বন্দনা সেনগুপ্ত
“সারু”
“ও সারু”
“কোথায় গেলি মা?”
ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে ওঠেন গৌরি দেবী। সারদা তাঁর একমাত্র মেয়ে। একে তিন বছরেরটি নিয়ে তিনি শাঁখা সিঁদুর খুইয়েছেন। তার পর থেকে তাঁর দিন যে কি করে কাটে, সে এক তিনি জানেন আর তাঁর ঈশ্বর জানেন।
আর এই এক হয়েছে তাঁর মেয়ে! খেতে যে কি ভালোবাসে সেটা কথায় বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু, তিনি কি তাকে একটুও কিছু ভাল মন্দ খাওয়াতে পারেন? ভালো মন্দ দূরেই থাক, রোজ পেট ভরা ভাতই কি তার জোটে! তাই মেয়েটা সারা দিন এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে যা পায় খেয়ে বেড়ায়। এই অজ পাড়া গাঁয়ে কিই বা তেমন পাওয়া যায়! ভাল ফল পাকুড় তো আর কিছু নেই। এদিকে ওদিকে পাড়ার বা জঙ্গলের গাছে গাছে নোনা, আতা, বেত, ফলসা, যা পায় খুঁটে খুঁটে খায়। সেগুলি সব সময় ভালো থাকে না। হয়ত বা কাঁচাই খেয়ে ফেলল। কখনো কখনো অপরিচিত ফলও খায়। সুন্দর দেখতে হলেই সারদা ভাবে সেটা খাওয়ার জিনিস। ফলে মাঝে মাঝেই পেটের অসুখে ভোগা দুর্বল শরীর। নাহলে মাজা মাজা উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের সুন্দরী মেয়ে সারদা। এক ঢাল কালো চুল আর বড় বড় কালো চোখে আরও সুন্দর লাগে। কিন্তু, ওর দুর্বল শরীরের জন্য গৌরী দেবী দু মাইল দূরের সরকারি স্কুলে এখনও সাহস করে পাঠাতে পারেন নি। গত বছর পর্যন্ত গাঁয়ের বুড়ো পুরোহিত মশাই যখন যেমন সময় পেতেন ওকে একটু একটু অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজি, এই সব দেখিয়ে দিতেন। কিন্তু, বছর খানেক আগে পুরোহিত মশাই দেহ রাখার পরে ওর পড়াশুনাও বলতে গেলে বন্ধ। নিজে নিজেই মাঝে মাঝে পুরোনো বই খাতা খুলে বসে থাকে।
পুরোহিত মশাই বলতেন
“গৌরী, তোর মেয়ের মাথা খুব পরিষ্কার। ইস্কুলে পাঠালে এ মেয়ে অনেক দূর যাবে।”
শরীর ভাল থাকলে তো ইস্কুল যাবে! গেলে তো দুপুরে পেট ভরা ভাতও পেতো! নাহ্! এবার থেকে যে কটা দিন ভাল থাকে, ইস্কুলে পাঠাতেই হবে। গৌরী দেবী ভাবেন পেট ভরা থাকলে হয়তো খাই খাই বাইও কমবে।
কিন্তু, গেল কোথায় মেয়েটা!
ঘুরে ঘুরে বেড়ালেও খানিক পরে পরে এসে মাকে দেখে যায়। তিনি যার বাড়িতে যে কাজেই থাকুন না কেন, একটুখানি তাঁকে জড়িয়ে ধরে আদর করে আবার চলে যায়। শরীর খারাপ থাকলেও, উঠতে পারলেই, চলে আসে। কিন্তু, আজ তো সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কতক্ষন যে দেখেন নি মেয়েটাকে!
