কমলিকা ভট্টাচার্য
সকালবেলায় ঘুম ভেঙে কল্যাণীদেবী দেখলেন, মধুবাবু বিছানায় নেই। তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে দেখলেন, বসার ঘরেও নেই, ডাইনিং রুমেও নেই। মধুবাবু স্টাডি রুমে টেবিলের উপরে এক গাদা কাগজপত্র ছড়িয়ে কী যেন করছেন।
কল্যাণীদেবী এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
— “সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এইসব কাগজপত্র নিয়ে কী করছো?”
মধুবাবু বললেন,
— “আজ বিকেলের ফ্লাইটে আমাকে আহমেদাবাদ যেতে হবে একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজে।”
কল্যাণীদেবী বললেন,
— “আহমেদাবাদ যেতে হবে তো ইন্সুরেন্স কাগজ নিয়ে কী করছো? তাও এত সকালে মুখ-হাত না ধুয়ে?”
মধুবাবু শান্তভাবে বললেন,
— “ফ্লাইটে যাব... কোন ভরসা নেই ফেরার। তাই কাগজপত্রগুলো তোমাকে বুঝিয়ে দিই। এদিকে এসো।”
সকাল সকাল এইরকম কথা শুনে কল্যাণীদেবী খুব খুশি হয়ে জবাব দেবেন, এমন আশা করাই অন্যায়। তিনি বললেন,
— “আর আমাকে কত জ্বালাবে? নিজের মাথাটা তো খেয়েছো, এবার আমারটাও খাবে?”
মধুবাবু মনে মনে ভাবলেন, তিনি যা করছেন, তা তো কল্যাণীর ভালোর জন্যই করছেন। তাই কাগজগুলো ভালো করে সাজিয়ে হাতের কাছে রাখলেন। তবে এই বিষয়ে দ্বিতীয়বার কল্যাণীদেবীকে কিছু বলার সাহস করলেন না। বরং ভালোবাসার কথা না-না অছিলায় ঘুরিয়ে বললেন। যেমন কল্যাণীদেবী খাবারের কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন,
— “ভালোবেসে যা খাওয়াবে, তাই খাবো।”
জামা কাপড় কী নেবে জিজ্ঞাসা করলে বললেন,
— “তুমি ছাড়া আর কে আর আমাকে দেখে গায় বলো তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সেকি মোর অপরাধ।”
কল্যাণীদেবী বললেন,
— “অনেক হয়েছে। এবার জিনিসগুলো গুছিয়ে নাও।”
রাত ৯টা নাগাদ বাড়ি থেকে মধুবাবু এয়ারপোর্টের জন্য রওনা হলেন।
এয়ারপোর্টে প্রথমেই আধার কার্ড স্ক্যান হলো না কিছুতেই। অগত্যা লাইনে দাঁড়াতে হলো। সেখানেই সমস্যা। পেছনে দাঁড়ানো একটি মেয়ে বারবার তার মাথায় চাটি মারছে।
পিছনে ফিরে তাকালেই সে বলে,
— “সরি আঙ্কেল!”
দু-বার, তিন-বার এভাবে হওয়ার পর তিনি ঠিক করে ঘুরে দাঁড়াতেই মেয়েটি বলল,
— “সেলফি তুলছিলাম, তাই লেগে গেছে!”
মধুবাবু ভাবলেন, “এয়ারপোর্টটা কি সেলফি তোলার জায়গা?”
