জ্বলদর্চি

জীবন যেখানে দাঁড়িয়ে / অসিতরঞ্জন ঘোষ

জীবন যেখানে দাঁড়িয়ে / অসিতরঞ্জন ঘোষ

পাহারাদার আমি

পথের ধারে আছি বসে দেখছি যাতায়াত, 
নীলাকাশে মেঘের পাহাড়, কৃষ্ণচুড়ার ছাত।
সেই ছায়াতে বসে বসে,
মানুষ দেখি এক নিমেষে,
কাউকে দেখি অনিমেষে, সে বেশ অকস্মাৎ।
বড় রাস্তায় বড় গেটের পাহারাদার আমি।
সকাল সন্ধ্যেয় হাজার মানুষ ভিতর- বাহিরগামী।
তাদের মধ্যে দু একজনার,
চলন বলন অতি চেনার,
ভাবতে যাই সে আপনার, তারপরেই রাশ টানি!
এমনি করেই আপন খুঁজি, দ্বারের পাশে বসে।
কৃষ্ণচুড়ায় ডালে ডালে সবুজ ধেয়ে আসে।
পাখি বসে টিয়া শালিক,
জিরিয়ে নিয়ে একটু খানিক,
ফুরুৎ পালায় খুব স্বাভাবিক, হয়তো ভালোবাসে।
সবুজ লালে ছেয়ে থাকে হিমেল পরশ পেয়ে,
ভালোবাসার স্বপ্ন আঁকি, আকাশ ওঠে গেয়ে
হাজার রকম মেঘের ভেলায়,
হারিয়ে যাই স্বপ্ন মেলায়,
আপন খুঁজি মানুষ গুলায়, বুকের কাছে নিয়ে।।
গেটের পাশে কৃষ্ণচুড়া, পাশে ছোট্ট ঘর,
সেই ঘরেরই ছোট্ট টুলে, আমার পরিসর।
তাকে নিয়ে বাইরে বসি,
গাছের ছায়ায় বেজায় খুশি,
মানুষ মায়ায় মুখে হাসি, তৃপ্ত এ অন্তর!
এমনি করেই দিন কেটে যায় দ্বাররক্ষীর জেনো,
আপন ভেবে হাত নেড়েছে, কদাচিৎ কখনো-
তেমন মানুষ তবু আছে,
পাছে হারাই ভীড়ের মাঝে,
দেখায় আমার হৃদয় নাচে, বুকভরা স্বপনও!


কেউ তো ভালোবাসে! 

শুনেছিলাম সুখে আছে বড়োবাড়ির দাদু,
তিনতলার সাতমহলা,
পদ্মদীঘির বিশাল জলা,
নাতি পুতি ছেলে মেয়ে জমিদারির যাদু!
কিছুতেই আজকাল মন ভালো নেই তার,
উদাস হয়ে বসেই থাকে,
আকাশ পথে ছবি আঁকে,
জীবন যেন বেশ ফ্যাকাসে, 'বিষ এ সংসার'।
তিন তিনটে ছেলে তার, সাত সাতটা নাতি।
একে একে সব ছেড়েছে,
ছোট্ট নাতি সে ও গেছে,
আছে তারা দেশ বিদেশে, কেউ নয় তার সাথী।
বড় ছেলের খ্যাতি অনেক, নামকরা ডাক্তার।
দেশের বাইরে থাকে বেশি,
বাড়ি ঢুকেই বলে' আসি',
বাপের জন্য দরদখানি, দেখায় না সে আর!
মেজ ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, মেম করেছে বিয়ে।
আর আসেনি এ মুলুকে,
জন্মভিটে- গেছেই চুকে,
ভিডিও কলে খবর নিত, বিয়ের আগে গিয়ে!
ছোটো ছেলে উকিল বড়, কলকাতাতে পসার।
গাঁয়ের বাড়ি ঘুরতে আসে,
থাকে দুদিন, তারপর সে-
হাত নাড়িয়ে শহরে ফেরে। শূন্য ভালোবাসার।
ছেলে বউ সঙ্গে নিয়ে, আসেন উকিল বাবু।
ছেলেটি তার দাদুকে চায়,
নাতি- দাদু ঘুরে বেড়ায়,
দুজন খেলে সাতমহলায়, আল্হাদে হাবুডুবু।
পদ্মদীঘির পদ্মফুলে ফড়িং প্রজাপতি,
পদ্মপাতায় জলের মোতি,
কালোজলে স্বপন পাতি,
জলপরীদের গল্পে মাতে দাদু এবং নাতি।
আকাশ দেখে দুচোখ ভরে, দীঘির কালোজলে,
কত কথাই বলে নাতি,
দাদু শোনে কানটি পাতি।
পানকৌড়ি ডুব কাটছে, হাঁস চলেছে পালে।
আল দিয়ে গরুর পাল, বিশাল বটের ছায়া,
খালি গায়ে গাঁয়ের ছেলে,
ধানের ক্ষেতে বাতাস খেলে,
খিলখিলিয়ে হাসে নাতি, লাগছে গাঁয়ের হাওয়া।
পাড়ার খুড়ো আদর করে, গালখানি দেয় টিপে,
হাসিমুখে থ্যাঙ্কু জানায়,
দাদুর বুকে দোল খেলে যায়,
জীবনখানি বেশ লাগে তার , শান্তি অনুভবে।
সেদিন রাতে নাতি ঘুমায় দাদুর বিছানায়।
আঙ্গুল ধরে ছোট্ট নাতি,
ঘুমিয়ে কাটায় সারা রাতি,
ভোরের সূর্য দেখে দুজন পূবের সীমানায়।
আকাশ ছায় মেদুর আলোয়, ঘাসের শিরে শিশির।
গাঁয়ের পথে অনেক ফুল,
শিউলি জবা টগর বকুল,
আর কত কি অবাক করে, ছোট্ট নাতিটির।
শালিক ওড়ে পায়রা ওড়ে, সাতমহলার ছাদে,
ডালে ডালে কোকিল ডাকে,
চড়াই টিয়া ঝাঁকে ঝাঁকে,
চুয়েপড়া খুশির মাঝে , হৃদয় ডুকরে কাঁদে।
এবার তাদের ফেরার পালা, দেড়টি দিনের শেষে।
কাঁদিয়ে ভাসায় ছোট্ট নাতি,
ভাঙছে দাদুর বুকের ছাতি,
ভাঙাদিনে বাজছে সানাই, কেউ তো ভালোবাসে!

