জ্বলদর্চি

কদম /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৭৯


কদম

ভাস্করব্রত পতি

'বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান॥
মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে রেখেছি ঢেকে তারে
এই যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান॥
আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল --
রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।
এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে তব বিস্মৃতিস্রোতের প্লাবনে
ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী বহি তব সম্মান'॥
   -- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কদম হল 'বর্ষার দূত'। কদম ফুল ফুটলেই বর্ষার আগমন নিশ্চিত হয়ে যায়। কদম্ববৃক্ষ হল সৌভাগ্য, সুখ সম্পদ ও ঐশ্বর্যের প্রতীক। আবার দক্ষিণ ভারতে এটি পার্বতীর বৃক্ষ বলে বিশ্বাস। বৌদ্ধবৃক্ষও বলা হয় কদম গাছকে। ভাগবতপুরাণে কদমগাছের কথা উল্লিখিত আছে। উত্তর ভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে জড়িত কদমগাছ। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ রাধা ও গোপিনীদের সঙ্গে কদমগাছের তলায় লীলা করতেন, কদমগাছের ডালে উঠে বাঁশি বাজাতেন, তাই কৃষ্ণপ্রেমীরা কদমফুলের অঞ্জলি দেন বিভিন্ন কৃষ্ণমন্দিরে। 
'প্রাণ সখীরে, 
ওই শোন কদম্বতলে 
বংশী বাজায় কে?'
শ্রীকৃষ্ণ নগ্ন গোপিনীদের পোশাক কদমগাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখতেন। আর নিজে লুকিয়ে থাকতেন কদমগাছের আড়ালে। বিশ্বপ্রেমিক শ্রীকৃষ্ণের সাথে কদমগাছের এই ওতপ্রোত সম্পর্কের দরুন প্রেমিক প্রেমিকাদের কাছে কদমফুল হল পুনর্মিলনের প্রতীক। কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন --
'বাঁশি বাজায় কে কদম তলায়
ওগো ললিতে
শুনে সরে না পা চলিতে'।
 কদম ফুলের অঞ্জলি

এই কদমগাছের বনেই আজকের চেন্নাই নগরীর জন্ম হয়েছিল বলে কথিত। কাহিনি অনুসারে, একদিন দেবরাজ ইন্দ্র বৃন্দাসুরকে হত্যা করেন। কিন্তু ব্রহ্মহত্যার কারণে তিনি অভিশপ্ত হন। এই শাপমুক্তির জন্য তাঁকে পৃথিবীর বুকে একটি পবিত্রস্থল খুঁজে নিতে বলা হয়। তখন দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর শাপমুক্তির জন্য পবিত্রস্থল খুঁজতে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে থাকেন। সেসময় যখন তিনি একটি ঘন কদমবনের মাঝে হাঁটছিলেন, তখন বুঝতে পারলেন যে তাঁর শাপমুক্তি ঘটে গিয়েছে। কিন্তু কিভাবে এটা হল, তা জানতে তিনি চারদিকে পবিত্রস্থলটি খুঁজতে লাগলেন। সেসময় তাঁর নজরে পড়ে, একটা কদমগাছের ছায়ায় একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। দেবরাজ ইন্দ্র তখন সেখানে একটি মন্দির স্থাপন করেন। দেবরাজ ইন্দ্রের সেই কদম্ববন পরবর্তীতে মাদ্রাস বা চেন্নাই নগর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। 
বর্ষার আগমনের বার্তা নিয়ে অপেক্ষমাণ কদমফুল