ছুঁড়ি থেকে বুড়ি—যে যেখানে পারছে চলতে চলতে থেমে গিয়ে ফটো তুলতে ব্যস্ত। এই একটু আগেই এক মহিলা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তেই মধুবাবুকে এমন ব্রেক নিতে হলো যে, গাড়ির মতোই সব ব্যাগ উল্টে পড়ল। মহিলা হেসে বললেন,
— “সরি! সেলফি নিচ্ছিলাম। আপনাকে বাক্সগুলো তুলতে হেল্প করি।”
যতই হোক, মধুবাবুও পুরুষ মানুষ। একজন মহিলা এসে সরি বলছে—তখন আর গালি দেওয়া কি শোভা পায়? তবে এখানে যদি কোনো পুরুষ থাকতো, নিশ্চয়ই একটা ছোটখাটো বাকবিতণ্ডা হতো। নিজের আধার কার্ডে বাবার নামটা দেখতে হত।
মধুবাবু টিকিট কেটেছেন ইকোনমি ক্লাসে। বিজনেস ক্লাস পেরিয়ে ইকোনমিতে যাওয়ার সময় এক মহিলার অতিরিক্ত মেকআপ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মাঝবয়সী মহিলা, খাতে পেতে ঘরকি লাগতে হ্যায়। চোখের উপর আর গাল ভরে চকমক করছে গুলাবি আবির, আর ঠোঁটে কাঠ-পোড়া রঙ।
মধুবাবুর হোলির দিন মনে পড়ে গেল।
মনে মনে ভাবলেন, “ভদ্রমহিলা খুবই সঞ্চয়ী হোলির রঙের ঠিক ব্যবহার করেছে ! "
তারপর মধুবাবু নিজের সিটে গিয়ে বসলেন। তিনজন বসার সিটে ধারেরটি তার, মাঝের সিট আর জানলার ধারেরটি তখনও খালি।
মনের ভেতরে নানা রকম চিন্তা— যতক্ষণ না প্লেন টেক অফ ল্যান্ডিং হচ্ছে সুস্থভাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মধুবাবুর চিন্তার শেষ নেই।
ভালো করে চারদিকে তাকাচ্ছেন। সামনের সিটে এক বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন। হঠাৎ করেই ১৪-১৫ বছরের একটি ছেলে, সঙ্গে তার বাবা, এসে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে বলতে লাগল,
— “উঠুন! এটা আমার সিট।”
আর বৃদ্ধ বলছেন,
— “আমার ছেলে বলেছে, এখানেই বসতে হবে। ১৬ নাম্বার বলেছে।”
তাকে যত বোঝানো হচ্ছে— “১৬ নম্বর মানে কী? A, B, C, D?”—সে ততই বলে,
— “আমার ছেলে বলেছে, ১৬ নম্বরে।”
এদিকে বাচ্চা ছেলেটির কথার ধরন সাজ পোশাক ,চোখে প্লেনের ভিতরেও সানগ্লাস, দেখে মধুবাবু তো হাঁ।
ছেলেটি এরপর সোজা চলে গেল বিজনেস ক্লাসে। কিছুক্ষনেই ফিরে এলো সেই অতিরিক্ত মেকআপধারী মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে।
মহিলার মুখে এখন এক অদ্ভুত রাগ—মধুবাবুর রামায়ণ সিরিয়ালের সীতার আশেপাশে পাহারারত তাদের কথা মনে পড়ে গেল।
এতক্ষণ ধরে যা করা সম্ভব হয়নি ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়াতেই সেটা খুব সহজেই হয়ে গেল ,যা ঘটল সেটা মধুবাবুর বোঝার বাইরে, বৃদ্ধ ভদ্রলোক উঠে নিজের সিটে বসলেন,বাচ্চা ছেলেটি জানলার ধারে সিটে বসে বলল,
— “লাভ ইউ মম্!”
