জ্বলদর্চি

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি /একাদশ পর্ব / চিত্রা ভট্টাচার্য্য

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি 
একাদশ পর্ব  
চিত্রা ভট্টাচার্য্য

প্রেমের পূজারী নজরুল

প্রেমের পূজারী কবির আরাধনায় প্রেম আশীর্বাদ হয়ে এসেছে দেবদূতের মত নবনব রূপে সৌরভে গন্ধে মাতিয়ে। কিন্তু তাঁর প্রকাশে  প্রেমিক সত্ত্বার মধ্যে নিহিত রয়েছে বিদ্রোহী সত্ত্বার শিকড়।মানব মনের নিষ্ঠুরতা প্রেমহীন হৃদয় তাঁকে বিদ্রোহী করেছে। যদি এই সমাজনীতির দ্বিচারিতা, রাষ্ট্রনীতিতে অন্যায় শোষণ-নির্যাতন না থাকতো, পারস্পরিক সম্পর্কের মাঝে যদি স্বার্থপরতা, প্রতারণা, হিংসা-বিদ্বেষ বা দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার না থাকতো ,যদি সর্বত্র সকল কাজের মাঝে সাম্যের সুর ধ্বনিত হতো সর্বত্র, -তাহলে হয়তো প্রতিবাদী নজরুলের বিদ্রোহী সত্ত্বার প্রকাশ চিরদিন সুপ্ত থেকে যেত।           

বাংলাকাব্য সাহিত্যের জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে আদ্যন্ত এক প্রেমিক কবি নজরুল বিরাজ করতেন ।  
 তাঁর প্রতিটি কবিতার স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় নজরুল মানসের প্রেমের অনুভূতির কাব্যিক স্পর্শ। কবি চিত্তের বিচ্ছেদের তীব্র জ্বালা ,প্রেমের নিবিড়তা, চিরন্তনতার  প্রকাশ দেখা যায় সিন্ধুর -হিন্দোল’কবিতায়  এক মানসিক অশান্ত রূপের প্রকাশে লিখলেন  ,--  
‘এক জ্বালা, ব্যথা নিয়া তুমি কাঁদ আমি কাঁদি, কাঁদে মোর প্রিয়া।’ 
🍂

  
  কবিতায় তিনটি তরঙ্গে ঢেউয়ের অবিরাম গর্জন-আলোড়ন-অস্থিরতার সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে কবির বিক্ষোভ-বেদনা-উত্তাল দুঃখ-দ্রোহের ছন্দ। তিনি অনুভব করেন , নারীর দৃষ্টিতে থাকে দহন দীপ্তি যা জ্ঞান ও কাব্যশিল্পের প্রেরণা, কবিতার বিষয় হয়ে ধরা দেয়।  প্রেম ও আধার হয়ে  নারী যুগ হতে যুগান্তরে, দেশ হতে দেশান্তরে সমাদৃত । রোম্যান্টিকতার বিচিত্র উপাদানে সৃষ্টি স্বভাবকবি নজরুল । তাঁর কাব্যচেতনায় যে প্রেম যে রহস্যবোধের ছোঁয়া, প্রকৃতির বিচিত্র আবেশে তাঁর যে অবগাহন, বিলীন হয়ে যাওয়া সেখানে কোথাও আবেগের তীব্রতা, অনুভূতির তীক্ষ্মতা, বিদ্রোহের প্রতিবাদ- এসবই চরম রোম্যান্টিকতার প্রকাশ। শুধু তাই নয়, কবির মধ্যে যে বেদনা, যন্ত্রণা এমন কি কখনো চরম ব্যর্থতায়  নৈরাশ্যএসেছে  তা-ও তাঁর রোম্যান্টিক মনের অবদমিত এক চেতনা-প্রবাহ। 

