যায়।পাঁচমারিতে আরও কিছু দ্রষ্টব্যস্থল রয়েছে যেমন  মহাদেব গুহার শিব।এখানে শিবরাত্রিতে বিরাট মেলা হয়।পার্বতী গুহা,বী ফলস্ (যাকে যমুনা জলপ্রপাতও বলে অনেকে) জটাশঙ্কর গুহা।এখানকার পাথর জটার রূপ  ধারণ করেছে বলেই এরকম নাম। ধূপগড়, এখান থেকে সুর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই  ভালো লাগবে যে কোনো পর্যটকের।লিটল্ ফলস্, বিগ ফলস্ ,ডাকেন ফলস্ নামে ছোট বড় অনেক  ফলস্ রয়েছে এখানে।পাহাড় পর্বত সবুজ অরণ্য যে কোনো পর্যটককে বার বার আকর্ষণ  করবে তাতে কোনো সন্দেহ  নেই.....
সাতপুরা জাতীয় উদ্যান ঘুরে আসতে পারেন। ৫২৫ বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে এই উদ্যান। বাঘ, বাইসন, হাতি, ভালুক, চিতলহরিণ, বুনো শূয়োরের  মুখোমুখি হতে পারেন।
জব্বলপুরের কথা না বললে মনে হয় মধ্যপ্রদেশের নিয়ে সঠিক বলা হোলো না।ভূপাল যদিও  রাজধানী শহর তবুও  জব্বলপুর কোনো অংশে কম নয়।এটি শিল্পকেন্দ্র ও উল্লেখযোগ্য  পর্যটন কেন্দ্রও বটে।জব্বলপুরে অনেকের আসা যাওয়া।
এতক্ষণ  বিভিন্ন  তথ্যের ভিত্তিতে লিখে ফেললাম ঝড়ের মত।আমি এখনও ট্রেনে।ভোরবেলায় নামলাম  ইটারসি স্টেশনে।তারপর  নেমেই  খোঁজখবর নিলাম সামনে কোনো নদী আছে কিনা।ঈশ্বর  সহায় অনতিদূরেই এক নদী।সকালের  কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে স্টেশন সংলগ্ন বাস স্টপে এসে গেলাম। মধ্যপ্রদেশ  রাজ্য সরকারের বাস ছাড়াই ভূপাল এর উদ্দেশ্যে।চেপে পড়লাম টিকিট কেটে।সম্পূর্ণ অচেনা অজানা জায়গা।কেউ ধারে কাছে পরিচিত নেই। স্বাভাবিকভাবেই গা  ছমছম।অতি সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।বাড়ি অনেক দূর।
বাস ভূপালে এসে পৌঁছালো।তারপর  একটু ঠিকানা খোঁজার জন্য ব্যস্ত  হয়ে পড়লাম। আশ্চর্য কোনো হোটেলে জায়গা নেই। সব হোটেলে ভর্তি।প্রায় পাগলের মত অবস্থা আমার। শরীরে বিরাট ধকল গেছে।একটু স্নান  ও বিশ্রামের খুব প্রয়োজন। এভাবে তো থাকা যায় না।শনিবার। আজ বিশ্রাম নেবো।আগামীকাল রবিবার পরীক্ষা।খোঁজ  নিতে নিতে হামিদিয়া রোডে একটি হোটেল পেলাম। গ্র্যান্ড হোটেল।কত লাগবে একদিনের  ভাঁড়া?
পঁচাত্তর টাকা এবং চার টাকা এল. টি. বললো মানে লাগ্জুরিয়াস ট্যাক্স।একটি রুম, এটাচ বাথ,বালকনি।টি  ভি. আছে রুমটিতে।জীবন এলো।আমার অবস্থান  মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভূপালে।
পরের দিন  রবিবার। হোটেলের এক কর্মচারী বললো আপনি সিটি সার্ভিস বাসগুলোতে চেপে যাবেন ঠিক ওরা নামিয়ে দেবে আপনাকে যথাস্থানে।এভাবেই  গেলাম। এবং পরীক্ষা দিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে হোটেলে ফিরে এলাম। পরের দিন  সকালে বাড়ি ফেরার  পালা।বাস ধরে ইটারসি এলাম। আসার সময় কোন ট্রেনে এসেছিলাম ঠিক  মনে করতে পারছি না।

Post a Comment

0 Comments