মহিলার রাগভরা মুখখানি যেন আচমকাই পাল্টে গেল হয়ে উঠল স্নেহময়ী মা, কিন্তু তার এই অতিরিক্ত স্নেহ ছেলেটির মাথা আর ভবিষ্যত যে কিভাবে চিবিয়ে খাচ্ছে সেটা ভেবে শোক করার আগেই মধুবাবুর চোখ পড়ল সাইডে দাঁড়ানো ছেলেটির বাবার ওপর, মহিলার এক বিদ্যুৎ ঝলকের দৃষ্টি ভদ্রলোককে বসিয়ে দিল।
মধুবাবু কল্যাণীদেবীর মুখ ঝমটার কথা মনে করে, নিজের বেটার অবস্থানের কথা ভেবে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
ভদ্রমহিলা গজগজ করতে করতে বিজনেস ক্লাসে চলে গেলেন।
মধুবাবু বুঝে গেলেন—তিনজনেই এক ফ্যামিলি, কিন্তু ভদ্রমহিলা বিজনেস ক্লাস আর বাপ-ছেলে ইকোনমি ক্লাস—হিসেবটা মিলছে না!
মেলাতে মেলাতেই পাশের হিসেব শুরু হল।
একটি মেয়ে এসে বলল,
— “আঙ্কেল, জানালার পাশটা আমার। একটু উঠে দাঁড়াবেন? আমি ঢুকে যাই।”
মধুবাবু উঠলেন। মেয়েটি বসেই মোবাইল বের করে দু-চারখানা সেলফি তুলে কাকে কাকে না পাঠাল! তারপর ব্লুটুথ কানে নিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি।
ঠিক তখনই প্লেনের শেষ প্যাসেঞ্জারটি উঠলেন, বছর সাতাশ-আটাশের একটি ছেলে, আর মধুবাবুর পাশের সিটে এসে বসল।
ছেলেটি নিজের ব্যাগ থেকে একটা স্প্রে বার করে মাথা, বগল, ঘাড়ে লাগিয়ে বলল,
— “আঙ্কেল, লাগাবেন নাকি?”
মধুবাবু হেসে বললেন,
— “না না, ভাবছিলাম—স্প্রে তো হ্যান্ড লাগেজে অ্যালাউড নয়!”
ছেলেটি হেসে জানালার ধারে বসা মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
— “সব ব্যবস্থা রাখতে হয়, আঙ্কেল!”
মধুবাবুর ফ্লাইটভীতি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল!
ছেলেটি মোবাইল বার করে ফোন করল তার মাকে—
— “মম্ অস্ট্রেলিয়া জানেকা বাত থা না? ও আজ ফাইনাল হো গেয়া! নেক্সট নেক্সট মান্থ জানা হ্যায়!”
মা যেন আকাশ থেকে পড়লেন—
— “অস্ট্রেলিয়া জানা? কব হুয়া? তুঝে তো পাটনা জানা থা না।”
ছেলেটি একবার মেয়েটির ও মধুবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল—
— “মাম্মি! তুমহে কুছ ভি ইয়াদ নেহি রহতা!”
মধুবাবু একবার মেয়েটির দিকে তাকালেন—সে হাসছে।
মধুবাবুও আর না হেসে পারলেন না।
মনে মনে বললেন—
“ম্যাম্মিকো ক্যা পাতা—ইধার তুম লড়কি কো ইমপ্রেস করনে মে লাগা হুয়া হো!”
Take-off এর ঘোষণা শুরু হয়ে গেছে।
সবাই ফোনে বাড়ির লোকজনকে বাই বাই করছে—এই যাত্রা যদি শেষ যাত্রা হয়, কে জানে!
মধুবাবুও ভাবলেন—কল্যাণীকে ছোট্ট করে একটা ফোন করে ফ্লাইং কিসই যদি দেন, যেমন সবাই দিচ্ছে, ঠিক তখনই যেন কানে ভেসে এলো,
— “বুড়ো বয়সে আদিখ্যেতা দেখলে বাঁচি না!”
যেই টেক অফ হবে, ঠিক সেই সময় একজন উঠে পড়লেন, আর টয়লেটের দিকে চললেন।
এয়ার হোস্টেস বলছেন,
— “স্যার, এখন টয়লেটে যাবেন না! প্লেন ওঠার পর যাবেন!”