চেন্নাইয়ের মতোই এই কদমগাছের সাথে সম্পর্কিত ভারতের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য কর্ণাটকের নাম। কদম্বরাজ নামে এক রাজা একসময় বনবাসীতে রাজত্ব করতেন। এই বনবাসী বর্তমানে কর্ণাটক নামে পরিচিত। রাজা কদম্বরাজের দেওয়া নাম এই কদম্ববৃক্ষ বা কদমগাছ। কদম্বরাজের রাজত্বে কদম্ববৃক্ষ ছিল অন্যতম পবিত্র বৃক্ষ। কর্ণাটকের প্রথম রাজা এই কদম্বরাজের সম্মানে কর্ণাটক সরকার কদম্বউৎসবের আয়োজন করে থাকে প্রতিবছর। বিখ্যাত মীনাক্ষী মন্দিরের সামনে একটি কদম গাছ রোপন করা রয়েছে। দ্বাদশরাশি এবং ন'টি গ্রহের নামে যে ২৭ ধরনের উদ্ভিদ চিহ্নিত করা হয়, তার মধ্যে কদমগাছকে 'শতভিষা' নামে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের একটি জনপ্রিয় উৎসব 'করমকদম্ব'। প্রতিবছর ভাদ্রমাসের শুক্ল একাদশীতে অনুষ্ঠিত হয় তা। এ সময় বাড়ির উঠোনে একটি কদমগাছের ডাল পুঁতে পুজো করা হয়। পূজার শেষে নতুন ধানের শীষ প্রিয়জনদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। অনেকটা ঠিক কেরলের 'অন্নম' উৎসবের মতো। 
প্রেমিক প্রেমিকা

প্রাচীন সাহিত্যেও কদমের কথা রয়েছে। মহাকবি কালিদাসের শকুন্তলা নাটকে পাই 'ছায়া বন্ধ কদম্বকং মুগকুলং'। মেঘদূত কাব্যের পূর্বমেঘের ২৫ শ্লোকে পাই 'প্রৌঢ় পুষ্পেঃ কদম্বেঃ'। ঋতুসংহারে রয়েছে 'বিকচনবকদম'। শুক্ল যজুর্বেদ-৪।৩১ এ পাই --
'বনেষু ব্যন্তরিক্ষঃ এতান্ কদম্বং বাজমবৎস, 
পয় উৎসিয়াস, অদধ্যাৎ সোমমদ্রো'। 
অর্থাৎ তুমি কদম্ব। তুমি বিবশতা আন পৃথিবীতে। অন্তরিক্ষে অর্থাৎ শূন্যস্থানে (ক্ষয় জন্য শূন্য স্থানেও) বীর্য স্থাপন কর। বায়ুর মধ্যে রেণু ছড়িয়ে অপরের দেহ মনে বলাধান কর। তুমি পর্বতে ভূমিতে জন্ম নাও। ছোটদের ছড়াতেও কদমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় --
'চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে
কদমতলায় কে? 
হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে
সোনামনির বিয়ে'। 
গাছের পাতার আড়ালে লাজুক কদম

একসময় যে দৈত্যাকার কালিয়া নাগের শ্বাস প্রশ্বাসের বিষে বহুদূর পর্যন্ত যাবতীয় প্রাণী মারা পড়ত, তাঁর বাসস্থান ছিল কালিদহ সরোবরে। এর মাঝখানে থাকা ছোট্ট দ্বীপের মধ্যে ছিল একটা কদমগাছ। এই কদমগাছের ওপর গড়ুর পাখি স্বর্গলোক থেকে অমৃতপান করে এসে বসেছিল। সেইসাথে ঐ কদমগাছের ডালে গড়ুর তাঁর ঠোঁট ঘসে পরিষ্কার করছিল। সেসময় একফোঁটা স্বর্গীয় অমৃত ওই গাছের ডালের ওপর পড়ে যায়। যার জেরে কদমগাছটি অমরত্ব লাভ করে। এই কদমকে সংস্কৃতে নীপ, গিরিকদম্ব, হিন্দিতে কদম, কেল কদম, ইংরেজিতে Burflower Tree, laran, Leichhardt Pine, ওড়িয়াতে কুরুম, কেলিকদম্ব, তামিলে কোদম্ব, রুদ্রথা, কাদিমীমাল, কদপ চেতু, কন্নড়ে কদরেদ কদম, কেলিকদম বলে। কদমকে বিভিন্নস্থানে আরও যেসব নামে নামকরণ করা হয়েছে তা হল -- প্রিয়ক, হলিপ্রিয়, হরিপ্রিয়, প্রাকৃষেণ্য, বৃষ্ণপুষ্প, সুরভি, কাদম্ব, ষট পদেষ্ট, ললনাপ্রিয়, মহাচ্য, কর্ণপুরক, কাদম্মষ এবং সীধুপুষ্প।