🍂


সুরের মায়া

কেউ যায় না সেইকোনাতে,
একলা বসে একতারাতে,
গান গেয়ে যায় দিনেরাতে, সে এক বৈরাগী।
প্রতিদিনই এক ছোট্ট মেয়ে
কিসের নেশায় আসে ধেয়ে,
ফুলের গুচ্ছ রেখে পায়ে, সুরের মাঝে উঁকি।
এমনি করেই দিন কেটে যায়,
সুরের তরী পাল তুলে দেয়,
ছোট্ট মেয়ে পাড়ি জমায়, সুরের আকাশ ছায়।
বৈরাগী গায় আপন মনে,
একতারাটি সংগোপনে,
অবাক করা সুর ও তানে, মেয়েটি বেশ বাজায়।
কেউ জানে না, জানে দুজন,
সুর সাগরে ভাসে সুজন,
সময় খোঁজে তার প্রয়োজন, এই মেয়ে কোনজন?
শ্মশান শেষে, নদীর পাড়ে,
হেলা বটের গুড়ির আড়ে,
বৈরাগীর ছোট্ট কুটীর, নীরব ও নির্জন।
মা বাপহারা ছোট্ট মেয়ে,
শ্মশান ঘোরে খেলে গেয়ে,
ফুল তুলে দেয় মায়ের পায়ে আর ঐ বৈরাগীর।
কেউ নেয় না খবর তাহার,
শ্মশান ভূমি - সব একাকার,
খোঁজ রাখে না কেহ কাহার, নয় তো মেয়েটির!
সুরের টানে ছুট্টে সেদিন,
এসেছিল মা-বাপবিহীন,
আদর ভালোবাসায় প্রবীণ, রাখে নিজের কাছে।
শুনে শুনে কি করে সে!
বাজিয়ে দিল এক নিমেষে,
একতারাটি নিয়ে হাসে, গায় আর কেবল নাচে!
একতারাতে প্রাণটি ঢালে
গানের লয়ে মন্ত্র বলে
জীবন তারে সুর তুলে সে, নামে সংগ্রামে।
প্রবীণ নবীন দুয়ে মিলে,
গোল বাঁধালো জগৎ কোলে
সুরসাগরে সমুজ্জ্বলে, শান্তি আসে নেমে।।


বন্ধু

বুক চিতিয়ে কে দাঁড়ালে, রাখলে কাঁধে হাত।
তোমার সঙ্গে আগে তো কই, হয় নি মোলাকাত!
তবু এই বিপদ দিনে, তোমার উপস্থিতি -
না ভেবেই আগুপিছু, নিজের লাভ বা ক্ষতি।
কেমনতর মানুষ তুমি, আগুন নিয়ে খেলা -
বাড়ি ঘর সব জ্বলেছে, লেলিহানের নোলা।
ধোঁয়া আগুন সব মিলিয়ে, অচৈতন্য দেহ।
বাঁচবো আমি ভাবিই নিতো, আর ভাবেনি কেহ।
তুমি এলে আর বাঁচালে, প্রাণের বাজি রেখে।
জীবন দিলে নতুন করে, গায়ে আগুন মেখে।
তুমি আছোই আশেপাশে, বিপদ কাঁধে নিতে,
তোমার জন্য সমাজ আজও দাঁড়িয়ে শক্ত ভিতে।
সকল কালের তুমিই কৃষ্ণ, যীশু, মহম্মদ।
আপদ বিপদ সামলে নিতে হৃদয়ে এই দরদ।
বলছি কাকে শুনছে কেবা? কোথায় সে যে গেলো?
উপকার করতেই এরা যুগে যুগে জন্মালো।
সস্তা নামের ধার ধরে নি, ধার ধরে না বাহবা’র,
মৃত্যু কে সে জয় করেছে, জড়িয়ে চাদর মানবতার।

Post a Comment

0 Comments