একদিকে যেমন নন্দনতাত্ত্বিক অভিব্যক্তির ছোঁয়া , প্রণয়ীর আকর্ষণের জন্য চরম আকাঙ্ক্ষা সোহাগ আদরের আলতো পরশ রয়েছে তেমনি বিরহে প্রেমের জ্বালা  , হতাশার -অনুতাপে  মানসিক যন্ত্রণার টানাপোড়নে করুণ দীর্ঘশ্বাসের হাহাকার ওঠে ।  তার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে অদৃষ্টবাদী না হয়ে দুর্জয় সংগ্রাম, বিদ্রোহ অর্থাৎ প্রার্থিত বিষয় ‘আদায়’ করে নেবার মানসিকতা। সাহিত্যে ও এই মনস্তাত্ত্বিক সত্যাসত্যের প্রতিফলন স্পষ্ট। তাঁর কাব্যে ইউরোপীয় রোমান্টিসিজমের প্রেরণা ও প্রভাব থাকলেও নজরুলের মধ্যে বঙ্গীয় লোকায়ত দেহবাদের প্রাধান্য ও  ভারতীয় ঐতিহ্যের শক্তিতত্ত্বের প্রভাব রয়েছে। একান্তই পার্থিব তাঁর রোমান্টিসজম । প্রভুত্ববাদের বিরুদ্ধে তাঁর দ্রোহশক্তি যেমন কোনো রূপক-প্রতীকের ছদ্মবেশ নেয়নি, তা প্রত্যক্ষ ও সরাসরি, তেমনি তাঁর বিষাদ-বেদনাও দেহকে ছাড়িয়ে অতীন্দ্রিয়লোকে উত্তরণ করেনি।  

 তাঁর প্রেমের স্বীকারোক্তি, 

 ওগো জীবন-দেবী।
     আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,
আজ বিশ্বজয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!
আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে,
বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
   যত তৃণ আমার আজ তোমার মালায় পূরে’,
          আমি বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে।।

                      কলকাতার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ( বাঙলা ১৩২৮ সালে) মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত কবির  মনের গোপন বার্তার সুরের ধ্বনি শুনেছিলেন। কুমিল্লার চেনা গ্রাম্য কিশোরীর চোখে কবির বিস্ময় আর মুগ্ধতার ঝিলিক সেদিন নানা ছলে প্রকাশ পেয়েছিল ‘বিজয়িনী’কবিতায়।  গোপন ভালোবাসার ইঙ্গিত কবির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ও কাব্যিক মুগ্ধতা সেদিন কিশোরী আশালতাকে প্রভাবিত করেছিল । হৃদয়ে তন্ত্রের  গোপন উচ্ছ্বাস প্রকাশ্যে ধরা না দিলে ও ভালবাসার গোপন বিরহ সংবাদটুকু একান্তে সৃষ্ট গানে ও কবিতায় প্রকাশ পেয়েছিল। একাধিকবার কবির কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে অবস্থান পর্বগুলি কিশোরী কন্যার মনে অনুরণন তুলেছিল। -- তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ সেসব নৈঃশব্দ্যের কবিতা ও তার গোপন অনুশীলন। এই প্রেম পর্বের জ্বলন্ত প্রমান রইলো কবির সৃষ্টি দোলনচাঁপায় ,ছায়ানট ,সিন্ধুরহিল্লোল ,চক্রবাঁকের একাধিক পাতায় ।  
 
নজরুলের সৃষ্টিতে তাঁর  বিভিন্ন রচনায় নারী কখোনো মাতৃরূপ, কখোনো বধূরূপ, কখোনো  প্রেমিকা বা কন্যারূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।  নারীদের অসহায়ত্ব, বঞ্চনা, গ্লানি ও অসম্মানের বিরুদ্ধে বারবার গর্জে উঠেছে কবির শাণিত কলম। কবি চাইতেন শতাব্দীর পর শতাব্দী লাঞ্ছিত হওয়া নারী জেগে উঠে ন্যায্য অধিকারের দাবিতে সমবেত প্রতিবাদে সোচ্চার করুক তাদের কণ্ঠ। কবি বারবার নারীর সমানাধিকার নিয়ে আওয়াজ তুলেছেন। গেয়েছেন শিকল ভাঙার গান।‘বারাঙ্গনা’ কবিতায়  সোচ্চারে ঘোষণা করেছেন ‘শুন ধর্মের চাঁই, জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো প্রভেদ নাই! অসৎ মাতার পুত্র যদি জারজ পুত্র হয়, অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়।’'