Rubiaceae পরিবারের অন্তর্গত কদমের বিজ্ঞানসম্মত নাম Anthocephalus indicus। এছাড়াও দেখা মেলে --
Anthocephalus cadamba (Roxb)
Anthocephalus indicus var. glabrescens
Anthocephalus morindifolius 
Nauclea cadamba (Roxb) 
Nauclea megaphylla 
Neonauclea megaphylla
Neolamarckia cadamba (Roxb)
Samama cadamba (Roxb)
Sarcocephalus cadamba (Roxb)
ধর্মস্থানে পবিত্র বৃক্ষ কদমগাছের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়

পশ্চিমবঙ্গের বুকে যেসব কদমগাছ পাওয়া যায়, সেগুলি হল -- (১) ধারাকদম্ব : (সংস্কৃতে বলে সুবাসঃ, প্রাকৃষেণ্য)। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Anthocephalus cadamba। এই গাছ প্রায় ৪০-৫০ ফুট উঁচু হয়। সোজা ও সরল প্রকৃতির গাছ। ফুলগুলি ফিকে লেবুর রংয়ের মতো হয়। রাতেরবেলা ফুল থেকে সুগন্ধি বের হয়। আর ফলগুলি দেখতে ছোট ছোট পাতিলেবুর মতো। বর্ষাকালে গাছ ভর্তি ফুল ফোটে। (২) কেলিকদম্ব বা ধূলিকদম্ব : (হিন্দিতে বলে হলদী, কদমী, তামিলে সজ্জকদমী, তেলুগুতে লুব্ধকদমী, মারাঠীতে মঞ্জকদম্ব)। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Adina cordifolia। এছাড়াও একে বলে ধূলিকদম্ব, ব্রুমুকপ্রসুন, বসন্তপুষ্পী, বলভদ্র সংলক, পরাগপুষ্পী, মকর দরাস, ভূঙ্গপ্রিয়, রেণুকদম্ব ইত্যাদি। এই গাছ ২০-৩০ ফুট উচু হয়। এদের পাতা শরৎকালে ঝরে যায়। ফুলগুলি পীতবর্ণের হয় আর ফলের আকার সুপুরীর মত। (৩) নীপ বা বড় কদম্ব : এই গাছের ফুল বর্ষাকালে ফোটে। 'নীপ' অর্থে গিরির অধোভাগ। পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি জন্মাতো বলেই সম্ভবতঃ কদমের আর একটি নাম 'নীপ' রাখা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, 
'কদম কেশর ঢেকেছে আজ বনতলে ধূলি 
মৌমাছিরা কেয়া বনের পথ গিয়াছে ভুলি'।
🍂
ad