কে কার কথা শোনে!
মধুবাবু মনে মনে ভাবলেন,
— “আমি সুগারের পেশেন্ট। সেই কখন থেকে টয়লেট চেপে বসে আছি। যাচ্ছি না। এরা এই ছেলে-পুলে চাপতে পারে না।”
সে যাই হোক, মধুবাবু চোখ বন্ধ করলেন।
এক বিকট চিৎকারে চোখ খুলে দেখেন, এয়ার হোস্টেস টয়লেটের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন।
অন্যদিকে সামনের সেই বিখ্যাত মহিলা এক বিমানকর্মীর সঙ্গে ঝগড়া করছেন—
— “এইসব খাবার বিজনেস ক্লাসের? আমি খাই না এইসব! এই খাবারগুলো পিছনে ১৬ নম্বরে যারা বসে আছে তাদের কাছে দিয়ে এসো!”
মধুবাবু ভাবলেন, ছেলের জন্য যদি মায়ের মন কাঁদছে—সোজা বললেই হয়, নাটক করে গালাগালি কেন?
এতক্ষণে টয়লেটের দরজা খুলে সহযাত্রী ছেলেটি এসে বসেছে, আর এয়ার হোস্টেস স্প্রে ও গ্লাভস নিয়ে ঢুকেছেন পরিষ্কারে।
মধুবাবু পাশের ছেলে-মেয়েটির দিকে তাকালেন।
মেয়েটি বই হাতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আর ছেলেটি সেই ঘুমন্ত মেয়েটিকেই ইমপ্রেস করতে ইংলিশ নোবেল বার করে ছোটবেলার মতো আঙুল দিয়ে মুখস্থ পড়ছে।
মধুবাবু মনে মনে বললেন—
“লাগে রাহো, বেটা!”
তারপর সিট টাকে সেট করে এলিয়ে বসলেন।
ঠিক তখনই প্লেনটা কাঁপতে লাগল।
সিটবেল্ট সিগনাল অফ ছিল—তবুও প্লেন কাঁপছে।
মধুবাবু দেখলেন এবার সেই মহিলা ছেলেকে নিয়ে টয়লেটের সামনে জোরে জোরে হাঁটছেন আর সাংঘাতিকভাবে চিৎকার করছেন।
আর টয়লেটের দরজা ধাক্কা দিচ্ছেন।
সামনের সিটে বসা বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন—
— “কি হয়েছে? প্লেনটা কাঁপছে কেন?”
মধুবাবু বললেন—
— “এয়ার টারবুলেন্স। সিটবেল্টটা লাগিয়ে নিন, দাদা।”
টয়লেটের ভেতরের মানুষটার কথা ভেবে মধুবাবুর মনটা কেমন করে উঠল।
মিড-এয়ারে কোথায় যে কী আটকে যায়, কে জানে !
তিনি আবার চোখ বুঝে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করলেন আর তো
অল্প ক্ষণেই পৌঁছে যাবেন ভেবে।
হঠাৎ একটি বিকট শব্দে হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠে দেখলেন সামনের বৃদ্ধ তার সামনে দাঁড়িয়ে।
মধুবাবু জিজ্ঞাসা করলেন "কিসের আওয়াজ দাদা? কি হয়েছে?"
বৃদ্ধ পেটে হাত বোলাতে বোলাতে হেসে বললেন," সেফ ল্যান্ডিং"
কেবিন ধোঁয়া ছাড়া গ্যাসে ভরল।
পাশের মেয়েটি নাকে হাত দিতেই,
ছেলেটি স্প্রেটি ছড়িয়ে দিয়ে বলল," এই জন্যই সব সময় হাতের কাছে রাখি"
মেয়েটি একটু মিষ্টি হেসে বলল,
"ভেরি impressive।"
মধুবাবু জানলা দিয়ে দেখলেন দিনের প্রথম আলো।
🍂
0 Comments