 ১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে কবি যোগদিলেন  এবং দু’দিন পরে কৃষ্ণনগরে ফিরেছিলেন।   ১৯২৮ সালে ঢাকাতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বার্ষিক মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে নজরুল যোগদান করে আড়াই মাসের মত থাকলেন এবং  তাঁর স্বরচিত ‘চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ গানটি গেয়ে  অধিবেশনের উদ্বোধন করে সভা মাতিয়ে দিলেন। 

এই সময়ে মিস ফজিলাতুন্নেসার সাথে কবির আলাপ  এবং প্রথম দেখাতেই তিনি ঐ তরুণী বিদুষী কন্যার প্রেমে ও পড়েছিলেন।  ফজিলাতুন্নেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম মুসলিম ছাত্রী এবং অঙ্ক শাস্ত্রে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থানাধিকারী ।  সেকালের মুসলিম সমাজের নারী হয়েও নিজের প্রবল আগ্রহ এবং অধ্যবসায়ে উচ্চশিক্ষা  প্রাপ্ত্যা।। এই ব্যতিক্রমী প্রগতিশীলা মহিলার সাথে কবি বন্ধু মোতাহার চৌধুরী ,জ্যোতিষীবিদ্যায় পারদর্শী  , হস্তরেখার বিষয়ে আলোচনায় উৎসাহী নজরুলের  আলাপ পরিচয়ে করিয়ে দিয়েছিলেন। কবির উত্তাল হৃদয়ের আবেগমথিত নিবেদন প্রত্যাঘাত সয়েছিল শ্যামাঙ্গী তরুণী ফজিলাতুন্নেসার নির্দয় কর্কশ ব্যবহারে।  
কবি তাকে ভালবেসে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কন্যার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান ও ব্যঙ্গবিদ্রুপের সাথে অবহেলায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন, তবুও কবির সৃষ্টিশীলতার প্রেরণাদায়ী হিসেবে ফজিলাতুন্নেসার নাম যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। অভিমানী কবি আর কোনোদিন তাকে সরাসরি চিঠি দেননি। তবুও চিঠি লিখতেন প্রাণের বন্ধুকে ।   
 
ফজিলাতুন্নেসা সম্পর্কে সৈয়দ আলী আশরাফ লিখেছেন, ".তার রং ময়লা ছিল, চেহারায় দীপ্তি ছিল, সৌকর্য ছিল। ৯২ নং দেওয়ান বাজারের বাসায় থাকতেন। কখনও বোরখা পরেননি, সুতরাং বলতে হবে তখনকার দিনের রক্ষণশীল ঢাকা শহরের বুকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে পড়াশুনা করা তাঁর দুর্জয় সাহসের পরিচয়।’ ফজিলাতুন্নেসার বিলেত যাত্রার প্রাক্কালে কলকাতার সওগাত পত্রিকার অফিসে একটি সম্বর্ধনা সভার আয়োজনে তাঁকে  উদ্দেশ্য করে নজরুল ইসলাম স্বরচিত গান ওই অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন।   :
                                                চলিলে সাগর ঘুরে
                                              অলকার মায়ার পুবে,
                                              ফোটে ফুল নিত্য যেথায়
                                                  জীবনের ফুল্ল শাখে।
                                               থেক না স্বর্গে ভুলে.......
    
 নজরুল  ফজিলাতুন্নেসার প্রতি তাঁর অনুরাগের কথা বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন ছাড়া আর কাউকে বলেননি। মোতাহার হোসেনের বোন ছিলেন ফজিলাতুন্নেসা। সুতরাং বন্ধুকে লেখা চিঠি যে বোনের দরবারেও ও পৌঁছবে কবি তা জানতেন। নজরুলের ক’টা চিঠি থেকে স্পষ্টতঃই  ফজিলাতুন্নেসার  প্রতি কবির গভীর অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। 
সেইসময় কৃষ্ণনগর থেকে মোতাহার হোসেনকে নজরুলের লেখা একটি চিঠির শেষাংশ:                                            ‘'এ চিঠি শুধু তোমার এবং আরেকজনের। একে সিক্রেট মনে করো। আরেকজনকে দিও এ চিঠিটা দু’দিনের জন্য। কতগুলো ঝরা মুকুল দিলাম, নাও।''  তোমার নজরুল।’