কদমগাছ বেশ বড় আকারের হয়। ৭০ - ৮০ ফুট দীর্ঘ। গাছে অনেক শাখা প্রশাখা জন্মায়। রাস্তার ধারে লাগানো হয় শোভাবর্ধক বৃক্ষ হিসেবে। এদের পাতাগুলো বেশ বড়। ডিম্বাকৃতি এবং উজ্জ্বল সবুজ রঙের। বিপ্রতীপ বিন্যাস। তেল চকচকে পাতা। শীতের সময় পাতা ঝরে যায়। ফের নতুন পাতা গজায়। তখন কচিপাতার রঙ হয় হালকা সবুজ। কাজী নজরুল ইসলামের গানের মধ্যে রয়েছে কদম ফুলের কথা --
'ময়ূরে নাচাও তুমি তোমারি নূপুর তালে। 
বেঁধেছি ঝুলনিয়া ফুলেল কদম ডালে।। 
তোম বিনা বনমালী বিফল এ ফুল দোল। 
বাঁশি বাজাবে কবে উতলা ব্রজবালা'॥
কদমের গোটা মঞ্জরিকে একটি ফুল বলেই মনে হয়। যা দেখতে গোলাকার বলের মতো। বেশ নরম মাংসল পুষ্পাধারে অজস্র সরু সরু ফুলের বিকীর্ণ বিন্যাসের সমাহারে গঠিত। পূর্ণ প্রস্ফুটিত মঞ্জরিতে সাদা হলুদের রঙ ছেটানো। খুব সুন্দর দেখতে। কদমফুলের এই সৌন্দর্যের বিষয় নিয়ে ধাঁধাতে পাই --
'দেখলে মনে চায়, ভাঙ্গলে নাহি খায়'।
কদম ফুলগুলি খুবই ছোট আকারের। বৃতির রঙ সাদা, দলমণ্ডল হলুদ, পুংকেশরচক্র সাদা এবং বহির্মুখীন, গর্ভদণ্ডটি দীর্ঘাকার। কদম গাছের ফুলের মধ্যে রয়েছে জিরার মত অজস্র বস্তু। তাই তো যে গাছটিতে জিরা, পান, সুপারী পাওয়া যায়, সেই গাছটিই কদমগাছ! কদমগাছের পাতাগুলি পানের মত, রসটি চুনের মত এবং ফুলটি দেখতে গোল বড় সুপারীর মত, আর ফুলের গায়ে অজস্র দানা হল জিরার মত! তাই ধাঁধার মাধ্যমে বলা হয় --
'গাছের নাম হিরা, 
কতক হয় পান সুপারী
কতক হয় জিরা'। (ঢাকা) 

শিবকালী ভট্টাচার্য কদম্ব নামের ব্যাখ্যা করেছেন, "কদম্ব হ'চ্ছে 'ক' (বিবশতা) থেকে 'কদি' আর অম্বচ্ একটি প্রত্যয়। এই প্রকৃতি প্রত্যয় যোগে এর নাম সৃষ্টি। এর সমষ্টিগত অর্থ হ'চ্ছে অসাড় (বিবশ) করা"। বহু প্রাচীনকাল থেকেই কদমগাছের ছালে গর্ত ক'রে শুকনো ছোলা ও লবঙ্গ পূরে রাখা হত। এর পরেরদিন সেই ছোলাগুলি কদমের রস শোষণ করে ফুলে গেলে সেগুলি বেটে খাওয়া হ'ত। এর ফলে অল্পস্বল্প নেশার পাশাপাশি বৈবশ্য বা বিবশতার সৃষ্টি হয়। এখনও ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গাঁজার কলিগুলিকে কদমগাছের গায়ে পুঁতে রেখে পরের দিন সেগুলি সেবন করে লোকজন। তাই একে বলা যেতে পারে 'সেকালের কোকেন'। 
আকাশপানে মুখ তুলে কদমগাছ

কদমের মধ্যে পাওয়া যায় Flavonoids, Cadamine, Isocadamine, Saponins, Triterpine, Triterpinoid, Glycosides, Alkaloids, Cadomdine ইত্যাদি পদার্থ। শিশুদের কৃমি (কেঁচো ক্রিমি বা গোল ক্রিমি বা Round Worm ও সূতা ক্রিমি বা Hread Worm), হাইড্রোসিল, মুখে দুর্গন্ধ, ডায়াবেটিস, টিউমার, জ্বর, ক্ষত, আলসার, স্টোমাটাইটিস, বাতব্যাথা, ব্রণ, হাত পায়ের জ্বালা ইত্যাদির উপশমে কদমের নানা উপকারী দিক রয়েছে। কদমের ফল বাদুড় ও কাঠবিড়ালি খায়। বৈদিক সুক্ত অনুযায়ী কদম্বরেণু শরীরকে বলবান করে। মত্ততা আনে। বর্ষা ও শরৎ ঋতুতে যখন প্রাকৃতিক কারণেই শরীরে দুর্বলতা আসে, তখন কদম্বরেণু বা কদম্বপুষ্প ব্যবহার করলে ভালো ফল মেলে।

Post a Comment

0 Comments