🍂
গৌরী সারা পাড়ায়, যেখানে যেখানে সারদার থাকা সম্ভব দেখে দেখে, ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে ফিরে আসছেন। এখন মনে আরও ভয়। গত প্রায় এক বছর ধরে লোকে এখানে ভূতের ভয় পাচ্ছে। কাকে যে দেখা যাচ্ছে, কেউ জানে না। একজন কি একজনের বেশি, তাও কেউ বুঝতে পারছে না। বিশেষ কোন ক্ষতি করেছে, তাও বলা যাবে না। কিছু করে নি, তাও বলা যাবে না। যেমন ধর, মাতলা বলাই রাতের দিকে ধেনো খেয়ে গান গাইতে গাইতে ফিরছিল। কে জানি তাকে ধরে দুখানা থাপ্পড় দিয়েছে। একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেছিল। আরেক দিন চড় খেয়েও দৌড়ে পালিয়ে আসতে পেরেছিল। তারপর থেকে বিকেল হতেই কাজ সেরে বাড়ি চলে আসে। আর মদের ঠেকের দিকেই যায় না। বলাইয়ের মনে ভাল মন্দ যাই হোক, ওর বউ খুব খুশি।
আবার, কানুর কথাই ধরো। ওর ভাষায় ও পড়েছিল ডাকাতের হাতে। ডাকাত আর কি! আসলে হাতে ছুরি চাকু নেওয়া তিনটে মানুষ ওকে ঘিরে ধরেছিল। ওর ট্যাঁকে গোঁজা ছিল বেগুন বিক্রির কড়কড়ে তিনটি হাজার টাকা। হঠাৎ, কোথা থেকে কে জানে একটা উড়ন্ত ঘূর্ণির মত হাওয়া ওকে উড়িয়ে নিয়ে এলো। কানুর ভালো হলেও ওই লোক তিনটের কি আর ব্যাপারটা ভালো লেগেছিল!
আর, কানু বলাই এরা ভয় পায় নি, এমন নয়। যতই হোক, এসব হচ্ছে শীর্ষেন্দু বাবুর ভাষায় “অশৈলী কাণ্ড”।
আজ গৌরী দেবী চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ফিরে দেখেন সারদা ঘরের দাওয়ায় শোয়ানো রয়েছে। ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে মুখে চোখে জল ছিটিয়ে ভাঙ্গা তালপাখাটা দিয়ে বাতাস করতে শুরু করলেন। চোখের জল তো পড়ছেই। গ্রামের একটেরেয় বাড়ি, গলা ফাটালেও সহজে কারুর সাড়া পাওয়ার উপায় নেই। উনি যে কি করেন!
কিন্তু, একটু পরেই মেয়ের জ্ঞান ফিরল। একটু জল বাতাসা খাইয়ে সুস্থ হতে যা জানলেন, তাতে ওঁর অন্তরাত্মা প্রায় খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়।
সারদা আজ একটু দূরেই চলে গেছিল। সেখানে কয়েকটা ছেলের সঙ্গে দেখা। ওরা বোধহয় জঙ্গলে পিকনিক করতে এসেছিল।
“তারা আমাকে খেতে দিয়েছিল। তারা আমাকে বলেছিল এগুলোকে লুচি বলে। সাদা সাদা গোল গোল। সঙ্গে আবার কি সুন্দর সাদা সাদা আলুর তরকারি দিয়েছিল। আর, গোল গোল সাদা মিষ্টি দিয়েছিল। বলেছিল … বলেছিল … কি যেন গোল্লা। নাম মনে নেই কিন্তু খেতে ভালো। খুব ভালো। কিন্তু, তারপর যেন কি একটা হয়ে গেল। ওরা সব কেমন কেমন করছিল। আমাকে ধরছিল। ছুঁচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন আমার জামা কাপড় খুলে ফেলবে। আমার খুব ভয় করছিল। আমি পালাতে চাইছিলাম। ওরা ধরে ফেলছিল। ওরা কামড়ে দিচ্ছিল। খিমচে দিচ্ছিল। আমি কাঁদছিলাম। ওরা শুনছিল না।”
“তারপর। তারপর। পুরোহিত দাদু এলো। হাওয়ার মত এলো। সঙ্গে আরও যেন কারা ছিল। ওই ছেলেগুলোকে খুব মারল। ওরা আছাড় খেয়ে ধপাধপ পড়ে যাচ্ছিল। তারপর … তারপর মনে নেই। তারপর … তারপর তুমি ডাকছিলে।”
“মা। ও মা। মা। আমি আর কক্ষনও খেতে চাইবো না। কক্ষনো তোমাকে ছেড়ে যাব না। ও মা আমার ভীষন ভয় করছে। ও মা! মা গো। দাদু না এলে ওরা কি আমাকে মেরে ফেলত? কেন মা? আমি তো ওদের খাবার চুরি করি নি। ওরা তো নিজেরাই দিয়েছিল। তবে কেন আমাকে মারছিল? আমার কি দোষ?”
আজ অনেক মেয়েরাই এই প্রশ্ন করছে। এর কি আর কোনও উত্তর আছে!
(সমাপ্ত)
1 Comments
গল্পটি আমার ভালো লেগেছে। সমাজের রোজকার বাস্তবতার সাথে সাথে এখানে আমাদের হতাশার কারণও ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে, আমাদের লোভ যে কতটা গভীর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, সেই বিষয়টি গল্পে অনিচ্ছাকৃত হলেও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
ReplyDeleteNew comments are not allowed.