কোলকাতা থেকে কবির  লেখা আরেকটি চিঠি
 ‘আচ্ছা ভাই, আমার সব চিঠিই কি তোমার বোনকে দেখাও? বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে, চিঠিগুলো আবার ফিরিয়ে নাও তো?’ নজরুল নিঃসন্দেহে ফজিলাতুন্নেসাকে গভীরভাবে ভালবেসে-ছিলেন। আর সেজন্যেই অল্প হলেও ফজিলাতুন্নেসার প্রতিতাঁর অনুরাগ ও বিনিময়ে সাড়া না পাওয়ার আঘাতজনিত বেদনা নজরুলের কাব্য ও কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। নজরুল জীবনী পর্যালোচনায় দেখা যায় , ফজিল্লাতুন্নেসাই একমাত্র মহিলা যিনি নজরুলের প্রেমের আহ্বানে সাড়া দেননি। এবং দৃঢ়ভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই প্রণয় প্রধানত একতরফা ছিল। মিস ফজিলাতুন্নেসা কতদূর প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, তা বোঝা দুষ্কর।’  
    
প্রিয়ার কাছে  আঘাতপ্রাপ্ত্য হয়ে ও কবি তাকে উদ্দেশ্য করে ‘কৌতুকময়ী’ কবিতায়  বলেছেন:
‘তুমি বসে রবে ঊর্ধ্বে মহিমা শিখরে নিষ্প্রাণ 
পাষাণ দেবী?
কভু মোর তরে নামিবে না প্রিয়ারূপে ধরার ধুলায়?
লো কৌতুকময়ী! শুধু কৌতুক লীলায়?
দোলাবে আমারে লয়ে? আর সবি ভুল?’
পরে  ফজিলাতুন্নেসা অন্যত্র বিয়ে করে বিদেশ পাড়ি দিলেন তার বিদায়ে কবি লিখেছিলেন বর্ষা বিদায় কবিতা। 

আরেকটি কবিতায়  সম্ভবত কাজী মোতাহার হোসেনকে সখী বা সখা হিসাবে এবং ফজিলাতুন্নেসাকে বধূ হিসাবে কল্পনা করে কবি লিখেছেন।
‘সখি, বলো বধুয়ারে, নিরজনে!
দেখা হলে রাতে ফুলবনে!’
নজরুল মনে করেন যে ফজিলাতুন্নেসা তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে এমন করে কাঁদাতে পারে না, সে তাঁর জন্ম-জন্মান্তরের প্রিয়া। নজরুলের গানে এই অনুভূতির রূপায়ণ হয়েছে:
‘স্মরণ পারের ওগো প্রিয়া তোমায় আমি
চিনি যেন
তোমার চাঁদে চিনি আমি, তুমি আমার
তারায় চেন।’
নজরুল তাঁর স্বনির্বাচিত শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন ‘সঞ্চিতা’ ফজিলাতুন্নেসাকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। 
২৮-৩-’১৯২৮ তারিখে ফজিলাতুন্নেসাকে লেখা নজরুলের চিঠিই এর প্রমাণ: ‘আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রানী। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ ‘‘সঞ্চিতা’’ আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই।...আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলী অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার অন্য কি সম্মান করিব?’ কিন্তু  সেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। 
কাজী নজরুল ইসলাম অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁর ‘সঞ্চিতা’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেছিলেন।  

ফজিলাতুন্নেসা নজরুলকে একটা চিঠি লেখেন বেশ কড়া ভাষায় ১৯২৮-এর মার্চমাসে।  ঐ সময় প্রাণের বন্ধু মোতাহারকে লেখা নজরুলের একটি চিঠিতে তাঁর বেদনার্ত আত্মার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে নজরুল লিখলেন ,.
"আচ্ছা বন্ধু ক’ফোঁটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয়...?. সত্যিই তো তার সুন্দরের চরণ ছোঁয়ার যোগ্যতা আমার নেই, আমার দু’হাত মাখা কালি। বলো, যে কালি তার রাঙা পায়ে লেগেছিল; চোখের জলে তা ধুয়ে দিয়েছি।...সে যদি আমার কোন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তাকে বলো আমি তাকে প্রার্থনার অঞ্জলির মত দুই করপুটে ধরে তুলে ধরতে, নিবেদন করতেই চেয়েছি  বুকে মালা করে ধরতে চাইনি। দুর্বলতা এসেছিল, তাকে কাটিয়ে উঠেছি।'  'ফজিলাতুন্নেসা বিলেত থেকে ফেরার পর নজরুলের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। কবির প্রণয়পর্বের সেখানেই ইতি ঘটেছিল ।  
প্রেমের পূজারী নজরুলের জীবনের তিন অধ্যায় নার্গিস,  প্রমীলা ও ফজিলাতুন্নেসার কথা বিশদ ভাবে না জানলে কবির কবিতা ও গান কে মর্ম দিয়ে অনুভব করা বাস্তবিকই অসম্ভব হবে। নজরুলের একপাক্ষিক প্রেমে ফজিলাতুন্নেসার ভালবাসা না পেলেও বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভান্ডার পূর্ণ হয়েছে প্রেমিক হৃদয়ের অসাধারণ সব গান কবিতা ও কাব্য সংকলনে !
  
   কবির  জীবনে এসেছিল আরো প্রেম  ১৩ বছর বয়সী সুন্দরী ও সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী ঢাকার বনগ্রামের মেয়ে রানু সোম (যিনি পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসু ছিলেন  )। এবং আরো এক নারী উমামৈত্র বা  নোটন নামের মেয়ের আবির্ভাব ঘটেছিল। নজরুল গান লিখলেন ‘নাইবা পড়িলে নোটন খোঁপায় ঝুমকো জবার ফুল।’ গানটি অব্যক্ত অনেক কথা যেন বলে দেয়। কোনো একসময়ে এরপর এলেন  জাহানারা ইমাম । কবি তার খাতায় ৭টি গান ও ৮টি কবিতা লিখে তাকে উৎসর্গ করেছিলেন।  গান শেখার ছলে কবির জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়েছিলেন  কানন দেবী। সম্ভবত, ১৯৩০ সালে। প্রকৃতপক্ষে কবি নজরুল গান শিখিয়েছেন, কবিতা লিখে দিয়েছেন এবং উৎসর্গ করেছেন অনেক নারীকেই। ইন্দুবালা দেবী, আঙ্গুরবালা দেবী, বিজনবালা ঘোষ, সুপ্রভা সরকার, ফিরোজা বেগম ছিলেন নজরুলের শিষ্যা। কবির  জীবনীকার গবেষকগনের মতে কানন দেবী, জাহানারা ইমাম, নোটন, রানু সোমকে নিয়ে কবি গান ও কবিতা লিখেছেন এবং উৎসর্গ করেছেন প্রেমিকপুরুষ হিসেবে। কিন্তু নার্গিস, প্রমীলা ও ফাজিলাতুন্নেছাকে কবি সরাসরি  প্রেম নিবেদন করেছিলেন । 
 ‘রূপের দেশের স্বপন কুমার স্বপনে আসিয়াছিনু
বন্দিনী! মম সোনার ছোঁয়ায় তব ঘুম ভাঙ্গায়িনু।
দেখ মোরে পাছে ঘুম ভাঙ্গিয়াই
ঘুম না টুটিতে তাই চলে যাই।’
নজরুলের প্রেম মনজগৎ রোমান্টিসজম একান্তই পার্থিব। প্রভুত্ববাদের বিরুদ্ধে তাঁর দ্রোহশক্তি যেমন কোনো রূপক-প্রতীকের ছদ্মবেশ নেয়নি, তা প্রত্যক্ষ ও সরাসরি, তেমনি তাঁর বিষাদ-বেদনাও দেহকে ছাড়িয়ে অতীন্দ্রিয়লোকে উত্তরণ করেনি।তাই জীবনের শেষ ভাষণে কবি বলেছিলেন: '‘আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি ;আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। ''
 
তথ্য সূত্র  ;--  (নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়/সৈয়দ আলী আশরাফ) 

সুখী নজরুল দুঃখী নজরুল --ফিরোজা বেগম                   তথ্যসূত্র  --.কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা :/ মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৬৯ )

কাজী নজরুল ইসলাম, ২০০৬। নজরুল-রচনাবলী (জন্মশতবর্ষ সংস্করণ), (সম্পাদনা-পরিষদ : রফিকুল ইসলাম), বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

বিশ্বজিৎ ঘোষ/ নজরুল জীবন ও সাহিত্য।

Post a Comment

0 Comments